
আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি বাংলাদেশে শিক্ষার মানোন্নয়নে মাতৃভাষার গুরুত্ব কতটুকু? বাংলাদেশে হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী থাকার পরও শিক্ষার মানোন্নয়ন কেন হচ্ছে না? মাতৃভাষা প্রত্যেকটি জাতির পরিচয়ের মূল ভিত্তি। মাতৃভাষা হলো মানুষের প্রথম শেখা ভাষা, যা ব্যক্তির চিন্তা, অনুভ‚তি এবং যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। এটি শুধু ভাষা নয় এর সাথে জড়িয়ে থাকে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, চিন্তা- চেতনা এবং জ্ঞানের গভীর উৎস। শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এটি শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক স্তরেই আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতা গড়ে তোলে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তরে আমরা মাতৃভাষায় চর্চা শুরু করলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি।উচ্চ স্বরে গিয়ে ইংরেজিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই। ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করা জরুরি। কিন্তু মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় সব কোর্স ইংলিশ মিডিয়ামে। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় শিক্ষার্থীরা একটি বিষয় সম্পর্কে বোঝে পড়ার বদলে মুখস্থ পড়ার চেষ্টা করে। মাতৃভাষা এমন এক ভাষা যে ভাষায় আমরা একটি বিষয় কিংবা একটি কাজ সম্পর্কে নিখুঁত ভাবে জানতে ও বুঝতে পারি। কিন্তু যখন অন্য ভাষায় পড়াশোনা করি তখন সেটা একপ্রকার বোঝা হয়ে যায়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা তখন শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাশ করার জন্য মুখস্থ করে। কখনোই বোঝার চেষ্টা করে না। যেসব কোর্স মাতৃভাষায় পড়ানো হয় এবং শিখানো হয় তা প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী মনোযোগ সহকারে নিজের মধ্যে আয়ত্তে রাখতে চেষ্টা করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ সাবজেক্টে সবগুলো কোর্স ই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো হয়। বাংলা মিডিয়ামে লেখার কোনো অপশন ও থাকে না। যদি বিশ্ববিদ্যালয় কোর্সগুলোতে বাংলা অপশন রাখা হতো এবং বইগুলো বাংলায় পড়ানো হতো তাহলে নিজের সাবজেক্ট সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে পারতো। ইংরেজি আয়ত্তে রাখার জন্য বিশেষ এক দুইটা কোর্স রাখাই যথেষ্ট। একটি ডিপার্টমেন্টের মূল বিষয়গুলো মাতৃভাষায় পড়ানো হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে পড়াশোনা নিয়ে নিজের সাবজেক্ট সম্পর্কে সিরিয়াস হয়ে যেত। যেমন আমি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। আমার ডিপার্টমেন্টের সবগুলো কোর্স ই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো হয় এবং পরীক্ষা নেওয়া হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী গ্রেজুয়েট নিয়ে বের হয় কিন্তু কয়জন ভালো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে পেরেছে? কয়জন শিক্ষার্থী আছে রাষ্ট্র সংস্কারে জোর গলায় কথা বলতে পারবে? কয়জন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আছে আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে ভ‚মিকা রাখবে?
তাহলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ার সার্থকতা কোথায়? আমরা কখনো ভেবে দেখি এত এত মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝেও কেন একজন আদর্শ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পাই না? কেন একজন আদর্শ নেতা পাই না? কেন পাবো আমরা তো বিষয় সম্পর্কে শুধুই মুখস্থ করি। মনের মাঝে ধারণ করতে পারি না। শিক্ষার্থীদের উপর জোর করে শিক্ষাকে বিদেশি ভাষায় চাপিয়ে দিলে আগামী হাজার বছরেও আমাদের সমাজের পরিবর্তন আশা করা যায় না। একটি জাতিকে ভালোভাবে সঠিক পথে পরিচালিত করতে মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা অতি প্রয়োজন। মেডিকেলে প্রত্যেকটা ডাক্তার এবং নার্সদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো হয়। মেডিকেলে কোনো বই বাংলায় লেখা নেই এবং পড়ানো ও হয় না। এজন্যই প্রতিবছর এত এত ডাক্তারি পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধুমাত্র দুই একটা ভালো ডাক্তার পাওয়া যায়। বাকি সবাই শুধুই মুখস্থ পড়া শিক্ষার্থী। এদের দ্বারাই পরবর্তীতে রোগীর ক্ষতি হয়। একজন ডাক্তার ডাক্তারি ডিগ্রি অর্জন করে কেন ভুল চিকিৎসা করে আমরা কি কখনো ভেবে দেখি? প্রতিবছর অনেক রোগী শুধুমাত্র ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করে। একজন ডাক্তার কখনোই চাইবে না তার দ্বারা কোনো রোগীর মৃত্যু হোক। কেননা সে তো শপথ নিয়েছে রোগীর সুস্থতা নিশ্চিত করা। ভুল চিকিৎসার মূল কারণ হলো ভুল শিক্ষা অথবা মুখস্থ পড়ার ফলাফল। একটি বইয়ে একজন মানুষের পেশার দায়িত্ব ও কর্তব্যই বোঝানো হয়। সেই বইটি যখন মাতৃভাষায় লেখা থাকে এবং পড়ানো হয় তখন সেটি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করতে সহজ হয় । প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অনেক রোগী ডাক্তারের একটু ভুলে নিজেদের প্রাণ হারায় । কিছুদিন আগে আমার মামির ছোট বোনের সিজারে বাচ্চা হয়েছে। ডাক্তারের সামান্য ভুলের কারণে একনাগাড়ে গায়ের সব রক্ত বের হতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান। এখানে সম্পূর্ণ ই ডাক্তারের গাফিলতি কিংবা অপারেশন জ্ঞান স্বল্পতা ছিল। কিন্তু একজন মানুষের তো জীবন শেষ! একজন বাবা তার মেয়েকে হারালো, একটা মেয়ে জন্মের পরেই মা হারালো। এরকম হাজার হাজার মানুষ ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। ২০২২ সালে জয়পুরহাট বেসরকারি বন্ধন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুলভাবে অপারেশন করায় রুমা বেগম নামক এক রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। এরকম কত রুমা বেগম হাসপাতালে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় মারা যায়। এসব দায়ভার কে নেবে? ২০২৪ সালে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। চিকিসক হাসপাতাল ছেড়েই পালিয়ে গেলেন। হয়তো সেই চিকিসক ও জানতেন না তার দ্বারা একজন রোগী সুস্থ হতে এসে মারা যাবে। মাদারীপুরে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ভুল চিকিৎসা করার জন্য তো সে মেডিকেলের দায়িত্ব নেয়নি।প্রত্যেকটা মানুষেরই উচিত নিজের পেশা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা। যদি একজন চিকিৎসকের চিকিৎসা বিজ্ঞানের সকল নিয়ম নীতি ভালোভাবে আয়ত্ত করে তাহলে কোনো অদক্ষ ডাক্তার তৈরি হবে না। এর জন্য দরকার সহজ ভাষায় পড়ানো ও শিখানো। আর সহজ ভাষা বলতে সবাই যেহেতু মাতৃভাষাকে বুঝে থাকে সেহেতু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মাতৃভাষায় পড়ানো ও শিখানো উচিত।
শুধু অদক্ষ ডাক্তারই না প্রতিবছর অদক্ষ প্রকৌশলী ও তৈরি হয়। যাদের প্রকৌশল সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকে না। বাংলাদেশের বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট এর মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেজুয়েশন শেষ করে একজন ভালো প্রকৌশল হতে পারে না। এর মূল কারণ বিদেশি ভাষায় মুখস্থ বিদ্যার চর্চা। বাংলাদেশি ইন্জিনিয়ার দ্বারা গঠিত বিল্ডিং ভেঙে পড়ে যাওয়ার অনেক রেকর্ড রয়েছে। প্রকৌশলীরা হলেন দক্ষ প্রযুক্তিবিদ। গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটিয়ে ব্যবহারিক সমস্যার নিরাপদ এবং অর্থনৈতিক বিচারে গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করেন। কিন্তু এই গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ গুলো যদি মাতৃভাষায় বুঝানো হতো তাহলে একজন প্রকৌশলী একজন দক্ষ প্রযুক্তিবিদ হতে পারতেন। অনেকে আবার অন্য সাবজেক্টে পড়তে চায়। কিন্তু পরিবারের চাপে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়তে আসে। মাতৃভাষায় ক্লাস করলে এসব শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয়ে যেতো। মাতৃভাষায় পড়াশোনা করে আলাদা অনুভুতি পেত এবং ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারতো।
মাতৃভাষা একটি জাতির সত্তার প্রতীক। তাই মাতৃভাষায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা আয়ত্ত করতে উদ্বুদ্ধ করলে বাংলাদেশের বিরাট পরিবর্তন আসবে বলে আশা করি। শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষা শিক্ষার্থীদের কি কি উপকারে আসতে পারে? মাতৃভাষা জ্ঞান অর্জনের সহজ মাধ্যম। শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষায় সবচেয়ে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। নতুন ভাষা শেখার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। কারণ এতে শিক্ষার্থীদের ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা কম থাকে। শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করলে শিক্ষার্থীদের চিন্তার পরিবর্তন হয়। নতুন কিছু জানতে পারে নতুন কিছু শিখতে পারে। তারা তাদের চিন্তা ভাবনাকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে এবং জটিল বিষয়গুলো সহজে বুঝতে পারে। মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের জাতিগত সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। একটি জাতির ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের বিকল্প নেই। এটি তাদের আত্মপরিচয় গঠনে সহায়তা করে এবং তারা জাতিগত গর্ব অনুভব করে। বিশ্বব্যাপী গবেষণায় প্রমাণিত যে মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদান শিক্ষার মান বৃদ্ধি করে। এটি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় আগ্রহী করে এবং ঝরে পড়া কমায়। মাতৃভাষা বহু ভাষিক দক্ষতা অর্জনের ভিত্তি। মাতৃভাষার মজবুত ভিত্তি থাকলে অন্যান্য ভাষা শেখাও সহজ হয়। মাতৃভাষার উপর দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অন্য ভাষায় দক্ষতা অর্জনে পারদর্শী হতে পারে। তাই বাংলাদেশ সংস্কারে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে মাতৃভাষায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা লাভের উপর অধিক প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া