
অর্থনৈতিক সংকটে দেউলিয়া ঘোষিত হয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া শ্রীলঙ্কা
গত জুলাই পর্যন্ত দেশটির প্রায় ৫ লাখ নাগরিক কাজের জন্য বিদেশে গেছেন, যাদের অনেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্যারামেডিক্যাল ও আইটি প্রফেশনাল। আর বিদেশে আগে থেকেই কর্মরত নাগরিকরা দেশে আরও বেশি হারে অর্থ পাঠিয়েছেন অর্থনৈতিক সংকট থেকে মাতৃভূমিকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করতে। ফলে রেমিটেন্স বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বেড়ে যাওয়ায় চলতি আগস্টে দেশটিতে কমেছে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ৬.৩ শতাংশ, যা অর্থনৈতিক সংকটে শুরুতে প্রায় ৭০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল।
দেশটির বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কা সরকার সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে অনেক খাতে কর বাড়ানো এবং অনেক খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো অজনপ্রিয় পদক্ষেপও নিয়েছে, যা জাতীয়তাবাদী চেতনায় বলীয়ান হওয়া জনগণ মেনে নিয়েছে। কিন্তু সবার আগে শ্রীলঙ্কার সরকারকে দেখাতে হয়েছে যে, তার সত্যিকারের সদিচ্ছা আছে মন্দা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের। আর এ বিষয়টিই রাষ্ট্রপরিচালনায় নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের মানুষের জন্য বড় এক শিক্ষা হতে পারে
অর্থনৈতিক সংকটে দেউলিয়া ঘোষিত হয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া শ্রীলঙ্কা অবিশ্বাস্যভাবে ১৫ মাস পরে এসে সেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছেই অনেকটা ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠেছে। দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসমাগ্রীর জন্য নাগরিকদের হাহাকার কমে গিয়ে জীবনযাত্রা ক্রমশই স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও সাহস সঞ্চার করছে। দেশটির অর্থনীতির এই উত্তরণের সুবাতাস বাংলাদেশকেও অনেক স্বস্তি এনে দিয়েছে। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে থাকা বাংলাদেশকে দেশটি ঋণের টাকা ফেরত দিতে শুরু করেছে, যা কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাংলাদেশের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল।
এক বছর মেয়াদের চার কিস্তির ২০০ মিলিয়ন ডলারের ওই ঋণের মধ্যে ৫০ মিলিয়ন ডলার গত আগস্টে বাংলাদেশকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। সেপ্টেম্বরে আরও ৫০ মিলিয়ন ডলার ফেরত দেওয়া হবে। এছাড়াও দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার আগস্টে ৬.৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা সরকারি হিসাবে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং গত মে মাসে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। শ্রীলঙ্কার এত দ্রুত হারে ঋণ ফেরত দেওয়া এবং মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা অর্থ বিশ্লেষকদের অনেককেই বিস্মিত করেছে। কিভাবে দেশটি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সেদিকে এখন সবাই গভীর নজর রাখছে। সবার ধারণা বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে শীঘ্রই দেশটির অর্থনীতি আবারও শক্তিশালী ধারায় ফিরে আসতে পারে। তবে বিদেশী ঋণের ব্যবস্থাপনার ওপরই দেশটির ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান এই প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের জন্যও নানা কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো সংকটে পড়া থেকে বেশ দূরে থাকলেও উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় এই দুই দেশের মধ্যে অনেক কিছুতেই সাদৃশ্য আছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের মুখে পড়েছিল। শ্রীলঙ্কা পড়েছিল গৃহযুদ্ধের কবলে। সামরিক শাসন ও গৃহযুদ্ধ থেকে মুক্ত হয়ে অগ্রগতির দিকে অগ্রসর হলেও এখনো এই দুই দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রায়ই বিদেশী ঋণের দ্বারস্থ হতে হয়। আর এই বিদেশী ঋণনির্ভরতাই দুই দেশের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বের মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংগত কারণেই শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হওয়া ও ঘুরে দাঁড়ানোর চলমান চেষ্টা গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
এখন থেকে দেড় বছর আগে বিদেশী মুদ্রার অভাবে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। আর্থিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার জেরে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছিল দেশটিতে। এক পর্যায়ে জনগণের রোষানলে পড়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকশেসহ নিকটাত্মীয়দের দেশ থেকে পালাতে হয়েছে। বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত সেই দুঃসময়ে অবস্থা এমন হয়েছিল যে, দেশটির হাসপাতালগুলো জীবনরক্ষাকারী ওষুধ এবং জ্বালানির অভাবে অপারেশন কক্ষের আলো ও যন্ত্রপাতি চালাতে না পেরে রোগীদের ফিরিয়ে দিচ্ছিল। সাধারণ মানুষ তেল-এলপি গ্যাস কিনতে না পেয়ে রান্না বন্ধ করে দিয়েছিল। মানুষের ঘরে আলো জ্বলছিল না।
কাগজের অভাবে স্কুল-কলেজেও পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পর্যটকদের কাছে আকষর্ণীয় অপূর্ব সুন্দর দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কায় ওষুধ, খাদ্য ও তেলের জন্য দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সেই দুর্ভোগ দেখে বিশ্ববাসী খুবই ব্যথিত হয়েছিল। আর শ্রীলঙ্কার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সংকটের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যত্রও। সেই বিপর্যস্ত পরিস্থিতি এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে দেশটি। অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি পর্যটন ও বিদেশে কর্মরত নাগরিকদের কল্যাণে জ্যামিতিক হারে এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। পণ্যের দাম কিছুটা বেশি থাকলেও তা জনগণের নাগালের মধ্যে রয়েছে। ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর বাজার এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক ধারা অনুকূল হতে শুরু করলেও সবকিছু আগের ধারায় নিতে হলে আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন হবে। চরম দুর্দশায় পড়া অর্থনীতির জন্য যা খুবই স্বাভাবিক। তারা বলছেন, সরকারি নীতি, সদিচ্ছা এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে উদ্যোগী হওয়াই মূলত বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। তবে গত দেড় দশক ধরে অর্থনীতিতে সৃষ্ট পুঞ্জীভূত সমস্যা এখনো রয়ে গেছে, যা দূর হতে কিছুটা সময় লাগবে।
আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, সংকট থেকে উত্তরণের পথে হাঁটলেও দেড় বছর ধরে শ্রীলঙ্কা যে সংকট মোকাবিলা করছে তার অন্যতম কারণ ছিল বিপুল বিদেশী ঋণ, বিশেষত স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ বা সার্বভৌম বন্ড। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে দেদারসে নেওয়া এই বৈদেশিক ঋণই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে চূড়ান্ত মারণাঘাত হেনেছিল। ২০০৭ সাল থেকে দেশটির সরকার আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি হওয়ায় সার্বভৌম বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্য অর্থ জোগাতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে বৈদেশিক মুদ্রায় বিক্রি করা সার্বভৌম বন্ডের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ডলারের দাম বাড়লে ক্রেতাকে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়।
সংকটের কিছুদিন আগে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে শ্রীলঙ্কাকে এই সার্বভৌম বন্ডের জন্য দিতে হয়েছে বেশি অর্থমূল্য। ফলে ২০২২ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক দেনার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এক দশক ধরে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর নীলনকশার আলোকে প্রণীত নতুন ধারার নীতিমালার কারণে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যিক ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করে। শ্রীলঙ্কাও সেখানে শামিল হয়েছে। নিয়ন্ত্রিণহীন পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নির্বিচারে নেওয়া ঋণ ও বন্ডের অর্থ কিভাবে শোধ করা হবে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করেই শ্রীলঙ্কার সরকার সামনে এগোচ্ছিল।
অর্থনীতিশাস্ত্রের দৃষ্টিতে, ঋণ ও সুদের কারবারিদের আর্থিক উন্নতি যত দ্রুতলয়ে ঘটে, ঋণ গ্রহণকারীর উন্নতি তত দ্রুত না হওয়ায় ঋণ দেওয়া-নেওয়ায় একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা সবসময় ঋণ প্রদানকারীর অনুকূলে যায়। এই সুযোগে ঋণ প্রদানকারীর আর্থিকীকরণকৃত ব্যবস্থা ঋণ গ্রহণকারীকে ধীরে ধীরে দেউলিয়া হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়। বাজেটের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে বিপুল বিদেশী ঋণ নেওয়ায় শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটেছে। স্বাধীনতা পাওয়ার ৭৫ বছর পরে এসে দেশটি প্রথমবারের মতো আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কা বিদেশী ঋণের বলি হওয়ার ক্ল্যাসিক এক উদাহরণ।
করোনাপরবর্তী প্রেক্ষাপট ও বিদেশী ঋণ দেশটির অর্থনীতির বিপর্যয়কে নিশ্চিত করেছিল ঠিকই, কিন্তু সরকারের নানা ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্তও এখানে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে, যা আসলে বিদেশী ঋণে সৃষ্ট আর্থিকীকরণকৃত ব্যবস্থারই একটি অংশ। যেমনÑ ২০১৯ শেষার্ধে অনেককে বিস্মিত করে দেশটির সরকার অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের নামে ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করার ফলে সরকারের রাজস্ব আয় সে সময় ২৫ শতাংশ কমে যায়। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণের কারবারিদের পাতা ফাঁদ অনুযায়ী সরকার আরও ঋণ নেয় এবং সার্বভৌম বন্ড বিক্রি শুরু করে।
কাকতালীয়ভাবে এ সময় করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশটির অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যেও ধস শুরু হয়। ফলে অনেক দেশের মতো দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার মূল উৎস পর্যটন ও বিদেশে কর্মরত নাগরিকদের পাঠানো রেমিটেন্সেও দেখা দেয় বিপর্যয়। করোনার আগে যে পর্যটন ও রেমিটেন্স থেকে শ্রীলঙ্কার প্রতিবছর ১২ বিলিয়ন ডলার আয় হতো তা কমে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এছাড়াও ২০১৯ সালে সরকারের কৃষি খাতে রাসায়নিক সার-কীটনাশক ব্যবহার ও আমদানি নিষিদ্ধ করে অর্গানিক কৃষির প্রবর্তন আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো বিষয় হয়ে দেখা দেয়। ধারণা করা হয়, অর্গানিক কৃষি চালু করার পেছনেও ঋণ কারবারিদের চাপ ছিল। নতুন কৃষি ব্যবস্থায় প্রধান শস্য চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে যায়। ফলে এক সময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয়ে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করে।
বাজারে চালের দামও হু হু করে বেড়ে যায়। দেশটির চা উৎপাদন কমে যাওয়ায় চা রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও বড় ধাক্কা লাগে। উত্তেজিত কৃষকদের ক্ষোভ প্রশমনে ক্ষতিপূরণস্বরূপ ঋণ করা টাকায় সরকার ২০০ মিলিয়ন ডলার প্রণোদনা প্রদান করে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দেশের অর্থনীতিতে এমন সংকট দেখা দিলেও ‘ভরপেট না-ও খাই, ঋণের টাকা দেওয়া চাই’ এর মতো বিদেশী ঋণের অর্থ পরিশোধের বাধ্যবাধকতাও দেশটিকে এ সময় কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়েছে। এক পর্যায়ে ঋণের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় সার্বভৌম রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর প্রথমবারের মতো নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া বা ‘ফকির’ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থার জন্য মৌলিক এক শিক্ষা হিসেবে অভিহিত করা যায়। অভ্যন্তরীণ কারণে সৃষ্ট সংকট অভ্যন্তরীণ ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু বাইরের কারও কাছ থেকে ঋণ নিয়ে উন্নতি করার চেষ্টা সব সময়ই যে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত শ্রীলঙ্কা সবাইকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে। মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশটির ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে বিদেশী ঋণ নয়, সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতি ও সদিচ্ছা মূল ভূমিকা রেখেছে। যেখানে মধ্যবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির বিদেশে কাজের জন্য ছুটে যাওয়া, ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং পর্যটনের খাতের উদ্যোগী ভূমিকা সবাইকে প্রেরণা জুগিয়েছে।
সরকার ও জনগণের ঘুরে দাঁড়ানোর ঐকান্তিক চাওয়ার মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়ের ফলেই পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতির পথে ফিরে আসতে শুরু করেছে। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই কিছু খাতে ব্যাপক সংস্কার ও কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের পাশাপাশি আইএমএফের সঙ্গে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের একটি ‘বেইল আউট প্যাকেজ’ নিয়ে আলোচনা শুরু করে অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহের সরকার। চলতি বছরের মার্চে আইএমএফ বোর্ড ঋণ অনুমোদন করে। এরপর খাদ্য, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম সামান্য কমানোর চেষ্টা করে জনজীবন সহজ করার চেষ্টা করে সরকার। এ সময় কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করে ২৩ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়।
এছাড়াও অপ্রয়োজনীয় কর্মকা- ও অদরকারী প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সরকারের পরিচালন ব্যয়ও কমিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি চলে প্রয়োজনীয় খাতে করজাল বিস্তৃত করে কঠোরভাবে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ সময় কার্যকরভাবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে। আমদানি নীতি পরিবর্তন ছাড়াও অর্থনীতিকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। নতুন সরকার দেশ থেকে পালানো রাজাপাকশের সরকারের নেওয়া অনেক সিদ্ধান্ত বাতিল করে কৃষি ও কৃষি বহির্ভূত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বাড়াতেও সচেষ্ট হয়। এসবের ফলে বিদেশী মুদ্রার জোগান অনেকগুণ বেড়ে যায়।
সরকারের এ ধরনের সদিচ্ছা বেসরকারি খাতেও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। ঘুরে দাঁড়ায় পর্যটনের মতো বেসরকারি খাত। গত এক বছরে পর্যটন খাত থেকে শ্রীলঙ্কার আয় বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। এ সময় দেশটির মধ্যবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত বিপুল পরিমাণ দক্ষ ও আধা দক্ষ নাগরিক বিদেশে গেছেন কাজের জন্য। গত জুলাই পর্যন্ত দেশটির প্রায় ৫ লাখ নাগরিক কাজের জন্য বিদেশে গেছেন, যাদের অনেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্যারামেডিক্যাল ও আইটি প্রফেশনাল। আর বিদেশে আগে থেকেই কর্মরত নাগরিকরা দেশে আরও বেশি হারে অর্থ পাঠিয়েছেন অর্থনৈতিক সংকট থেকে মাতৃভূমিকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করতে। ফলে রেমিটেন্স বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বেড়ে যাওয়ায় চলতি আগস্টে দেশটিতে কমেছে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ৬.৩ শতাংশ, যা অর্থনৈতিক সংকটের শুরুতে প্রায় ৭০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল।
দেশটির বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কা সরকার সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে অনেক খাতে কর বাড়ানো এবং অনেক খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো অজনপ্রিয় পদক্ষেপও নিয়েছে, যা জাতীয়তাবাদী চেতনায় বলীয়ান হওয়া জনগণ মেনে নিয়েছে। কিন্তু সবার আগে শ্রীলঙ্কার সরকারকে দেখাতে হয়েছে যে, তার সত্যিকারের সদিচ্ছা আছে মন্দা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের। আর এ বিষয়টিই রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের মানুষের জন্য বড় এক শিক্ষা হতে পারে।
পরিশেষে বলব, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে বাংলাদেশের সরকার সাম্প্রতিক সময়ে নানা সূত্র থেকে ঋণ নিচ্ছে।
বিদেশী ঋণ ও করোনাভাইরাসের অভিঘাত এবং ভূরাজনৈতিক বিষয়াবলি শ্রীলঙ্কাকে চূড়ান্তভাবে ‘ফকির’ করে দিলেও আর্থ-রাজনৈতিক খাতে ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হওয়া সমস্যা দেশটির সংকটকে পাকাপোক্ত রূপ দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা বাংলাদেশে সৃষ্টি না হলেও কিছু কিছু লক্ষণ আমাদের দেশেও আছে, সে কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিদেশী ঋণ নেওয়া, তা খরচ করা; ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা এবং সরকারি পরিচালন ব্যয়ের বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। শ্রীলঙ্কা কিভাবে চলছে সেদিকে আমাদের অর্থ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকরা সজাগ দৃষ্টি রাখবে এবং দ্রুত ভুল-ত্রুটি কাটিয়ে উঠবেÑ সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি