কেন এত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ঈদ!
সাতাশ রোজার পর বাবার অফিস বন্ধ পড়ত। ঈদে আমাদের বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় শুরু“হতো তার এক সপ্তাহ আগে থেকেই। সেহরি খেয়ে বাবা আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। বাড়ি যেতাম ট্রেনে। আমরা যখন স্টেশনে এসে পৌঁছতাম তখনও অন্ধকার। চোখের সামনে সূর্য উঠতে দেখতাম। সাত ভাই বোনের পরিবার। ট্রেনে উঠতে যুদ্ধ করতে হতো। তবে যুদ্ধটা গায়ে লাগত না। আমরা তখন আগাম ঈদের আনন্দে বিভোর।
দুপুর নাগাদ গ্রামের বাড়ি গিয়ে পৌঁছতাম। ঈদের মজাটা শুরু হতো তখন থেকেই। ঈদের আগের দিন ইফতারের পর সব কাজিনরা মিলে সাদাকালো টিভির সামনে গিয়ে বসে থাকতাম ঈদের চাঁদ দেখা গেছে কীনা শোনার জন্য। চাঁদ দেখা গেছে শুনলে দৌড়ে চলে যেতাম ঈদের চাঁদ দেখতে। গাছ থেকে মেহেদী পাতা তুলে আনতাম। সেই পাতা বেটে দেওয়ার জন্য বড়দের পেছনে পেছনে ঘুরতাম। বেটে একসময় দিত।
কিন্তু পরিয়ে দেবে কে? অবশেষে কেউ না কেউ একজন একজন করে সবাইকে মেহেদী লাগিয়ে দিত। দুই হাত ভরে মেহেন্দী লাগাতাম। সকাল হলেই ঈদ, খুশিতে সারারাত ঘুম আসত না। সম্ভবত শেষ রাতের দিকে ঘুম আসত। দাদি এসে ডাকত.. সকাল হয়েছে উঠো। এক ডাকেই উঠে বসতাম। আজ ঈদ! গোসল করে নতুন জামাটা পরে ফেলতাম। যেটা এতদিন কাউকে দেখতে দিইনি। ঈদের জামা দেখে ফেললে যে ঈদ শেষ। মা চাচিরা ভোরে উঠে রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। সেমাই রান্না করত সবার আগে।
বাড়ির পুরুষ লোকেরা মিষ্টি মুখে দিয়ে ঈদের নামাজে যাবে। আমরা ঈদের জামা পরে সবাই একসঙ্গে বসে সেমাই খেতাম। ঈদের দিনের সেমাইয়ের গন্ধটা মনে হতো অন্যরকম। ঈদ ঈদ গন্ধে ভরা। বাবা-চাচারা ঈদের নামাজ পড়ে এসে আমাদেরকে সালামি দিত। ঈদে বাড়ির পাশেই ছোটখাট একটা মেলা বসত। সবাই দল বেঁধে সেই মেলায় চলে যেতাম। সালামির টাকা পুরোটাই মেলায় ঘুরে শেষ করতাম। তারপর দুপুরে বাড়ি ফিরতাম। মা ডাকত দুপুরের খাবার খেতে।
মেলায় হাবিজাবি খেয়ে ঈদের দিন কখনোই দুপুরের খাবার খেতে পারতাম না। দুপুর থেকেই মনটা খারাপ হয়ে যেত। ঈদ শেষ হয়ে যাচ্ছে! এই কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না। তারপরের কয়টা দিন হৈ-হুল্লোড় করে, বিটিভিতে ঈদের অনুষ্ঠান দেখে সময় কখন যে কেটে যেত টেরই পেতাম না। আমাদের ঈদের আনন্দের দিনগুলো শেষ হয়ে যেত। আবার কবে ঈদ আসবে।
ছোট বেলার সবচেয়ে বড় কষ্টগুলোর মধ্যে একটা ছিল ঈদ কেন এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। আমরা বড় হয়েছি। এখনো ঈদ আসে। আগের চেয়ে অনেক দামি ঈদের কাপড় কেনা হয়। কিন্তু ঈদের সেই আনন্দ আর খুঁজে পাই না। ঈদের আনন্দ চলে যাওয়াটা জীবনে হারিয়ে ফেলা সুখগুলোর একটা। সেটা বোধহয় শুধু ছোট বেলায়ই থাকে।
লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা থেকে
