ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

আশ্রয়ণের ঘর থেকে আরিফার ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রকাশিত: ০০:৩৯, ১৫ মে ২০২৪

আশ্রয়ণের ঘর থেকে আরিফার ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প

ফুটবল খেলে পাওয়া পুরস্কারের ওপর মায়ের হাত, পাশে ফুটবলার আরিফা আক্তার

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে থেকে বড় হয়েছেন সাফজয়ী নারী ফুটবলার আরিফা আক্তার। অভাবের সংসারে দুবেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা দায় তাদের। সহায় সম্বল বলতে ফুটবল খেলে পাওয়া শতাধিক পদক। তিন বোন আর বাবা-মা থাকলেও এক টুকরো স্বর্ণের গহনাও পরা হয়নি আরিফার। আলমারি ভর্তি কেবল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের পদক। এই পদকই আরিফার মায়ের কাছে এখন সোনার চেয়েও দামি।

আরিফা আক্তারের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রুপসদী গ্রামে। নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে নারী অনূর্ধ্ব-১৬ শিরোপাজয়ী দলের গর্বিত সদস্য আরিফা।
সরেজমিনে আরিফার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে বসবাস গোটা পরিবারের। ঘরের ভেতরে আসবাবপত্র বলতে নেই তেমন কিছু। একটি আলমারির ভেতর থরে-থরে সাজানো শুধু পদক আর পদক। কথা হয় তার আরিফার মা আলেয়া বেগমের সঙ্গে। আঞ্চলিক ভাষায় তিনি জনকণ্ঠের প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার মেয়ে আরিফারে বহুত কষ্টের পর এই জায়গায় আনছি।

খাওন (খাবার) জুটত না অনেক সময়। তবে মেয়ের প্রতিভারে খাটো কইরা দেখি নাই। ফুটবলের প্রতি তার আগ্রহ দেইখা ভাবছিলাম যত কষ্টই হোক মেয়েরে ইচ্ছা পূরণ করমু। আইজ আমার মাইয়া দক্ষিণ এশিয়া জয় করছে। দেশরে সবার সামনে তুইলা ধরছে, এর চাইতে বড় কিছু আর হইতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংসারে আয় রোজগার খুবই কম।

আমার মাইয়া যে পদক আনছে ঐ গুলার দিকেই দিন-রাইত চাইয়া থাকি। অনেক ধনী মাইনষের ঘরেও তো এত পদক নাই। এই গুলা আমার মাইয়ার অর্জন। সোনা-দানা না থাকলেও আমার আফসোস নাই। পদক গুলাই আমার আর আমার মাইয়ার গয়না (অলংকার)।’
আলাপের ফাঁকে বাড়িতে হঠাৎ অটোরিক্সা নিয়ে হাজির এক লোক।

জানা গেল তিনিই আরিফার বাবা জিতু মিয়া। সংসারের একমাত্র রোজগারের মানুষ। সামনে এগিয়ে যেতেই হাসিমুখে বলে উঠেন, আমার মাইয়ার জন্য বাইত সাংবাদিক আইছে, কি সৌভাগ্য আমার। কথা প্রসঙ্গে ওঠে মেয়ের ফুটবল খেলার শুরুটা নিয়ে। তিনি বলেন, ‘প্রথমে তো অনেক অনেক কথা কইত, মাইয়ারে কেন ফুটবল খেলায় দিলাম, এসব বালা না।

নানান কথা শুনাইছে মানুষ, কিন্তু গায়ে মাখি নাই। আমার অটোরিক্সা দিয়াই ওরে কোচিংয়ে আনা নেওয়া করছি। খুব আনন্দ লাগত। মেয়ের এমন অর্জন সম্পর্কে বাবা জিতু মিয়া বলেন, ‘আমার মাইয়ারে এহন টিভিতে দেহা যায়, পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়। দেশের সুনাম আনছে সে। এহন সবাই আমারে বাহবা দেয়। এলাকার মানুষ আমারে সম্মান দেয় মাইয়ার জন্য।

প্রশাসনের লোকেরা আমারে আলাদা নজরে দেখে। দিন বদলাইছে অনেক, সবার পোলা-মাইয়ারেই আগ্রহ অনুযায়ী দেওয়া উচিত যেই দিকে যাইতে চায়।’ আরিফার কোচ মীর রফিকুল ইসলাম বলেন, ছোট থেকেই আরিফার খেলা নজর কাড়ে। ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম ফুটবল ক্লাবে তাকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি।

এখান থেকেই তার বেড়ে ওঠা। আমি তাকে আমার মেয়ের মতো দেখি। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সে উপজেলা, জেলা, বিভাগে বেশ ভালো খেলতে। শিরোপা এনে দেয় আমাদের, নিজের শ্রেষ্ঠত্বে জাতীয় বয়সভিত্তিকক সাফ ডাক পায়। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি আরিফাকে। আরিফার প্রতিবেশী আবু নাইম বলেন, আরিফার জন্য আমরাও গর্বিত। আমাদের এলাকার মেয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনছে।

পরিশ্রমের ফল পাচ্ছে এখন। আরিফার বাবা-মা সার্থক। প্রশাসন যদি তাদের পরিবারের দিকে একটু নজর দেয়, সহযোগিতা করে তাহলে আরও ভবিষ্যতে ভালো করবে আরিফা।
সবশেষ কথা হয় আরিফার সঙ্গে। সদ্য সাফজয়ী এই ফুটবলার হাসিমুখে বলেন, আমার পরিবার এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন, যার কারণে এতদূর আসতে পেরেছি। ফুটবলে অনেক সময় দিয়েছি, অনেক পরিশ্রম করেছি। জানিনা কতটুকু পেরেছি তবে চেষ্টার ঘাটতি রাখছি না। আগামীতে নারী জাতীয় দলে খেলতে চাই। এ লক্ষ্যে নিজেকে তৈরি করছি।

×