ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

প্রসঙ্গ ইসলাম

কিংবদন্তি সালাহউদ্দিন আইয়ুবি

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ৯ নভেম্বর ২০২৩

কিংবদন্তি সালাহউদ্দিন আইয়ুবি

প্রসঙ্গ ইসলাম

২৭ রজব ৫৮৩ হিজরি। খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের হাত থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস দখলমুক্ত হওয়ার দিন। বীর সেনাপতি সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর যোগ্য নেতৃত্বেই মুক্ত হয়েছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কেবলা। অসংখ্য নবি-রাসুলের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান ও মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জায়গা বায়তুল মুকাদ্দাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐতিহাসিক মেরাজের রাতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসেই প্রথম সফর করেন। কুরআনুল কারিমে এ সফরের কথাই উঠে এসেছে (দ্র. সুরা বনি ইসরাঈল)।
প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) মেরাজ গমনের সময় এই মসজিদে সব নবী-রাসূলের ইমামতি করে নামাজ আদায় করেন। এ কারণেই তিনি ‘ইমামুল আম্বিয়া’ সব নবীদের ইমাম ও ‘সায়্যিদুল মুরসালিন’ সব রাসূলদের নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন। এই মসজিদে আকসা বহুকাল ধরে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির চারণভূমি ছিল। খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতের সময় ৬৩৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন পুরোপুরি মুসলমানদের অধিকারে আসে। কালের পরিক্রমায় ১০৯৯ সালের ৭ জুন খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে। 
১৫ জুলাই ১০৯৯ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম দখল করে। ঐদিন খ্রিস্টানরা বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে। মসজিদে ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে। ক্রুসেডাররা মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেদিন মুসলমানদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল পবিত্র আল কুদসের ভেতর ও বাহির। এভাবেই জেরুজালেমের ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। আর ক্রমাগত অব্যাহত থাকে জেরুজালেম, ফিলিস্তিন ও মসজিদে আকসার দখলদারিত্ব।

ফিলিস্তিনের মুসলিমরা একজন নেতার অপেক্ষায় দিন অতিবাহিত করছিল। যে নেতার নেতৃত্বে মুসলিমরা তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাবে। জিল্লতি, গোলামির জিঞ্জির ও নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে মুসলিম জাহান। মসজিদে আকসায় আবারও ধ্বনিতে হবে ইসলামের সুমহান আজান! সহসা আবির্ভূত হলো এক মহান মুসলিম সেনা নায়কের, যার নাম সালাহউদ্দীন আইয়ুবী!
খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের বায়তুল মুকাদ্দাস দখলের সময়কালীন একটি ঘটনা। ১০৯৯ সালের কোনো এক সময়। বায়তুল মুকাদ্দাস তখন খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের দখলে। সে সময় বাগদাদ শহরের এক কাঠমিস্ত্রি বসবাস করতেন। এ কাঠমিস্ত্রি মনের ভালোবাসা দিয়ে কারুকার্যমণ্ডিত একটি মিম্বার তৈরি করেন। মিম্বারটি সৌন্দর্যের কথা লোক মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর তা দেখতে মানুষ দলে দলে কাঠমিস্ত্রির বাড়িতে আসতে শুরু করে। অনেকেই মিম্বারটি কিনতে চায়। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তা বিক্রি করতে রাজি হয়নি। তার একই জবাব- এ মিম্বার বিক্রির জন্য নয়; বরং এটি বানিয়েছি মসজিদে আল আকসার জন্য। কাঠ মিস্ত্রির কথা শুনে সবাই হাসতো।

অনেকে তাকে পাগল বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল-অবিচল। একদিন এক ছোট্ট ছেলে তার বাবার হাত ধরে মিম্বারটি দেখতে এসেছিল। কাঠমিস্ত্রির কাছে তার স্বপ্নের কথাও জেনেছিল। সেদিনই ওই ছোট্ট ছেলেটি প্রতিজ্ঞা করেছিল সে কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন পূরণ করবে। সেই ছেলেটি আর কেউ নন, তিনি হলেন- বীর সেনাপতি সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। আর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের পর সেই মিম্বারটি এ মসজিদে স্থাপন করেছিলেন।
ইতিহাসে মুসলিম ও ক্রুসেডারদের মধ্যকার হিত্তিনের যুদ্ধকে এক চূড়ান্ত যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই যুদ্ধে ইসলামের বিরুদ্ধে জড়ো হওয়া ক্রুসেডীয় শক্তিকে পরাজিত করে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (র.) ইসলামী বিশ্বের এক বিজয়ী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।
হিত্তিনের যুদ্ধের পর ক্রুসেড বাহিনী বায়তুল মুকাদ্দাসে শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ক্রুসেডাররা গাজা এবং আসকালান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এরপর সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (র.) বিলাদুশ শাম একত্রীকরণ এবং ৮৮ বছর ক্রুসেডারদের দখলে থাকা জেরুজালেমকে মুক্ত করার লক্ষ্যে উত্তর জেরুজালেমের দিকে বাহিনীকে মার্চ করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সামরিক পরিকল্পনায় সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর দুর্দান্ত যুদ্ধ শক্তি প্রদর্শিত হয়েছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি জেরুজালেমকে পুনরুদ্ধার করতে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

এই পরিকল্পনাটি গড়ে উঠেছিল মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধের ওপর ভিত্তি করে। যার ফলে তিনি একটি শক্তিশালী ইসলামিক ফ্রন্ট গঠনে সক্ষম হয়েছিলেন। যে ফ্রন্টে মিসর, সিরিয়া ও ইরাকের একাংশ অংশগ্রহণ করেছিল। তারপর এই ইসলামিক ফ্রন্ট ক্রুসেডারদের আপন ভূমিতে ক্রুসেডারদের ওপর শক্তিশালী আঘাত হানতে থাকে। যার ধারাবাহিকতায় হিত্তিনের যুদ্ধে ক্রুসেডাররা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। তারপর সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (র.) ক্রুসেডারদের অর্থনীতি এবং ক্ষমতাকে দুর্বল করার লক্ষ্যে সিরীয় উপকূলবর্তী অঞ্চলের দিকে রওয়ানা করেন।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী যদি হিত্তিনের যুদ্ধের পরপরই উপকূলীয় অঞ্চল মুক্ত না করে জেরুজালেমের উদ্দেশে রওনা করতেন তাহলে হয়তোবা তিনি অনায়াসে জেরুজালেমকে দখল করতে পারতেন। তবে জেরুজালেমের পরিপূর্ণ স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা বজায় রাখতে পারতেন না। কারণ পশ্চিম ইউরোপ তখন সিরীয় উপকূলে সৈন্য প্রেরণ করতো। যারা জেরুজালেমকে মুক্ত করতে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সঙ্গে ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হতো। কারণ ইমামুদ্দিন ইস্পাহানির মতে, খ্রিস্টানদের বাতিল বিশ্বাস অনুযায়ী জেরুজালেমে যিশু ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। এখানেই তার দেহাবশেষ ও মূল ক্রুশটি অবস্থিত। আর এই শহরেই রয়েছে খ্রিস্টানদের সবচেয়ে প্রাচীন গির্জা।

সশস্ত্র ইসলামী জনতা সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সঙ্গে হিত্তিনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সশস্ত্র ইসলামি বাহিনীর উপস্থিতিকে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী উপকূলীয় এলাকা দখল করতে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। তারপরও সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মুসলিমদের প্রথম কিবলা নবীজির (সা.) মিরাজে গমনের স্থানকে পুনরুদ্ধারের জন্য পরিচালিত জেরুজালেম অভিযানে মুসলিমদেরকে আরও বেশি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের লক্ষ্যে, মূল অভিযানের পূর্বে মিডিয়া যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তৎকালীন সম্ভাব্য প্রচারমাধ্যমের সহায়তায় তিনি ইসলামি বিশ্বের কোনায় কোনায় মুসলিমদের জিহাদে বের হওয়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন।
শক্তি বাড়াতে মিসরীয় বাহিনীকে তলব : বিজিত শহরগুলোতে প্রভাব বাড়াতে এবং সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সহায়তার জন্য আপন পুত্র উসমানকে বাহিনীসহ ডেকে পাঠান। উসমান তার পিতার সঙ্গে আসকালানে এসে মিলিত হন। এতে করে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী স্বস্তি এবং শক্তি দুটোই লাভ করেন। 
অবরোধ এবং যুদ্ধ :  মুসলিম বাহিনী শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে সুসংগঠিত হওয়ার পূর্বেই ক্রুসেডার বাহিনী যুদ্ধ শুরু করে দেয়। ইসলামি বাহিনীর অকুতোভয় দুঃসাহসী একদল জানবাজ মুজাহিদকে জামালুদ্দীন শারবিন বিন হাসান রাযির নেতৃত্বে শহরের উপকণ্ঠে পাঠানো হয়। নগর রক্ষাকারী বাহিনীর একদল ক্রুসেডার জামালউদ্দীনের বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে পরাজিত করে। এই লড়াইয়ে জামালুদ্দিন (র.) শাহাদাতের সুধা পান করেন। (আবু সামা আল মুকাদ্দাসি, কিতাবুল রওদাতিন ২/৯২)। 
চূড়ান্ত আক্রমণ : সালাহউদ্দীন আইয়ুবী  শহরটিতে চূড়ান্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ইসলামি বাহিনী ক্রুসেডারদের দুর্গ রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি প্রবলভাবে মিনজানিকের গোলাবর্ষণ এবং মুষলধারে তীরবর্ষণ করতে থাকে। যাতে করে প্রতিরোধকারীরা তাদের অবস্থান থেকে সরে যায়। গোলাবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে একদল জানবাজ মুজাহিদ সীমানা প্রাচীরের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ১১৮৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সবচেয়ে বড় বাধা অতিক্রম করে নগর প্রাচীরের ওপর ইসলামি বাহিনী চড়তে সক্ষম হয়। নগর প্রাচীরে উঠেই মুজাহিদগণ ইসলামি পতাকা উড্ডয়ন করেন।

কালিমার পতাকা উড়তে দেখে নগর রক্ষাকারী বাহিনী এ কথা বিশ্বাস করে নেয় যে, আর মুসলিম বাহিনীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। আসলে তারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। তবে তারা তাদের একগুঁয়েমি চালিয়ে গেল। লোকজন গির্জায় জমা হয়ে প্রার্থনা করতে লাগল। নিজেদের পাপের কথা স্বীকার করে নিজেদের পাথর দিয়ে আঘাত করতে থাকে। তারা আল্লাহর কাছে রহমতের আশা করতে থাকে। মুসলিমদের হাতে বন্দি হওয়া থেকে বাঁচতে পুরুষদের উত্তেজিত করার লক্ষ্যে মহিলারা তাদের মেয়েদের মাথার চুল কর্তন করে দেয়।- (ইউসুফ আননাবায়ি, মাফরাযুল কারুব ২/২১৩)। 
বিজয়ী বেশে মসজিদুল আকসায় সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর প্রবেশ: ২৭ রজব ৫৮৩ হিজরি, জুমাবারে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মাসজিদুল আকসায় প্রবেশ করেন। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ক্রুসেডারদের অস্ত্র সমর্পণের পরেই বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেছিলেন। এটি একটি স্মরণীয় দিন ছিল। 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব 
[email protected]

×