ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

সোলার পার্কের আয়ে সম্পূর্ণ পরিশোধ সম্ভব নয়

বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক বন্ডের পরিপক্বের সময় ঘনাতেই বাড়ছে উৎকণ্ঠা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০১:০৩, ৯ মার্চ ২০২৫

বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক বন্ডের পরিপক্বের সময় ঘনাতেই বাড়ছে উৎকণ্ঠা

বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক

আওয়ামী লীগের সরকার পরিবর্তনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এখন জেল হাজতে রয়েছে। তার  হাত ধরে শেয়ারবাজারে আসা বেক্সিমকোর পাঁচ বছর মেয়াদি ‘বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক’ ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে পরিপক্ব হবে। তখন প্রতিষ্ঠানটিকে বিনিয়োগকারীদের প্রায় দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।

তবে এখন নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, কারণ গ্রুপের প্রধান রাজস্ব উৎস টেক্সটাইল ইউনিট বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি এটির অন্যান্য আয়ের উৎসও প্রায় সীমিত; বর্তমানে সোলার পার্কই তাদের প্রধান রাজস্ব উৎস। এখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে বন্ডটির ইউনিটধারীরা।
সোলার পার্কের আয়ে সম্পূর্ণ পরিশোধ সম্ভব নয় ॥  নির্ভরশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে গ্রুপটির যে অবস্থা সেই পরিস্থিতিতে শুধু সোলার পার্কের আয় দিয়ে সুকুকের সম্পূর্ণ পরিশোধ সম্ভব নয়। পার্কটি প্রতি মাসে গড়ে ৫০ কোটি টাকা আয় করে, যার বড় অংশ অর্ধ-বার্ষিক সুদ পরিশোধে ব্যবহৃত হয়। বেক্সিমকো পরিচালনা ব্যয়ের জন্য ৭ কোটি টাকা পায়, আর বাকি অর্থ সুকুকের ‘সিংকিং ফান্ডে’ জমা হয়, যা বর্তমানে ১৭৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
গভীর হচ্ছে বেক্সিমকোর আর্থিক সংকট ॥
বেক্সিমকো গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান একাধিক মামলায় কারাবন্দি। প্রতিষ্ঠানটির ঋণগ্রস্ত ব্যবসাগুলো বর্তমানে চরম সংকটে পড়েছে। সাভারের বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি কারখানা শ্রমিকদের বেতন ও ভাতা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। শ্রম মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত ১৪টি ইউনিটের শ্রমিকদের বকেয়া মেটাতে ৫২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকার চেক দিয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ ও এসপিভির ভূমিকা ॥ ‘বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক আল ইস্তিসনা’-এর পাঁচ হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও মিউচুয়াল ফান্ড। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের (আইসিবি) ট্রাস্টি পরিচালিত একটি স্পেশাল পারপাস ভেহিকল (এসপিভি) গঠন করা হয়।

একজন আইসিবি কর্মকর্তা জানান, সোলার পার্কের আয় থেকে বিনিয়োগকারীদের সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে। আগে সিংকিং ফান্ডে মাত্র পাঁচ কোটি টাকা জমা হতো। তবে গত আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর এটি বাড়ানো হয়েছে। বেক্সিমকোর চলমান ঋণ সংকটের মধ্যে কীভাবে সুকুকের মূল অর্থ পরিশোধ করা হবে তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি সতর্ক করে বলেন, পরিশোধে ব্যর্থতা বিনিয়োগকারীদের আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা দেশের প্রথম সবুজ সুকুকের জন্যও অশনিসংকেত। এসপিভি‘র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বোর্ড সদস্য স্বীকার করেন, বেক্সিমকোর সংকটের কারণে মূলধন পরিশোধে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। তবে তিনি জানান, প্রয়োজনে এসপিভির নিয়ন্ত্রণে থাকা সব সম্পদ বিক্রি করা হতে পারে। পাশাপাশি, বিকল্প সমাধান হিসেবে সুকুকের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে।
আইসিবি চেয়ারম্যান ও এসপিভি গভর্নিং বোর্ডের সভাপতি আবু আহমেদ জানান, সুকুক পরিচালনা, বিনিয়োগকারীদের রিটার্ন প্রদান এবং সিংকিং ফান্ড ব্যবস্থাপনায় আইসিবি কাজ করছে। সিংকিং ফান্ডের পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান। তবে ট্রাস্টি দলিল অনুযায়ী, যদি ট্রাস্টি ইচ্ছাকৃত অবহেলা বা গাফিলতির কারণে চূড়ান্ত পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এর দায়ভার সুকুকহোল্ডারদের ওপর বর্তাবে।
মূলধন সংগ্রহ ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা ॥
মূলধন সংগ্রহ ও বিনিয়োগ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২১ সালে বেক্সিমকো গ্রিন সুকুকের মাধ্যমে তিন হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে বেক্সিমকো লিমিটেড। এর মধ্যে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা আসে ব্যক্তিগত উৎস থেকে, ৭৫০ কোটি টাকা বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে এবং বাকি ৭৫০ কোটি টাকা আইপিওর মাধ্যমে তোলা হয়।
বেক্সিমকো গ্রিন সুকুকের ১০০ শতাংশ শেয়ারে রূপান্তরের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ২০২৪ সালের মধ্যে ১৯০ কোটি টাকা মূল্যমানের ১ কোটি ৯০ লাখ ইউনিট শেয়ারে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে যদি আর কোনো রূপান্তর না হয়, তাহলে অবশিষ্ট দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে পরিশোধ করতে হবে।

সুকুকের মূলধন পরিশোধের পরিকল্পনায় তিনটি প্রকল্প থেকে আয় ব্যবহারের কথা ছিল দুটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র ও একটি টেক্সটাইল সম্প্রসারণ প্রকল্প। তবে বর্তমানে শুধু তিস্তা সোলার লিমিটেড চালু রয়েছে, যা জাতীয় গ্রিডে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
করতোয়া সোলার লিমিটেড এখনো চালু হয়নি, আর বেক্সিমকোর টেক্সটাইল সম্প্রসারণ প্রকল্প, যার জন্য ৮০০ কোটি টাকা প্রয়োজন, সরকার পরিবর্তনের পর জটিলতার কারণে স্থগিত হয়ে গেছে। ফলে সুকুক-অর্থায়িত প্রকল্পগুলোর মধ্যে কার্যকর রয়েছে কেবল তিস্তা সোলার লিমিটেড।
তিস্তা প্রকল্পের আয় ব্যবস্থাপনা করছে আইসিবি ॥ গাইবান্ধায় বেক্সিমকোর সোলার পার্ক প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা ০.১৫ ডলারে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বিক্রি করছে। সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন (আইসিবি) প্রকল্পটির সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয়। বর্তমানে এটির আয় থেকে ৯ শতাংশ হারে বিনিয়োগকারীদের সুদের অর্ধেক পরিশোধ করা হচ্ছে।

সোলার পার্ক পরিচালনার জন্য প্রতি মাসে সাত কোটি টাকা ব্যয় হয়, আর অবশিষ্ট অর্থ সুকুকের পরিশোধ নিশ্চিত করতে সিংকিং ফান্ডে জমা করা হয়। ট্রাস্টি দলিল অনুযায়ী, ক্রয় চুক্তি সম্পন্ন ও এক্সারসাইজ মূল্য পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা তহবিলে জমা রাখতে হবে, যা কনভার্সন অপশনের ভিত্তিতে বার্ষিক সমন্বয় করা হয়। বেক্সিমকোর চলমান সংকটের কারণে তহবিলে জমার পরিমাণ বেড়েছে এবং বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিপ্ট হিসেবে ১৭৮ কোটি টাকা সংরক্ষিত আছে।
আইসিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তিস্তা প্রকল্পের আয় পুরোপুরি বিনিয়োগকারীদের পরিশোধের জন্য যথেষ্ট নয়। তবে মেয়াদ বাড়ানো হলে ধাপে ধাপে পরিশোধ সম্ভব হতে পারে। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকলে নির্ধারিত সময়ে সুকুকের সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করা কঠিন হবে।
তিস্তা প্রকল্পের আয় ও বিনিয়োগকারীদের পরিশোধ ॥ তিস্তা সোলার পার্ক ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চালু হয় এবং ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এটি প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা আয় করেছে। এর মধ্যে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পটির মোট আয় হয়েছে ৯২৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। এরপর, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরও ২৭৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আয় হয়েছে।

তবে ছয় মাস ধরে আইসিবি বিপিডিবির কাছ থেকে কোনো অর্থ পায়নি, যদিও পর্যায়ক্রমে পরিশোধের প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। অর্ধ-বার্ষিক সুদের পরবর্তী কিস্তি আগামী জুলাই মাসে পরিশোধ করা হবে। এই প্রকল্প থেকে বিনিয়োগকারীদের সুদ হিসেবে ৫৫৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, আর ১৭৮ কোটি টাকা সিংকিং ফান্ডে জমা হয়েছে। অবশিষ্ট অর্থ বেক্সিমকো নিয়েছে। তবে সরকার পরিবর্তনের পর আইসিবি প্রকল্পের প্রশাসনিক ব্যয়ের জন্য মাত্র সাত কোটি টাকা বরাদ্দ করছে।

×