
সব আসনেই ঘোষিত ও বিদ্রোহী থাকবে বিএনপির
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য ভোটের রোডম্যাপ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভোট হচ্ছে। এরই মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে পর্দার আড়ালে বড় দলে শুরু হয়েছে জটিলতা। ঢাকায় মধু-শীতল সম্পর্ক থাকলেও তৃণমূলে চলছে তীর আক্রমণ। দেড় যুগেরও বেশি সময় ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে ১৯টি দলের সমমনা জোটসহ আরও অনেকেই একই উদ্দেশ্যে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করছেন।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনূস সরকারকে দ্রুত ভোটের আয়োজনে চাপ অব্যাহত রেখেছিল দলটির সমমনা জোট। সম্প্রতি আসন নিয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে ঢাকায় দফায় দফায় বৈঠক হলেও তৃণমূলে তা বিষরূপে কাজ করছে। যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘ সময় বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের তৃণমূলে ভোটের প্রচারাভিযানে সহায়তা করতে কেন্দ্র থেকে একটি চিঠি দিলেও তৃণমূলের কেউ তা মানছে না।
বিএনপির বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, ঢাকার কয়েকটি আসনে জোট নেতাদের ছাড় দেওয়ার বিষয়ে বিএনপি শীতল চাপ অনুভব করলেও ঢাকার বাইরে থেকে আসছে শক্ত প্রতিক্রিয়া। যারা মাঠ পর্যায়ে বছরের পর বছর নির্যাতিত হয়েছে, জনপ্রিয়তা রয়েছে তারা কেউ জোটের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন না বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রয়োজনে তারা বিদ্রোহী হয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করারও ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে জোটের কয়েকজন প্রার্থীর প্রচারে হামলার ঘটনায় হাইকমান্ডকে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
সবার অংশ গ্রহণে হাসিনা ছাড়া নির্বাচন উৎসবমুখর করতে চেষ্টা করলেও বিএনপিকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে জোটের প্রার্থী থাকলেও সব আসনেই দলটির প্রার্থী থাকবে। বিদ্রোহীশূন্য থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। ইতিমধ্যে হামলা বাধা এবং অনেকে বিএনপির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে একক নির্বাচনেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন যা বিএনপির জন্য অস্বস্তির।
নাম প্রকাশে অনিশ্চুক বিএনপির হাইকমান্ডের এক নেতা জানান, সম্প্রতি জোটের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতার সঙ্গে বিএনপির হাইকমান্ডের বৈঠক হয়েছে। ঢাকার কয়েকটি আসন নিয়ে বিএনপি আপাতত চিন্তামুক্ত রয়েছেন। তবে তৃণমূলে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সবশেষ নাগরিক ঐক্যর সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার বগুড়া-২ আসন নিয়ে দলীয় প্রার্থীকে ছাড় দিয়ে প্রচারাভিযানে থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তৃণমূল সেটি কোনোভাবেই গ্রহণ করছেন না। সহযোগিতাও করছে না।
এমন পরিস্থিতে সম্প্রতি মাহমুদুর রহমান মান্না ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপিকে জানিয়ে আসেন তিনি আর ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবেন না। তার দলের প্রতীক নিয়ে তিনি আগামী নির্বাচন করবেন। হেরে গেলেও তিনি আফসোস করবেন না। একই সঙ্গে সিনিয়র রাজনীতিবিদ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবের কেন্দ্রেও অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির সঙ্গে হাসিনার পতনের আন্দোলনে অন্যতম সহযোগী গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের প্রচারে বাধার ঘটনা ঘটেছে।
এ নিয়ে নির্বাচন পূর্ব মুহূর্তে অনেক নাটকীয়তার অপেক্ষা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবারের ভোটে মাঠ পর্যায়ের কেউ বিএনপির জোট প্রার্থীকে সহযোগিতা করবে না এটা অনেকটাই স্পষ্ট বার্তা রয়েছে হাইকমান্ডের কাছে। বড় অংশই ঢাকার নির্দেশনা উপেক্ষা করবে, থাকবে ভোটের মাঠে।
দলীয় সূত্র জানায়, টেস্ট কেস হিসেবে জোটের ছয় নেতার পক্ষে কাজ করতে কয়েকমাস আগে তৃণমূলে চিঠি পাঠায় বিএনপি। তারা হলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-২, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ঢাকা-১২, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর পটুয়াখালী-৩, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ঝিনাইদহ-২ এবং জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাকে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি চিঠিতে ওই সব আসনের থানা-উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির নেতাকর্মীকে জোট নেতাদের সহায়তা করতে বলা হয়েছে।
এসব চিঠির বাইরে ১২ দলীয় জোট নেতা ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমকে মৌখিকভাবে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে কাজ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ওই এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীকে এ বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। জোট নেতারা জানান, এসব চিঠির মাধ্যমে তারা যাতে প্রতিবন্ধকতা ছাড়া কাজ করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগের মতো কর্মসূচি, কর্মিসভা, সাংগঠনিক সভা যাতে নির্বিঘেœ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এর কোনো নির্দেশনাই বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে কার্যকারিতা নেই। শুধু এ ছয়টি নয় বিএনপি অন্তত ২০টি আসনে জোট নেতাদের ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনায় রয়েছেন। সেগুলো হলো লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), জাকের পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণফোরাম, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংসদে আসনের নিশ্চয়তা পেলে বিএনপির সঙ্গে জোটে যাবে। এ ছাড়া সংসদীয় আসন ভাগাভাগিতে হিসাব মিললে মজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন এবি পার্টিও শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ নিয়ে নাগরিক ঐক্যের শীর্ষ এক নেতা জনকণ্ঠকে জানান, তাদের দলের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের নেতা হিসেবে বগুড়া থেকে নির্বাচন করেছিলেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্যরা জোটগত নির্বাচনে অংশ নিলে এই আসন থেকেই মান্না নির্বাচন করতেন। আগামীতেও তিনি এই আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি রেখেছিলেন।
কিন্তু তিনি সম্প্রতি বিএনপিকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন আগামী নির্বাচনে তিনি ধানের শীষ প্রতীকে আর নির্বাচন করবেন না। তিনি তার দলের প্রতীকে নির্বাচন করবেন। মাঠ পর্যায় থেকে মান্নাকে সাহায্যের কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি বরং নাগরিক ঐক্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মামলা দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে সম্প্রতি বিএনপির হাইকমান্ডে মাহমুদুর রহমান মান্না ক্ষোভ প্রকাশ করে এসেছেন।
একই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সমমনা জোটের অন্যদেরও পটুয়াখালীর গলাচিপায় বাংলাদেশ গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের ওপর অতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটেছে। এক পর্যায়ে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে এককভাবে ৩০০ আসনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া আ স ম আব্দুর রবের আসনেও প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
বিএনপির নীতি নির্ধারণী এক নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকার নীতি নির্ধারণী ফোরামের সঙ্গে সমমনা জোটের নেতাদের এখনো ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তবে তৃণমূলে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে আসনভিত্তিক নির্যাতিত নেতারা কেউ ছাড় দিতে নারাজ। এই নেতা বলেন, যারা দীর্ঘ সময় বিএনপির সঙ্গে স্বৈরাচার পতনে রাজপথে ছিলেন তাদের মূল্যয়নে হাইকমান্ড আগ্রহী। কিন্তু ভিলেজ পলিটিক্সে অনেকেটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। অবশ্যই তারেক রহমান যে কোনোভাবে তাদের মূল্যয়ন করবেন।
এ নিয়ে সমমনা জোটের এক শীর্ষ নেতা বলেন, হাসিনা পতনের পর বিএনপির ঢাকার নেতারা মধুর সম্পর্ক রাখলকেও তৃণমূল সম্পূর্ণ বিপরীত। বিএনপি যদি এককভাবে নির্বাচনের পথে হাঁটে তাহলে ভোটের আগে অন্তত তিনটা জোট তৈরি হতে পারে। একটা জোট বিএনপি ও বামদের নিয়ে, আরেকটা সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের জোট, আরেকটা ইসলামী জোট। এ তিন জোট নিয়েই ভোট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ বড় দল হিসেবে বিএনপির তৃণমূলকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্ট হয়ে যাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনে জোট প্রক্তিয়া এখনো অনেকদূর। অবশ্যই দল জোটের জন্য হাইকমান্ড ভালো সিদ্ধান্ত দেবেন। অনেক খবরই ভিত্তিহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে অভিযোগ এই নেত্রীর। নাগরিক সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না জনকন্ঠকে বলেন, একজন রাজনীতিবিদের জন্য নির্বাচন অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জিতে আসতে হবে সেটাই বড় কথা নয়। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই স্পষ্ট হবে। এখন আগাম আর কিছু বলতে চাই না।