
আতিকউল্লাহ খান মাসুদ
কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি পোস্ট পড়ছিলাম। কার লেখা জানি না। লেখাটির কিছু অংশ- ‘আম্মারে আর তেমন মনেটনে পড়ে না। শুধু হুট করে বাড়ি ফিরলে নিজের অজান্তে আম্মা বইলা ডাইকা উঠি। আম্মারে আসলেই আর মনে পড়ে না। মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধবদের ফোন আসে। ‘হ্যালো আম্মু, বলো’ শুনলেই আমার ফোনের দিকে তাকাই। উহু, ফোন আসে না আম্মার নাম্বার থেকে। আসবে কেমন করে? নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেলে কি আর ফোন আসে? আসলেও আর আম্মারে মনেটনে পড়ে না।
যেই মানুষটা পুরো অস্তিত্বজুড়ে, সেই মানুষটাকে আবার আলাদা করে কিভাবে মনে পড়বে? আগে আম্মারে ধরতে পারতাম, ছুঁইতে পারতাম, কপালে আদর দিতে পারতাম। এখন আম্মা থাকে প্রতিটা হাহাকারে, প্রতিটা কান্নায়, প্রতিটা যন্ত্রণায়, প্রতিটা অসুখে।’- নিজের অনুভূতির সঙ্গে মিলে যাওয়ায় লেখাটা পড়ে সেদিন কান্না পেয়েছিল। ঠিক পরদিন অফিসে এসেই কোনো একটা কারণে স্যারের কথা মনে পড়ল। চোখটা ভিজে উঠতেই আগেরদিন পড়া পোস্টটা মনে পড়ল। ভাবনায় ডুবে গেলাম, গল্পটা আমার মা আর স্যারের বেলায় খুব প্রযোজ্য।
এই দুটো মানুষের ক্ষেত্রে প্রতিবারই বলি, তাদের আর এখন সেভাবে মনে পড়ে না। কিন্তু বলতে গিয়ে কোথায় যেন আটকে যাই! এই যে প্রতিটি কথায়-কাজে তাদের কথা মনে করি, অনেক কিছুতেই তাদের স্মৃতি স্পর্শ করে যাই তাহলে কিভাবে বলি মনে পড়ে না? তাদের মনে হলেই এই যে চোখ ভিজে যায়, বুকের ভেতরটা খচ করে ওঠে, কতদিন তাদের দেখি না, বলে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে ওঠে, এতকিছুর পরও কি করে বলি, তাদের ভেবে আর কষ্ট পাই না! আসলে বিষয়টা সেখানেই তারা আছেন প্রতিটা হাহাকারে, প্রতিটা কান্নায়, প্রতিটা যন্ত্রণায়। পুরো অস্তিত্বজুড়ে আছেন মানুষগুলো। নেই শুধু সশরীরে। অথচ প্রতিটা পদক্ষেপে তাদের অভাব বোধ করি।
এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান, কত শত লোক আমরা কাজ করছি, সারাক্ষণ গমগম করছে ব্যস্ততায়। তবু যেন প্রাণহীন। শুধু একটা মানুষ নেই বলে। কি বিশাল শূন্যতা! দিন শেষে যেন একটাই কথা সব পরিবর্তন ঠিক আছে, শুধু যদি স্যার থাকতেন। ইদানীং মনে হয় স্যারের ছবি থেকে, নাম থেকে লুকিয়ে রাখি নিজেকে। সেখানে চোখ পড়লেই বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। কোনো কিছুই থেমে নেই, স্যার নেই বলে সব চলছে নিয়মমাফিক। শুধু প্রতিষ্ঠান আলো করে রাখা সেই হ্যাজাক বাতিটা নেই।
আসবেও না আর কখনো, জ্বলেও উঠবে না। দরাজ কণ্ঠে আর কখনো বলবে না, বল বা রাখ। কখনো বলবে না এই অমুককে মিলাও তো। রাগ হয়ে বকা দিয়ে একটু পরেই আর আদরমাখা কণ্ঠ ভেসে আসবে না। এতদিন অফিসটায় আসলেই কেমন অসহায় লাগত। মনে হতো কোথায় এলাম! এখন ধীরে ধীরে স্থির হয়েছি। সময় কখনো কারও জন্য থেমে থাকে না। চলে যাওয়া মানুষটার জন্য একটা হাহাকার থাকে সারাজীবন। মনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মানুষটার শূন্য জায়গাটা আর পূরণ হয় না। জীবন চলার মতো আরও কিছু রসদ জড়ো হয়। সময়ের সঙ্গে নতুন করে অনেক প্রিয় মানুষও যোগ হয়। আবার সেখানে নির্ভরতা আসে।
এখন ভেতর থেকে কে যেন বলে, স্যারের এই ভুবনটা যেন ঠিক থাকে, তার জন্য তোমাকে তোমার কাজটুকু পরিপূর্ণভাবে করতে হবে। এতজনের মাঝে, এত হৈচৈ-এর মাঝে থেকেও চারপাশটা কখনো খুব শূন্য লাগে, শুধু আপনি নেই বলে, স্যার। একটা মানুষের শূন্যতা এত ভয়াবহ হয়! মনে হয় যেন বিশাল এক ধু-ধু মরুভূমিতে একাই বসে আছি। শুধু নীরবে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই। আপনার আর আমাদের মাঝে দূরত্ব দিনকে দিন কমছে না, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে!
এ দূরত্ব কখনো বুকের ওপর চেপে বসে, পাহাড়সম ভার তার। এত আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় প্রত্যয়ে ভরপুর হাসিমাখা মুখটা, যার চোখের কোনেও থেকে যায় হাসির একটি ঝিলিক সেই মানুষটাই নেই। মাঝে মাঝে একাই কথা বলি ‘স্যার, কেমন আছেন আপনি? অনেক অনেকদিন আপনাকে দেখি না, অনেকদিন।’ দূরত্ব শুধু বেড়েই চলেছে। এত যে চাই না বাড়ুক, আমার চাওয়ায় কিছুই হচ্ছে না। সময়টাকে কেন আটকে রাখা যাচ্ছে না। এখনো হাহাকার লাগে।
আপনাকে নিয়ে মজার কোনো স্মৃতিচারণ করতে গেলেও চোখ ভিজে যায়, দীর্ঘশ্বাস আসে, থেমে যাই কতদিন হয়ে গেল! আর কেন ফিরে আসা যায় না! কয়েকদিন আগে সমুদ্র ভাইও চলে গেলেন আপনার পথে। এভাবে সবাই চলে গেলে ভরসা করার আর কেউ থাকবে না।
আপনি কি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন স্যার? আগে আপনাকে আমি অনুভব করতে পারতাম। মনে হতো আমার পাশেই আছেন। আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন। কান্না করলে আদর মেশানো শাসনের সুরে বলতেন এই, কান্না করছ কেন! এই যে আমি এখানে। ইদানীং মনে হয় পাই না। মলিন লাগে। আপনার হাসিটাও ম্লান মনে হয়। কেন দূরে চলে যাচ্ছেন স্যার? থাকেন না ছায়া হয়ে।
আমি এখন আপনার স্নেহের ছায়ায় বড় হওয়া মানুষগুলোর ছায়ায় আছি- সম্পাদকীয় বিভাগে। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কি নিশ্চিন্ত হয়ে আমায় রেখে চলে যাচ্ছেন? আমি তো কাউকে হারাতে চাই না স্যার। সবাইকে আঁকড়ে নিয়ে একসঙ্গে থাকতে চাই। থাকেন না পাশে, এতদিন যেমন ছিলেন- সবার বটবৃক্ষ হয়ে...
এবার জন্মদিনে আমাদের নির্বাহী সম্পাদক ওবায়েদ স্যার আপনাকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘আভিজাত্যের আবরণে সরল শুদ্ধ প্রাণ’ শিরোনামের স্মৃতিচারণমূলক লেখাটায় বলেছিলেন ‘চলনে, বলনে ছিলেন অভিজাত।
পোশাক-আশাকে পরিচ্ছন্ন। কথা বলতেন গুছিয়ে। বাইরে থেকে মনে হতো গম্ভীর, মেজাজি। ভেতরে খুবই সাধারণ, সরল শুদ্ধ প্রাণ।’ সত্যি তাই। কোনো রাখঢাক নেই। মনে যা, মুখেও তাই। আমাদের স্যার তেমনি ছিলেন। ওবায়েদ স্যার আরও লিখেছিলেন, ‘পড়াশোনার পাঠ শেষ করে জনকণ্ঠে চাকরি নিয়েছি। তাঁর সামনে বেড়ে উঠেছি একজন মানুষ এবং সাংবাদিক আমি। পেয়েছি হৃদয়ের উষ্ণতা। কখনো কঠোর প্রশাসক। কখনো পিতৃতুল্য অভিভাবক।’ স্যারের কথার রেশ ধরেই শেষ করব- কঠিন অবয়বের আড়ালে আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের মতো খুব সাধারণ, পরোপকারী ও স্বচ্ছ একটি মানুষকে পেয়েছিলাম আমরা।
যিনি শাসনের সঙ্গে ভালোবাসা দিতেও কখনো ভুল করতেন না। ছায়া হয়ে ছিলেন সবার মাথার ওপরে। আর এ কারণেই তিনি ছিলেন সবার এত প্রিয়। তাঁর আকস্মিক চির প্রস্থানের পর তাই গোটা জনকণ্ঠ ভবনে ছিল আহাজারি। তিনি আজ নেই আমাদের মাঝে। চোখের পলকে তিনটি বছর চলে গেল। তবু সকলের ভালোবাসায় তিনি অমর হয়ে আছেন। থাকবেন সব সময়। মহান রাব্বুল আলামিন এই মহান হৃদয়ের মানুষটিকে জান্নাতবাসী করুন।
লেখক : সাংবাদিক