ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৪ আষাঢ় ১৪৩১

নজরুলের সংগ্রামী শৈশব

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ২৪ মে ২০২৪

নজরুলের সংগ্রামী শৈশব

.

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলার সাহিত্য গগনে এক প্রবল ঝড়ো হাওয়া। উন্মত্ত, উল্লাসে যিনি বাংলা বাঙালিকে দারুণভাবে কাঁপিয়ে দিলেন। ১৮৯৯ সালে ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামের এক অজপাড়াগাঁয়ে কবির জন্ম।

ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে জন্ম নেওয়া বিদ্রোহী সত্তা বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে হরেক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বলয়ে যেভাবে শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করেন, তাও এক সাধারণ বালকের নিত্য জীবনযাপন। সঙ্গত কারণে লিপিবদ্ধ করার জীবন কাহিনী সেভাবে রচিত না হওয়াও দুঃসহ পালাক্রম। রচনা, রটনা নিয়ে হরেক গল্প কথা প্রচলিত থাকলেও কবির জন্মলগ্ন থেকে শিকড় খোঁজা অত সহজসাধ্য ছিল না। বর্ধমানের চুরুলিয়া এক অখ্যাত রাঢ় অঞ্চল। পরিবেশ পরিস্থিতিও ছিল বিক্ষুব্ধতার চরম পালাক্রম। অঞ্চলটাই যে শুধু জানাশোনার বাইরে ছিল তা কিন্তু নয়। বরং কবির জন্ম পরিচয় থেকে আরম্ভ করে তৎকালীন জীবনও ছিল অতি সাধারণ ঘরের নগণ্য বালক হিসেবে। জীবনের কঠিন পালাক্রমে সুস্থ-সুস্থির থাকার কোনো উপায়ই থাকেনি। সোনার চামচে দুধ ভাত নিয়ে জন্ম শুধু বরেণ্য, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের। আর নজরুল? জন্ম হোক যেথা সেথা- কর্ম হউক সফল। প্রমাণ করে দিলেন অতি সাধারণ ঘরের বালক নুরু, দুখু মিয়া। তেমন কাহিনী কল্পকথাকেও হার মানায়। সেই সুয়োরানী, দুয়োরানীর গল্পের মতো।

দরিদ্র পরিবারটি কতখানি অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ছিল, তাও অজানা এক ইতিবৃত্ত। ভৌগোলিক আর সামাজিক পরিবেশের বিদগ্ধতায় যাপিত জীবন হয়েছে অস্থির, ছন্নছাড়া, বিপন্নতার বেহাল দুরবস্থা। জন্ম থেকেই চেনা-জানা বিপরীত স্রোতে এগিয়েছেন পালহীন নৌকার মতো। তার পরেও সাধারণের মধ্যে অসাধারণ নজরুলকে নিয়ে গোলাম মুরশিদ স্যারের দামি উক্তিটিই উদ্ধৃত করলাম।নজরুল আসলেই পরিবার নিরপেক্ষ একজন মানুষ, স্বগঠিত, স্বাবলম্বী, স্বাধীন, স্বধন্য

যথার্থ মূল্যায়ন তো বটেই। বালক বয়সেই পিতা ফকির আহমেদ মারা গেলে পিতৃহীন দুখু মিয়ার জীবনতরী বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের অনন্ত ঢেউয়ে ডুব দেওয়ার দুরবস্থা। তার পরেও চড়াই-উতরাই পেরোনোর জীবন সুখকর আর স্বাচ্ছন্দ্য ছিলই না। উপমহাদেশীয় উত্তাল স্রোত আর বিদ্রোহীর জীবনযুদ্ধ যেন পরিবেশ পরিস্থিতির উন্মত্ত আস্ফালন। মাথার ওপর অভিভাবক কিংবা ছাদের ছায়া না থাকলেও প্রতিভাদীপ্ত নজরুল হেঁটেছেন আপনবোধ আর অসাধারণ সৃজন চেতনার অবিমিশ্র জোয়ারে। সেই অতি বাল্যকাল থেকেই। মাতা জাহেদা খাতুনকে নিয়ে হরেক প্রশ্নের অবতারণা হলেও জীবনীকাররা তাকেই নজরুলের জন্মদাত্রী মা হিসেবে উল্লেখ করেছেন নির্দ্বিধায়, অকুণ্ঠচিত্তে। মা জাহেদা খাতুনের সঙ্গে মাতৃত্বের নিবিড় সৌহার্দ্যে তেমন কোনো আন্তরিকতার বাঁধন তৈরি না হওয়াও শিশু দুখু মিয়ার জীবনযুদ্ধের আর এক দীনতা তো বটেই। মা দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। কিন্তু নজরুলের চাচার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে মা-ছেলের স্বাভাবিক সম্পর্কে তেমন নিবিড় যোগাযোগের অনুপস্থিতি সত্যিই বেদনাহত। শুধু তাই নয়, বালক নুরুর লেটো গানের দলে সংযুক্ত হওয়া সে সময়ের এক স্মরণীয় আখ্যান। তেমন গানের আসর নাকি ছেড়ে আসলেন মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের কারণে। দুখু মিয়ার শৈশব-কৈশোরের যথার্থ দুঃখের তিমিরে মঙ্গল আলোক যেন বিচ্ছিন্ন হওয়া। হয়েও ছিল তাই।

পিতৃহীন বালক নজরুল মায়ের সঙ্গে ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতায় জীবনের মহাসাগরের অথৈই পানিতে সাঁতরানো পরিস্থিতির দুর্বিপাক। ইতোমধ্যে বেজে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। এটা অত্যন্ত সুবিদিত, কবি ১৯১৭ সালে মাত্র আঠারো বছর বয়সে যুদ্ধের জন্য তৈরি হওয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, নিজস্ব যোগ্যতায় হাবিলদার পদে উত্তীর্ণ হওয়া সৈনিক জীবনের পরম আলেখ্য। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান হলেও কবি করাচি থেকে সহজেই বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে ফিরতে পারেননি। তবে তার আগেই নজরুলের জীবন নানা প্রতিকূল হাওয়ায় বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। কিশোর নজরুলের মক্তবে পড়া পড়ানো থেকে খাদেমগিরি করার কাহিনী কিংবদন্তির মতো লোকমুখে প্রচলিত। ইমামতি করতেও দেখা গেছে কবিকে। অর্থাৎ জীবন জীবিকার তাড়নায় সন্মুখ সমরকে পাড়ি দিতে কোনোদিকে তাকাননি, থমকেও যাননি। দুমড়ে-মুচড়ে সব বাধাবিপত্তিকে ডিঙিয়ে দুঃসময়কে আলিঙ্গন করে সামনের দিকে এগিয়ে চলার নামই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিংশ শতাব্দীর প্রথম / দশকের উত্তাল ঢেউ অবিভক্ত ভারতকে যে মাত্রায় উন্মত্ত আস্ফালনে অস্থির করে তোলে, তার বাতাস এসে লাগে বিদ্রোহী সত্তার অনমনীয় তেজে। অস্থির দাবানলের চরম পরিবেশ, ছন্নছাড়া, ঘুরে বেড়ানো নজরুলের জীবনের যথার্থ স্থিতি সত্যিই এক দুঃসহ তাড়না। কৈশোরে রুটি বেলার কাজও করতে হয়েছে এই বিদ্রোহী যোদ্ধাকে। আর সমৃদ্ধ সংগীত জীবনের বীজ অঙ্কুরিত হয় সেই কিশোর বয়সে। যার শুভক্ষণ শুরু লেটো গানের দলের সঙ্গে নিজের যাপিত জীবনকে জড়িয়ে ফেলা। অভাবনীয় প্রতিভাদীপ্ত মনন আর সৃজন ক্ষমতায় সংগীতের অবিশ্বাস্য অনুরণন সেটাই সংগীতজ্ঞ নজরুলের এক অপার মহিমান্বিত শৌর্য। এক সংগীত বোদ্ধার নব প্রভাতের সূর্যরশ্মির আলোকচ্ছটা তো বটেই। ভেতরে সব সময় জিইয়ে থাকত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দৃঢ়তম শক্তি। আপোসহীন এক মনন সৃজন সত্তায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন তো তার আশৈশব, যা যৌবনের অগ্নিদাহে অবিভক্ত ভারতে দাবদাহের মতো বিচ্ছুরিত হয়েছে। মাথা নোয়াননি কখনো, বীরদর্পে উচ্চারণ করেছেন স্বাধীন, মুক্ত হওয়ার নবদ্যুতি। ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার মতো সব ধরনের যৌক্তিক, ধারালো অস্ত্র। সেটা যে কাব্যিক ঝঙ্কারের অনবদ্য ব্যঞ্জনা।

কোনো ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত স্রোত পাড়ি দেওয়া নয়। অদমনীয় এক শক্তিময়তায় ঠান্ডা বিদ্রোহের নব উত্থান। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ক্ষেপেছেন, লড়েছেন বিনা রক্তক্ষয়ে। শুধু কাব্যিক অহমিকা আর উন্মাদনায় অবিশ্বাস্য এক সৃজনযুদ্ধের অভাবনীয় শিল্পবোধ, যা তখন অবধি কেউ কল্পনায়ও আনেননি। বিদ্রোহী কবির ছিল একদিকে বিপ্লবী সত্তা, অন্যদিকে সংগীতের নমনীয় সুর দ্যোতনায় সম্মিলিত শৌর্য। এশিয়ার প্রথম নোবেল জয়ী কবি গুরুর আরাধ্য শিষ্য ছিলেন বিপ্লবী মনস্তত্ত্বের সফল নায়ক নজরুল। সংগীতপ্রিয় নজরুল নাকি প্রথম জীবনে রবীন্দ্র সংগীত সরোবরে সাঁতার কাটতেন। গীতাঞ্জলির সব গানই নাকি নজরুলের নখদর্পণে ছিল। বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর স্মৃতি কথায় এমন অমূল্য উপাত্ত উঠে আসে। আরও জানা যায় ছন্ন ছাড়া জীবনের ঘুরে বেড়ানোর ইতিবৃত্তে সামান্য তল্পিতল্পার মধ্যে একটি অসাধারণ সংগ্রহ থাকত, সেটা নাকি কবি গুরুর গীতবিতান। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের গানের ভুবনে নিমজ্জিত থাকা নজরুল কি করে অসাধারণ ব্যতিক্রমী সংগীত সম্ভার উপহার দিলেন অবিভক্ত বাংলা বাঙালিকে? রবীন্দ্রনাথে নিমগ্ন হয়েও যখন সংগীতের বাণী সুর দিচ্ছেন আশ্চর্যজনকভাবে, সেখানে কবি গুরুর কোনো ছাপই নেই। এখানেই নজরুলের ব্যতিক্রমী সৃজনশীলতা হৃদয়ের গভীরে নিজস্ব শিল্পবোধ। রবীন্দ্র সংগীতের স্রোতধারায় সাঁতরিয়ে বেড়ানো নজরুল আপন বৈভবে দুর্দান্ত ক্ষমতায় আরেক সংগীত সম্ভারের নায়কের আসনে অভিষিক্ত হলেন। আর ১৯২১ সালের কোনো এক বিনিদ্র রজনীতে লিখে ফেললেন, ‘বিদ্রোহী মতো অজেয়, অমর, অক্ষয় এক কবিতাশৈলী, যা আজও কেউই অতিক্রম করার ধারেকাছেই যায়নি। নজরুল প্রথমেই নাকি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে চলে যান। উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করে শোনান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। বিস্ময়ে বিমুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ! হাত বাড়িয়ে নবযুগের নতুন কবিকে আলিঙ্গন করলেন।

১৯২২ সালে নজরুল যখন অনশনরত কারাগারে, তখন কবিগুরু তাঁর বসন্ত নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করলেন। শুধু তাই নয়, উৎসর্গপত্রে লিখলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সারাবাংলা কেঁপে উঠল নবযুগের বিপ্লবী কবির জয়ধ্বনিতে। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, সংক্ষিপ্ত শৈল্পিক জীবন উৎসবে আনন্দে জয়ধ্বনিতে মাতিয়ে গেলেন। শেষ অবধি দুরারোগ্য এক ব্যাধির করাল গ্রাসে সেই যে নিথর নিস্তব্ধ হলেন। পরবর্তী ৩৪ বছর ছিল এক নির্লিপ্ত কবির নীরব যন্ত্রণা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। জাতীয় কবির মর্যাদাও দিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সমর সংগীতেও বঙ্গবন্ধু নজরুলকেই অভিষিক্ত করলেন।

লেখক : সাংবাদিক

 

×