
পলক
দেশের তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের অন্যতম মাফিয়া সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। আওয়ামী সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে লোপাট করেছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তার নাম ভাঙিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে।
শুধু পলক নয়, হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকাও। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, আমেরিকায় গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। টিউশনির টাকায় পলকের স্ত্রী গড়েছেন ১৮ টি ফ্ল্যাট ও হাজার কোটি টাকার মালিক। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, এ টু আই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইটেক পার্ক, আইটি পার্ক তৈরির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন পলক।
সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলককে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশের তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
নির্বাচনী হলফনামায় লেখেন ১৫ শতক কৃষিজমি, ব্যাংকে ৫০ হাজার টাকা এবং ৬০ হাজার টাকার আসবাবপত্র রয়েছে তার। এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে করেন নির্বাচন। এর পর তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী হয়ে আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা। তাই জয়ের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পান পলক।
সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে হয়ে ওঠেন স্বেচ্ছাচারী। ২০০৮ সালে নাটোরের সিংড়া উপজেলা থেকে জুনাইদ আহমেদ পলক প্রথমবার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের পর পলকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও জয়ের সুপারিশে সব অভিযোগ থেকে বেঁচে যান তিনি। ফলে তিন মেয়াদে অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর চেয়ার বদল হলেও পলক একই পদে থেকে যান।
দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেন পলক। তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নের নামে একের পর এক প্রকল্প বানিয়ে বাজেট থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেন। সজীব ওয়াজেদ জয়ের আইসিটির উপদেষ্টা হওয়ায় এ খাতে ছিল না কোনো জবাবদিহি। পলকের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে পারেনি। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দেশের বাইরেও পাচার করেছেন পলক।
সবশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় দেওয়া তথ্যমতে, পলকের গেল পাঁচ বছরে সম্পদ ও আয় বাড়ে অস্বাভাবিক হারে। নিজের অবৈধ আয়ের অর্থ বৈধ করতে স্ত্রীকে বানিয়েছেন উদ্যোক্তা। তার স্ত্রীর নামে সিংড়ায় রয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ বিঘা জমি। ঢাকায় কমপক্ষে ১৫টি ফ্ল্যাট আছে। পলক ও তার স্ত্রীর নামে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও আমেরিকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, পলকের স্ত্রী পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। কিন্তু গেল ১০ বছরে তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। নামে-বেনামে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে পলক ও তার স্ত্রী কনিকার নামে। এসব সম্পদ মূলত বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন। যেকোনো প্রকল্প নিলেই তার ১৫ শতাংশ দিতে হতো পলককে।
স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন পলকের আত্মীয়-স্বজনরা। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, এ টু আই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইটেক পার্ক, আইটি পার্ক তৈরির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন পলক। এদিকে পলক, তার স্ত্রী, পরিবার ও তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউ এ নির্দেশ দিয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেল বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিভাগের ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ রয়েছে।
এগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের হাতে। পেজ এবং চ্যানেলগুলোর অ্যাডমিন (নিয়ন্ত্রক) পলকের মনোনীত ব্যক্তিরা ছিলেন। তারাই পেজগুলো বন্ধ রেখেছেন।
আইসিটি বিভাগ সূত্র জানায়, বিভাগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা করত ঢাকা লাইভ নামের একটি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল মার্কেটিং টিম। পাশাপাশি আইসিটি বিভাগের নানা আয়োজন সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের কাজও পেত এই প্রতিষ্ঠানটি। এর সবকিছু এককভাবে তদারকি করতেন জুনাইদ আহমেদ পলক। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর কাওরান বাজারে ঢাকা লাইভের প্রধান কার্যালয়টি তাদের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজও বন্ধ।
অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আইসিটি বিভাগের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের কাছে না দিয়ে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে পরিচালনা করতেন। তিনি শেষ সময়ে পেজগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফের চালুর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আইসিটি বিভাগের সচিব মোঃ সামসুল আরেফিন বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। এগুলোর পাসওয়ার্ড তিনি জানতেন। তবে এসব পাসওয়ার্ড পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে গ্রেপ্তারের পর এখন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী এই প্রতিমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক কোনো তথ্য দিতে চাননি।
প্রশ্ন করলেই মাথা নিচু করে কাঁদছেন। এমনকি ছয় বছর ধরে চালানো নিজের মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজের দায়দায়িত্বও নিতে অস্বীকার করেছেন। তিনি বলছেন, মন্ত্রণালয় চালালেও কোনো কিছুই তিনি একা করেননি।
ডিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই পল্টন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রিক্সাচালক কামাল মিয়া।
এ ঘটনায় পল্টন থানায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার হন সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। নিরাপত্তার কারণে তাদের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে রাখা হয়। থানা-পুলিশ হত্যা মামলার বিষয়ে খোঁজখবর নিলেও সার্বিক বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি। হেফাজতে থাকা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অন্য আসামিদের মতোই তাদের একইভাবে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদের তুলনায় তাদের সবার স্বাস্থ্যের দিকেই বেশি নজর রাখা হয়েছে।
ডিএমপি পুলিশ জানায়, রাজধানীর খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকা থেকে সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।