
এ বছর এপ্রিল মাসে বাঙালি ঈদুল ফিতর এবং পহেলা বৈশাখ
বাংলার কত রূপ যে আছে, যে রূপের তালাশ করে ফিরেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ। সেই রূপের সকল আধার যেন হাজির হয় বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখের উৎসবে। ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। জীবনানন্দ দাশের অমোঘ এই উচ্চারণের সত্যতা কেবল বাংলার প্রকৃতিতে মেলে না, তার উৎসব-পার্বণেও হাজির হয়
এ বছর এপ্রিল মাসে বাঙালি ঈদুল ফিতর এবং পহেলা বৈশাখ পাশাপাশি উদ্যাপন করতে যাচ্ছে। পাশাপাশি সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে এই দুই উৎসবকে কেন্দ্র করে খুব উৎসাহ এবং উদ্দীপনা কাজ করছে। যার ফলে ঈদুল ফিতর এবং পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে বাংলাদেশে এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। ঈদের সামাজিক অর্থ উৎসব আর আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। তাই প্রতি বছরই মুসলমানদের জীবনে ফিরে আসে খুশির ঈদ। প্রথমটি উদ্যাপিত হয় দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর। যাকে আমরা বলি ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ, আর অন্যটি আত্মত্যাগের কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা। এ দিনে প্রতিটি মুসলিম পরিবার আনন্দে মেতে ওঠে।
রমজান শেষ হওয়ার ৩/৪ দিন পূর্ব হতেই ঈদের দিন সকালে প্রত্যেক গৃহে সেমাই, ফিরনি, নাস্তা, পোলাও ইত্যাদি খাবার তৈরি করা হয়। সবাই মিলে এক ঘর হতে অন্য ঘরে আনন্দের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে। ঈদের দিন সকালে ধনীরা গরিব লোকদের মুক্ত হস্তে দান করে। এ দানকে ফেতরা বলা হয়। সবাই এই দিনে যার যার সাধ্যানুযায়ী ভালো পোশাক পরে। ঘরে ঘরে উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও এ আনন্দের অংশীদার হয়ে থাকে। দরিদ্র ও গরিবরাও এদিনটিকে সমাজের ধনী শ্রেণির সঙ্গে একসঙ্গে যথাযোগ্য মর্যাদা ও আনন্দের সঙ্গে পালন করে।
মুসলমানরা এদিন কৃতজ্ঞচিত্তে খুতবাসহ ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কুশলবিনিময় করে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই এ দিনে কোলাকুলিসহ সালাম ও শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে দেয়। ঈদ উপলক্ষে ঈদকার্ড বিনিময় কিন্তু বর্তমানে একটি জনপিয় প্রথায় পরিণত হয়েছে। আর তথ্যপ্রযুক্তির এ উৎকর্ষতার যুগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমেও মানুষ আনন্দ-খুশি ও ঈদের আবেগ ভাগাভাগি করে থাকে। সমাজের ধনী ও সক্ষম ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট হারে গরিবদের ফিতরা বা শর্তহীন অনুদান বিতরণ করে থাকেন, ধর্মীয় দিক থেকে যা বাধ্যতামূলক। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে।
সত্যিকার অর্থে ঈদুল ফিতরের আমেজ মূলত শুরু হয় রমজানের একেবারে শুরু থেকেই। সবার আগে শুরু হয় ঈদ উপলক্ষে নতুন জামাকাপড় কেনা। এই আনন্দটা আবার ছোটদেরই সবচেয়ে বেশি। ঈদের আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে বাড়ি ফেরার আনন্দ। সপরিবারে ঈদ পালন করার জন্য মানুষ ঈদের সময় নাড়ির টানে নিজেদের গ্রামের বাড়ি ফিরতে শুরু করে।
এ সময় বাস, ট্রেন আর লঞ্চে ঘরমুখো মানুষের প্রচ- ভিড় হয়। ঈদ উদ্যাপন শুরু হয় সকালবেলা ঈদের নামাজ পড়ার মাধ্যমে। নতুন পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে সবাই দলে দলে ঈদগাহে যায় ঈদের নামাজ আদায় করতে। নামাজের পর সবাই সবার সঙ্গে কোলাকুলি করে, আর একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়, ‘ঈদ মুবারক’ বলে। এভাবেই শুরু হয় ঈদ উৎসব।
পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সার্বজনীন লোকউৎসব হিসেবে বিবেচিত। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের শুরু হয়েছিল পুরান ঢাকার মুসলিম মাহিকরাস সম্প্রদায়ের হাতে। গ্রেগরীয় বর্ষপুঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। নতুন বছরের প্রথম দিন এবং বিদায়ী বছরের শেষ দিনকে ঘিরে নানা ধরনের আয়োজন ছুঁয়ে যায় সকল বাঙালিকেই।
বিশেষত পহেলা বৈশাখের আয়োজন বাঙালির সর্বস্তরের জনজীবনকে রাঙায়িত করে নানানভাবে। বাঙালির ঘরে, জনজীবনে এবং আর্থ সামাজিক সংস্কৃতিতে এরকম উৎসব দ্বিতীয়টি নেই। বৈশাখের এই উৎসবকে সর্বজনীন উৎসব বলা হয় এ কারণে যে এই উৎসবে সকল ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করে। বাঙালি জীবনের মৌলচেতনা হলো অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করা। সেই চেতনা এখানে হাজার বছর ধরে প্রবহমান। এই সমাজের গঠনই হলো এমন যে, এখানে সবাই যার যার মতো করে জীবনকে যাপন করতে পারে এবং নিজস্ব রীতিনীতি-কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ধর্মানুযায়ী আচার ও ধর্ম পালন করতে পারে।
অন্যদিকে আসছে পহেলা বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ পালন করতে যাচ্ছে সর্বস্তরের বাঙালি জনগণ। বাঙালি ব্যবসায়ীদের জীবনে হালখাতার প্রচলন শুরু হচ্ছে ১৪৩০ বঙ্গাব্দের বিদায়ী মাসের শেষের কয়েকদিন ও আগমনী ১৪৩১ বর্ষের শুরুর কয়েকটা দিনকে ঘিরে এবং এর মধ্যে মুখ্য হয়ে দেখা দেয় পহেলা বৈশাখের দিনটা, যা বৈশাখী উৎসব হিসেবেই আমাদের সকলের কাছে পরিচিত ও বিশেষভাবে নন্দিত।
বাঙালি ব্যবসায়ীদের জীবনে হালখাতার প্রচলন শুরু হয় এই সালের বিদায়ী মাসের শেষের কয়েকদিন ও আগামনী বর্ষের শুরুর কয়েকটা দিনকে ঘিরে এবং এর মধ্যে মুখ্য হয়ে দেখা দেয় পহেলা বৈশাখের দিনটা যা বৈশাখী উৎসব হিসেবেই নন্দিত। হালখাতা সংস্কৃতি রীতিমতো এখন একটা অংশগ্রহণমূলক আনন্দদায়ক উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাংলার ঘরে ঘরে এই উৎসব যেন প্রাণের বান ডেকে আনে।
বাঙালি জীবনে বিবিধ সমস্যায় আকীর্ণ। এখানে আনন্দ যেমন আছে তেমন দুঃখ আছে। প্রকৃতিই এমন কখনো বন্ধুর কখনো সৌহার্দ্যপূর্ণ। বাঙালি এর মধ্যে দিয়েই রপ্ত করেছে বাঁচতে শেখার মন্ত্র। এবং সেই মন্ত্রকে কিভাবে নিজের জীবনের চালিকাশক্তিতে রূপান্তর করেছেন, তার অনুপম দৃষ্টান্ত হলো পহেলা বৈশাখের উৎসব। বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা।
এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণির প্রতিলিপি। যা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।
পহেলা বৈশাখের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নদী জেগে ওঠে নৌকাবাইচকে ঘিরে। গ্রামের বটতলায় প্রাণের জাগরণ ঘটে নাগরদোলার মতো নানা আয়োজনের উপস্থিতিতে। হাটে মাঠে ঘাটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানেও জারি সারি ভাটিয়ালি গান থেকে শুরু করে হাল আমলের গানেরও তুফান ওঠে। রকমারি পিঠার মনোহরা গন্ধে ছড়িয়ে পড়ে লোকালয় থেকে লোকালয়ে।
মোরগ লড়াই যেমন হয়, তেমনি ষাঁড়ের দৌড়-ঘোড় দৌড়ের আয়োজন হয়। বেদে বেদেনিরা সাপের খেলার আর গানের ঝাঁপি খুলে বসে। চরকি ওড়ে, ঘুড়ির মেলা বসে, নানা রঙের পুতুলের উপস্থিতির সঙ্গে থাকে পুতুল নাচের আয়োজনও। বাঁশি বিক্রেতা বাঁশি বাজিয়ে মুখর করে তোলে মেলা প্রাঙ্গণ। এই উৎসবকে ঘিরে যাত্রাপালার আয়োজনও করা হয়। সেখানে রাধা কৃষ্ণের বিরহে যেমন আকুল হয় মানুষের মন তেমনি লাইলি মজনুর বিরহগাঁথাও তাদেরকে ব্যথিত করে।
বাংলার কত রূপ যে আছে, যে রূপের তালাশ করে ফিরেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ। সেই রূপের সকল আধার যেন হাজির হয় বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখের উৎসবে। ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। জীবনানন্দ দাশের অমোঘ এই উচ্চারণের সত্যতা কেবল বাংলার প্রকৃতিতে মেলে না, তার উৎসব-পার্বণেও হাজির হয়। একটা উৎসব কিভাবে সর্বজনীন হয়ে ওঠে। কিভাবে তার প্রসার ঘটতে পারে, তার নজির রয়েছে বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসবে।
সুতরাং, আমরা মুসলিম সম্প্রদায়ের আসন্ন ঈদুল ফিতর এবং জাতি, ধর্ম-বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে বাঙালি জনগণের পহেলা বৈশাখ এ দুই গুরুত্বপূর্ণ উৎসব উদ্যাপনের লক্ষ্যে যে উৎসবমুখর পরিবেশ বাংলাদেশে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে তাতে আশা করছি বাঙালি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ এবং প্রাণবন্ত হবে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি।
ঈদুল ফিতর এবং পহেলা বৈশাখ এ দুই উৎসবের আর্থসামাজিক যে শিক্ষা তা এই উৎসবসমূহ উদ্যাপনের মাধ্যমে অর্জন করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং দলমত নির্বিশেষে সকলের একতাবদ্ধ অংশগ্রহণের মাধ্যমে অচিরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ে উঠবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছি। বাঙালি জাতি, জাতি হিসেবে সংস্কৃতিতে যে কতটা সমৃদ্ধ তা বাংলাদেশের উৎসবমুখর এই পরিবেশে আসন্ন ঈদুল ফিতর এবং পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে স্পষ্টভাবে উঠে আসবে।
লেখক : অধ্যাপক, উপাচার্য
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়