
মৌসুমের প্রথম ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে বুধবার কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগর ছিল উত্তাল
পূর্বাভাস থাকলেও শেষ পর্যন্ত আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে জোড়া ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে না। প্রবল বৃষ্টির কারণে সৃষ্টির আগেই দুর্বল হয়ে পড়েছে আরব সাগরের সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি। ফলে মৌসুমের প্রথম ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে মঙ্গলবার উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। একই এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। এটি আরও ঘনীভূত হতে পারে। এতে এই লঘুচাপটি একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত পারে। সে আশঙ্কায় কক্সবাজারসহ দেশের চারটি সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত জারি করা হয়েছে।
এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কারণ হিসাবে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগর সিস্টেম থেকে পূর্ব উপকূলে কোনো ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ২৭ মে হতে নি¤œচাপ আকার ধারণ করে শক্তি সঞ্চয় শুরু করেছে। ২৮ মে এটি সুষ্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়ে ক্রমশ ঘূর্ণিঝড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে এর নাম হবে শক্তি। সেক্ষেত্রে এটি আগামী ৩০ মে উপকূলে আঘাত করবে। এখন পর্যন্ত এর গতিপথ নির্দিষ্ট না হলেও, আন্তর্জাতিক মডেলের পূর্বাভাস অনুযায়ী এটি প্রথমে ওড়িশার ভদ্রকের দিকে এগোতে পারে। এরপর গতিপথ একাধিকবার পরিবর্তন করে এটি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মংলা এবং খেপুপাড়ার দিকে যেতে পারে। এবং খেপুপাড়া দিয়েই এটি ভূমিভাগে প্রবেশ করতে পারে।
এক্ষেত্রে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে প্রবল বৃষ্টি। এই লঘুচাপ সৃষ্টির প্রভাবে বৃহস্পতিবার থেকেই প্রবল বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। বিশেষ করে শক্তিশালী লঘুচাপের প্রভাবে ২৯, ৩০, ও ৩১ শে মে বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে রেকর্ড-ব্রেকিং পরিমাণে বৃষ্টির প্রবল আশঙ্কা করা যাচ্ছে। এই তিন দিনে বাংলাদেশ ও ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে ৫০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টির আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
অতিভারি বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে আগাম প্রস্তুতির ওপর জোর দিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, ২৩ মে পর্যন্ত জিএফএসসহ পাঁচটি আন্তর্জাতিক মডেল প্রায় একই সঙ্গে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে জোড়া ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছিল। কিন্তু আরব সাগর লাগোয়া ভারতের রাজ্যগুলোতে লাগাতার তুমুল বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত আর এই জোড়া ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে না।
২৩ মে পর্যন্ত জিএফএসসহ পাঁচটি আন্তর্জাতিক মডেল দেশের দুই প্রান্তে জোড়া ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছিল। কিন্তু ২৪ মে এসে দুটি মার্কিন এবং একটি জার্মান আবহাওয়া গবেষণা মডেল দাবি করেছে ঘূর্ণিঝড় দানা বাঁধার আগেই লাগাতার তোলপাড় করা বৃষ্টিতে অভ্যন্তরীণ শক্তিক্ষয় হচ্ছে। ফলে খুব সম্ভবত আরব সাগরে আলাদা করে আর ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে না। এতে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ প্রক্রিয়া অনুয়ায়ী থাইল্যান্ডের দেওয়া নাম মন্থা আরব সাগরের ওই সিস্টেমে ব্যবহার করার প্রয়োজনও হচ্ছে না।
তবে বঙ্গোপসাগরের সিস্টেম সক্রিয় থাকায় একটি লঘুচাপ এবং লঘুচাপ থেকে সুষ্পষ্ট লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিম মধ্য এবং উত্তর বঙ্গোপসাগর জুড়ে এই লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ায় ২৮ মে এটি শক্তিশালী নি¤œচাপে পরিণত হয়ে ৩০ মের মধ্যে আরও আরও শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে।
আরব সাগরের ঘূর্ণিঝড় মিলিয়ে গেলেও বঙ্গোপাসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কারণ হিসাবে আন্তর্জাতিক আবহাওয়া মডেলের পূর্বাভাস বলছে, আগাম প্রবল বর্ষণ হতে থাকলেই সিস্টেম ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের এই সিস্টেম এখন পর্যন্ত দেশের পূর্ব দিকের কোনো উপকূলে উল্লেখযোগ্য কোনো বৃষ্টিপাত ঘটায়নি। অর্থাৎ চক্রবৎ এই সিস্টেম থেকে কোনোকিছুই এখনও পর্যন্ত স্থলভাগের দিকে এগিয়ে আসেনি। অর্থাৎ এক জায়গায় থিতু হয়ে শক্তি সঞ্চয়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের এই সিস্টেমটির মধ্যে।
বিভিন্ন মডেল এখনও পর্যন্ত যা জানাচ্ছে তাতে দেখা যায়, ২৭ তারিখে নি¤œচাপ সৃষ্টি থেকেই এটি শক্তি সঞ্চয় করবে। ২৮ ও ২৯ আরও শক্তি বৃদ্ধি করবে। ফরমেশন সম্পূর্ণ হলে প্রাথমিকভাবে এটি উত্তর-উত্তর পশ্চিম অর্থাৎ ওড়িশার ভদ্রকের দিকে এগোবে। এরপর গতিপথ একাধিকবার পরিবর্তন করে এটি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মংলা এবং ক্ষেপুপাড়ার দিকে যাবে। ওই দিক দিয়েই এটি স্থলভাগে প্রবেশ করবে। এটি পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপ, কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবারকে সমান্তরালভাবে অতিক্রম করতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ের আকার নিলে এটির নামকরণ হতে পারে শক্তি। এই নামটি শ্রীলঙ্কার দেওয়া। আরব সাগরে আপাতত কোন ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি না হওয়ায় পূর্বতন নাম মন্থা আপাতত নামের ক্রমতালিকায় রিজার্ভ থাকছে।
এদিকে মাসের শুরুতে দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে আবহাওয়া দপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চলতি মাসের শেষ দিকে সাগরে একটি নি¤œচাপ হতে পারে। এ থেকে একটি ঘূর্ণিঝড়ও সৃষ্টি হতে পারে।
ভারি বৃষ্টির শঙ্কা ॥ বাংলাদেশ আবহাওয়া অফিস বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সুস্পষ্ট লঘুচাপের প্রভাব থেকেই দেশের ৬ বিভাগে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টির আভাস দিয়েছে। এসব এলাকায় ১৮৮ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর কোথাও কোথাও অস্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে।
এই অতিভারি বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।
অপরদিকে, কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ এক ফেসবুক পোস্টে জানান, লঘুচাপের প্রভাবে রংপুর, ময়মনিসংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলো আগামী ২৯, ৩০, ও ৩১ মে রেকর্ড- ব্রেকিং পরিমাণে বৃষ্টির প্রবল আশঙ্কা করা যাচ্ছে। এই তিন দিনে বাংলাদেশের ও ভারতের আসাম, ও মেঘালয় রাজ্যের ওপরে ৫০০ মিলিমিটার এর বেশি পরিমাণে বৃষ্টির আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ভারি বৃষ্টিপাত কোন বিভাগে বেশি হবে তা নির্ভর করতেছে লঘুচাপটি ঠিক উপকূলের কোন স্থানের ওপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে ও ঠিক কত ধীরে স্থলভাগের ওপর দিয়ে অতিক্রম করবে। যদি খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে প্রবেশ করে তবে ভারি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রংপুর বিভাগ ও ময়মনিসংহ বিভাগের জেলাগুলোতে। যদি বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের ওপর দিয়ে প্রবেশ করে তবে ভারি ভারি বৃষ্টি হবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতে।
এর আগে ১৯ মে (বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা) তৃতীয় পূর্বাভাসের তিনি নিশ্চিত করেছিলেন বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রবল আশঙ্কা তৈরি হয়েছে মে মাসের ২৭ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের ওড়িশা উপকূল ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপকূলের মধ্যবর্তী যে কোনো স্থানের ওপর দিয়ে স্থলভাগে আঘাত করার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
ফলে, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যে যে সাগরে ২০২৫ সালের ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের প্রথম ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টি হবে তার নাম হবে শক্তি ও দ্বিতীয়টির নাম হবে মন্থা। শক্তি নামটি শ্রীলংকার দেওয়া এবং মন্থা নামটি থাইল্যান্ডের।
তবে আরব সাগরের ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনা কেটে যাওয়ায় এবছর ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের প্রথম ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। আর এটি সৃষ্টি হলে শক্তি নামেই এটি উপকূলে আঘাত করবে। তবে কতটা শক্তি নিয়ে এবং কিভাবে কত সময় নিয়ে আঘাত করবে তা নির্ভর করবে শক্তি সঞ্চয় ও ওই সময়কার পরিবেশের ওপর।
পলাশ আরও জানিয়েছিলেন, বঙ্গোপসাগরে যে ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টির আশঙ্কা করা যাচ্ছে সেটি কোন উপকূলে আঘাত হানবে এবং কতটা শক্তিশালী হবে তা নির্ভর করছে আরব সাগরে যে ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে তার ওপরে। যেহেতু আরব সাগরে ঘুর্ণিঝড় সৃিষ্ট হচ্ছে না, তাই বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়টি বেশি শক্তিশালী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।