
ছবি: সংগৃহীত
সুইডিশ প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান সাআব (Saab) ও ইউরোপীয় এআই কোম্পানি হেলসিং-এর যৌথ উদ্যোগে ২০২৫ সালের মে ২৮ থেকে জুন ৩ পর্যন্ত বল্টিক সাগরের দূরবর্তী পরীক্ষামূলক রেঞ্জে অনুষ্ঠিত পরীক্ষামূলক বিমানচালনায় নতুন এক যুগের সূচনা হলো। সেখানে সাআবের গ্রিপেন ই যুদ্ধবিমানটি কেবল মানব চালকের নিয়ন্ত্রণেই নয়, বরং স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তা সেন্টর-এর (Centaur) নির্দেশনায় জটিল যুদ্ধকৌশল সম্পাদন করলো, যা ভবিষ্যতের সামরিক বিমান চালনার দিগন্ত বদলে দিচ্ছে।
স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধ: ভবিষ্যতের আকাশে যুদ্ধের রূপান্তর
সাআবের ‘প্রজেক্ট বিয়ন্ড’ উদ্যোগের অংশ এই পরীক্ষা দেখিয়েছে, কীভাবে সেন্টর (Centaur) এআই যুদ্ধবিমানের দূরপাল্লার (Beyond Visual Range–BVR) যুদ্ধ কৌশল সম্পাদনে সক্ষম। সাআবের এই অগ্রগামী প্রযুক্তি উন্নয়ন স্বিডেনের প্রতিরক্ষা সামগ্রী প্রশাসন (FMV) এর আর্থিক সহায়তায় সম্ভব হয়েছে এবং এটি সামরিক প্রযুক্তিতে সুইডিশ প্রতিষ্ঠানের আধুনিকতার প্রতিচ্ছবি।
গ্রিপেন ই: এক যুগান্তকারী যুদ্ধবিমান
১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সাআব দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বমানের যুদ্ধবিমান ডিজাইন ও উৎপাদনে বিশেষজ্ঞ। লিঙ্কোপিংভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান ‘গ্রিপেন ই’ (JAS 39E) নামে এক একক-ইঞ্জিন, বহু-ভূমিকা সম্পন্ন যুদ্ধবিমান তৈরি করেছে, যা অত্যাধুনিক অ্যাভিওনিক্স এবং মডুলার সফটওয়্যার আর্কিটেকচারের জন্য পরিচিত। এর ফলে সফটওয়্যার দ্রুত হালনাগাদ ও উন্নত করা সম্ভব হয়।
সাম্প্রতিক পরীক্ষাগুলোতে দেখা গেছে, এই যুদ্ধবিমানটি নির্দিষ্ট পরীক্ষামূলক বিমান বা সীমাবদ্ধ সামরিক রেঞ্জ ছাড়াই, সরাসরি স্বাভাবিক পরিবেশে নতুন এআই সিস্টেম ইন্টিগ্রেট করতে সক্ষম। ফলে এটি বিশ্ববাজারে দ্রুত পরিবর্তিত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এক গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
আকাশে আধিপত্যের লড়াইয়ে নতুন দিগন্ত
বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপ থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যেই এআই প্রযুক্তির অবদান ক্রমশ বেড়েই চলছে। গ্রিপেন ই’র মতো এআই সংযুক্ত যুদ্ধবিমান দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ, উচ্চমাত্রার নির্ভুলতা এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কার্যকারিতা নিশ্চিত করে।
সাআবের এ্যারোনটিকস বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তা পিটার নিলসন জানান, ‘এটি আমাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এক মাইলফলক, যেখানে আমরা আকাশে এআই কার্যকরভাবে প্রয়োগ করেছি। সফটওয়্যার আপডেটে গ্রিপেন ই তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় বেশ এগিয়ে।’
প্রযুক্তির বিবরণ
গ্রিপেন ই প্রায় ১৫.২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৮.৬ মিটার প্রস্থের, একটি জেনারেল ইলেকট্রিক F414G ইঞ্জিন দ্বারা চালিত, যা মাখ ২ গতি অর্জন করতে সক্ষম। এটি উন্নত AESA রাডার ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমসহ সজ্জিত। পূর্বের মডেলগুলোর থেকে এই মডেলে রয়েছে উন্নত নেটওয়ার্কিং সুবিধা, যা অন্য প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ডেটা বিনিময় করে দ্রুত যুদ্ধ পরিস্থিতির সাড়া দেয়। ওপেন-আর্কিটেকচার সফটওয়্যার নতুন প্রযুক্তি সংযোজন সহজ করে তোলে, যেমন এই পরীক্ষায় সেন্টর এআই।
সেন্টর এআই: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুদ্ধ মস্তিষ্ক
জার্মানির মিউনিখে প্রতিষ্ঠিত হেলসিং ২০২১ থেকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তিতে অগ্রণী। তাদের তৈরি সেন্টর এআই যুদ্ধের সময় বাস্তব-সময়ে প্রচুর সেন্সর ডেটা প্রক্রিয়াকরণ করে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই এআই বায়ুসেনার স্বায়ত্তশাসিত লড়াইয়ের জন্য গ্রিপেন ই’র অনন্য সহযোগী।
পরীক্ষামূলক বিমানচালনার প্রধান দিক
প্রথম ফ্লাইটে (২৮ মে) সেন্টর সফলভাবে বিমানের জটিল যুদ্ধকৌশল সম্পাদন ও অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয়। পরবর্তীতে ৩ জুন পর্যন্ত নানা ধরনের স্বায়ত্তশাসিত BVR লড়াই পরীক্ষা করা হয়।
গ্রিপেন ডি, যদিও নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম, কিন্তু আধুনিক সফটওয়্যার ক্ষমতা গ্রিপেন ই’র তুলনায় কম। সেন্টর এআই সেন্সর ডেটার ভিত্তিতে লক্ষ্যমাত্রা সনাক্তকরণ, পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি মোকাবিলা ও যোগাযোগ লিঙ্ক বিঘ্নিত হলেও কার্যকারিতা বজায় রাখতে সক্ষমতা প্রদর্শন করে।
সুইডেনের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে ভবিষ্যত বিনিয়োগ
প্রজেক্ট বিয়ন্ড সুইডেনের FMV’র সমর্থনে চলমান, যার লক্ষ্য আগামী দশকের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আধুনিক যুদ্ধযন্ত্র তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়া। গ্রিপেন ই’র খরচ সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে এটি ছোট ও মধ্যম আকারের বিমানবাহিনীর কাছে আকর্ষণীয়, যেখানে উচ্চমূল্যের F-35 এর বিকল্প হিসাবে দেখা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী আমেরিকা, রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশও এআই ও স্বায়ত্তশাসিত যুদ্ধবিমান প্রযুক্তি দ্রুত উন্নয়ন করছে। সাআবের এই সাফল্য তাদেরকে এ খাতে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে আলাদা স্থানে নিয়ে গেছে।
নিরাপত্তা, নীতিমালা ও ভবিষ্যৎ ভাবনা
এআই পরিচালিত যুদ্ধবিমানের নিরাপত্তা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও নৈতিকতা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নানা বিতর্ক ও আলোচনা চলছে। সাআব ও হেলসিং জোর দিয়ে বলেছেন, সেন্টর সবসময় মানব চালকের তত্ত্বাবধানে কাজ করে, তবে পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধ পরিচালনার বিষয়টি বিতর্কিত।
২০২৫ সালে আরও পরীক্ষা চালিয়ে এআই-এর কার্যকারিতা উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ও নজরদারিতে এআই ব্যবহার বৃদ্ধি করা হবে। সাআবের লক্ষ্য শুধু দেশীয় চাহিদা নয়, বিশ্ববাজারে প্রযুক্তির প্রভাব বিস্তার।
সূত্র: https://bulgarianmilitary.com/2025/06/11/gripen-es-ai-revolution-unleashed-in-stunning-combat-maneuvers/
রাকিব