
.
জাতীয় সংসদের ১৮২ (ঢাকা-৯) আসনটি রাজধানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন। কারণ, এ আসন থেকে যখন যে দল নির্বাচিত হয় তখন সে দলই রাষ্ট্রক্ষমতায় যায়। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আসনটি ধরে রাখতে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তৎপর। দুই দলেরই দুই ভিআইপি প্রার্থী বিভিন্নভাবে এলাকায় নির্বাচনী গণসংযোগ করেছেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এ আসনের দিকে চোখ রাখছে।
রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও ও সবুজবাগ, দক্ষিণগাঁও, মান্ডা এলাকা নিয়ে ঢাকা-৯ আসন গঠিত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ৭ এই সাতটি ওয়ার্ড কাউন্সিল এই আসনের অন্তর্ভুক্ত।
ঢাকা-৯ আসন সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে এর আগে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের কোরবান আলী। সেবার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। এ এলাকা থেকে ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী নির্বাচিত হন। সে বছর সরকার গঠন করে বিএনপি। তারপর টানা দুইবার ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির আবদুর রহিম এ এলাকা থেকে নির্বাচিত হন। ওই দুইবারই সরকার গঠন করে জাতীয় পার্টি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ১৯৯১ সালে এ এলাকা থেকে নির্বাচিত হন বিএনপির মির্জা আব্বাস। ওইবার সরকার গঠন করে বিএনপি।
১৯৯৬ সালে এই এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সাবের হোসেন চৌধুরী। সে বছর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এর পর ২০০১ সালে বিএনপির মির্জা আব্বাস নির্বাচিত হন। সেবার সরকার গঠন করে বিএনপি। তারপর ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে টানা তিন বার ঢাকা-৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সাবের হোসেন চৌধুরী। এই তিন বারই সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আর মাত্র এক মাস পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আর ভোট হবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এরই মধ্যে দেশের অন্যান্য এলাকার মতো ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে ঢাকা-৯ আসনেও। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার জোরদার করা হয়েছে ঢাকা-৯ আসনেও। বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ঢাকা-৯ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন এমনটি ধরে নিয়েই তিনি এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিয়ে তিনি সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে গণসংযোগ করছেন। তাঁর পক্ষে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা এলাকায় ব্যানার, পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড সাটিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতা ও ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক সভাপতি গিয়াস উদ্দিন সরকার পলাশও ঢাকা-৯ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে আগ্রহী। তাই তার পক্ষেও কেউ কেউ প্রচার চালাচ্ছেন। তবে ক্লিন ইমেজের নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর কোনো বিকল্প নেই বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। তাদের মতে, এ এলাকা থেকে চার বার নির্বাচিত হয়ে ব্যাপক উন্নয়নে কাজ করার পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে সাবের হোসেন চৌধুরীর।
সাবের হোসেন চৌধুরী বর্তমানে জাতীয় সংসদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। এ ছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতি (১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত)। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাবের হোসেন চৌধুরী ১৯৯৬ সালে এই এলাকা থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রথমে সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ও পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এক সময় তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়াও তিনি ২০১৪ সালে ১৬ অক্টোবর থেকে তিন বছরব্যাপী ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ২৮তম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি রাশিয়ার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘বন্ধুত্বের অর্ডার’ এ ভূষিত হন। ইন্টার পার্লামেন্টারি সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য তাঁকে এই পদক দেওয়া হয়।
ঢাকা-৯ আসন থেকে এবার বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী ও মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি এই এলাকায় দলের প্রার্থী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে এই এলাকার সর্বস্তরের মানুষের কাছে ইতোমধ্যেই ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেছেন। এ ছাড়া এলাকায় নিয়মিত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন বলে জানা যায়। কোনো কারণে আফরোজা আব্বাস নির্বাচন করতে না পারলে এ আসনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, অথবা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির নেতা হাবিবুর রশীদ হাবিব নির্বাচন করতে পারেন বলে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। এ ছাড়াও ঢাকা-৯ আসন থেকে এবার জাতীয় পার্টির ইদি আমিন অ্যাপোলোসহ বিভিন্ন দলের আরও ক’জন সম্ভাব্য প্রার্থী বিভিন্নভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা যায়।
ঢাকা-৯ আসনের অন্তর্গত খিলগাঁও এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা সরকারি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, দেশে উন্নয়নের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে চাইলে বর্তমান সরকারকে আরও অন্তত ৫ বছর ক্ষমতায় রাখার কোনো বিকল্প নেই। আর এই এলাকার বর্তমান সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী একজন ক্লিনইমেজের মানুষ। সুশিক্ষিত, ভদ্র ও মার্জিত এমন সংসদ সদস্য দেশে ক’জন আছে জানি না। তবে তিনি এ এলাকা থেকে চারবার নির্বাচিত হয়ে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এই সংসদীয় আসনে তিনি একটি স্টেডিয়ামও নির্মাণ করেছেন। তাই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এলাকাবাসী আবারও তাকে সংসদ সদস্য হিসেবে দেখতে চান।
মান্ডা এলাকার ভোটার, ব্যাংক কর্মকর্তা আবুল কায়েস বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্য একজন ভালো মানুষ। তবে এর আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনে অনেকেই ভোট দিতে পারেননি। তাই জনমনে কিছু ক্ষোভ রয়েছে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ কিছু কারণে মানুষ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ। তবে এলাকাবাসী চান সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ তৈরি করা হোক। আর তা হলে এ এলাকার ভোটাররা প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো একজনকে নিজের ইচ্ছামতো ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।
খিলগাঁও তালতলা নিবাসী আইসিডিডিআরবির সাবেক কর্মকর্তা মেরিনা সুলতানা জানান, জাতীয় স্বার্থে ভোট দিতে হবে খুব হিসাব করে। যাকে দিয়ে এলাকার এবং দেশের সবচেয়ে বেশি উপকার হবে তাকেই নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া ভোটারদের নৈতিক দায়িত্ব। অতীতে এ এলাকার রাস্তাঘাট, বিভিন্ন সেবা খাত এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এমন প্রার্থীকে এই এলাকার মানুষ বেছে নেবে বলে আমার বিশ্বাস।
ঢাকা-৯ আসনের ভোটার অধ্যাপক মোহাম্মদ সানাউল্লাহ জানান, এক যুগেরও বেশি সময়ে এ এলাকার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নয়ন হবে বলে আশা করছি। তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা যে যার মতো করে নির্বাচনী প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোটাররাও প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছে। তবে গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত হচ্ছে সুষ্ঠু ভোট। আমরা চাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট হবে। সে নির্বাচনে মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে। আর তা হলেই সবচেয়ে যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থী বিজয়ী হবে।
মুগ্ধা এলাকার বাসিন্দা ছাব্বির হোসেন বলেন, বিগত দেড় দশকে ঢাকা-৯ আসন এলাকায় উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন কাজ হলেও আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। বিশেষ করে জলাবদ্ধাতা নিরসন করা ও কিছু রাস্তাঘাটের সংস্কার কাজ বাকি আছে। আমরা আশা করব ভবিষ্যতে যিনিই নির্বাচিত হয়ে আসেন তিনি এ সমস্যাগুলোর সমাধান করবেন।