ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ মে ২০২৪, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

গাছ লাগাই উষ্ণতা কমাই

সোহেল রানা

প্রকাশিত: ২০:০৮, ৫ মে ২০২৪

গাছ লাগাই উষ্ণতা কমাই

.

ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। দিন দিন তাপপ্রবাহ বাড়ছে বাংলাদেশেও। ছাড়িয়ে যাচ্ছে অতীতের সব রেকর্ড। একসময় শুনতাম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৪০ ডিগ্রির ওপরে তাপমাত্রা ওঠে। এখন আমাদের দেশেই এই তাপমাত্রা বয়ে যাচ্ছে। দাবদাহে ঢাকা শহরের মানুষের জীবন নাভিশ্বাস। যশোরে সড়কের পিচ গলে  যাচ্ছে। অনেক জায়গায় হিটস্ট্রোক করে মারাও যাচ্ছে মানুষ। সারাদেশের চিত্রও একই। দিন দিন হয়তো আরও দুঃসহ হয়ে উঠবে জনজীবন। অচিরেই  কোনো উদ্যোগ না নিলে এর ভয়াবহতা আরও বাড়বে। রাস্তার দুই ধারে গাছ থাকলে এমনটা হতো না নিশ্চয়ই। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। যেখানে গাছ থাকে, সেখানের তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবে তুলনামূলক কম থাকে, মন থাকে প্রশান্ত।  রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, লাউয়াছড়া, সাতছড়ি উদ্যান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস যেন সবুজের গালিচা। এসব জায়গায় হাঁটলে খারাপ মন আপনা আপনি ভালো হয়ে যায়। আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের  দেশগুলোতে গাছ লাগানোর ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। বালু মাটিতেই বিশেষ পদ্ধতিতে গাছ লাগানোর জন্য নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে দুবাই। মরুভূমির দেশগুলোতে এমনিতেই তাপমাত্রা বেশি থাকে।

তারা চিন্তা করেছে, এখন থেকে তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে না আসা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে অবস্থা আরও খারাপের দিকে ধাবিত হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এমন উদ্যোগ নিতে পারলে আমাদের দেশ পারছে না কেন? আমরা তো ছাদবাগান করছি। সেখানে তো সব ধরনের গাছই জন্মে এবং ফলও দেয়। আমাদের দেশের মাটি উর্বর। যে কোনো উদ্যোগই সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমরা কেন যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছি না! ঢাকা শহর বিভাগীয় মহানগরীতে যে উড়ালসড়ক হয়েছে বা হচ্ছে, ইচ্ছে করলে কম শিকড় ছাড়ে এমন গাছ সড়কের দুই পাশে রোপণের পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারত। নিলে সারাবিশ্বে মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে যেত।

আমরা সবাই বিলাসবহুল বাড়ি বানাতে চাই। সেখানে এসি লাগিয়ে গরম থেকে বাঁচতে চাই। কিন্ত সবার তো এসি লাগানোর সামর্থ্য নেই। এসিও তো উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। বাড়ি বানানোর প্ল্যানে যদি গাছ লাগানোর জোরালো নির্দেশনা থাকত, মনিটরিং করা হতো- তাহলে মন্দ হতো না। এসবের দেখভালের দায়িত্ব রাজউক, সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভার হাতেই। প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নত হলে ভালো থাকবে নতুন প্রজন্ম। দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ইচ্ছে করলে পারে শহরকে ছায়াময় করতে। এসি-ফ্যান দিয়ে গরম থেকে কয়দিন বাঁচা যাবে? তাছাড়া এতে চাপ বাড়ছে বিদ্যুতের ওপর।

একটি দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বৃক্ষ বা বন থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশে এই অনুপাতে বনভূমি আছে কীদাবদাহে রেললাইন বেঁকে যাচ্ছে। রেললাইন সচল রাখতে রেল মন্ত্রণালয় গাছ লাগানোর কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কী? জানা নেই। সমাজে মানুষ অনেকভাবেই অবদান রাখতে পারে। জলবায়ু সুরক্ষায় সামর্থ্য থাকার পরও কেন আমরা নিজেদের অবস্থান থেকে কোনো ভূমিকা রাখছি না? আমার এক বন্ধু, বড় ভাই তার নিজ এলাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে রোপণ করে যাচ্ছেন তালবীজ নারিকেল গাছ। তাও আবার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। কাজটি করছেন বিবেকের তাড়নায়।

তাল পাকার মৌসুমে কাপাসিয়া-কালীগঞ্জের বিভিন্ন হাট থেকে পাকা তাল সংগ্রহ করেন তিনি। প্রক্রিয়াজাত করে তালের রসও প্রতিবেশীদের বিলিয়ে দেন। এই কাজে সহযোগিতা করেন তার গ্রামের কয়েকজন যুবক। খুব নিভৃতে কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের উড়ালপথে (নরসিংদী জেলা হাসপাতাল সংলগ্ন) যে গাছগুলো দেখা যায়, সব ওনাদের হাতে রোপিত। তারা চিন্তা করেছেন উড়ালসড়কে গাড়ি চলাচলে অনেক সময় অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। প্রখর রোদে মহাসড়ক উত্ত্যপ্ত হতে পারে। গাছ থাকলে তো কিছুটা হলেও প্রতিকার সম্ভব। তার ফলও এখন আমরা পাচ্ছি। উড়ালসড়কে উঠলেই হিম বাতাস শরীরে লাগে। সবুজে চোখে স্বস্তি আসে। রাতের সুনসান নীরবতায় শোনা যায়, পাখিদের কলরব।

এমন কাজ হাতে গুনা দুয়েকজন নীরবে নিভৃতে করে গেলেও দেশের নেতৃস্থানীয়রা কী ভাবছেন প্রকৃতি নিয়ে? সভা-সমাবেশে গাছ লাগানো, গাছ রক্ষার বিষয়ে কোনো কথা বলছেন কী? প্রতিবাদ করছেন কী গাছ নিধনের বিষয়ে? কিংবা নিজ নিজ এলাকায় বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন কী? যদি তারা গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিত, তাহলে হয়তো অচিরেই দেশকে সবুজে ঢেকে ফেলা যেত। তীব্র গরম থেকে বাঁচতে পারত দেশের মানুষ। দুঃখের বিষয়, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে তীব্র দাবদাহের মধ্যেই হাজার গাছ কাটার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই গাছ রক্ষার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর স্থানীয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কী?

মনে আছে, ক্লাসে শিক্ষকরা বৃক্ষরোপণের কথা বলতেন। হাট থেকে চারা কিনে আমাদের দিয়ে রোপণ করাতেন। এখন স্কুল-কলেজে এই চর্চাটা হয় কি-না জানা নেই। হয়ে থাকলে কাজটি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে পারে তার চারপাশের পরিবেশ বৃক্ষময় ছায়াময় করে তুলতে।  সেই সঙ্গে গড়ে তুলতে পারে পাখিদের আবাসস্থল। জলবায়ুর উষ্ণতা রোধে শুধু গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়ে লাগালেই হবে না, গাছ লাগানোর পর যত্ন নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সদিচ্ছার। গাছ রোপণে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে ফলদ ঔষধি গাছকে। তাতে ঘাটতি মিটবে পুষ্টি চাহিদার। ফলে, বেড়ে উঠবে আগামীর বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম। সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লার সামাজিক সংগঠনগুলোও গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে পারে। বিষয়ে সকলের সচেতনতা কাম্য। সকলের সম্মিলিত উদ্যোগেই একটি দেশ সমাজকে সুন্দরভাবে সাজানো যায়, ভালো রাখা যায় সবাইকে।

লেখক : সাংবাদিক

×