
প্রসঙ্গ ইসলাম
দানবীর হাতেম তাঈয়ের নাম শোনেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকে তাকে কেবল উপকথার চরিত্র হিসেবেই মনে করেন। অথচ তিনি সত্যিকারের রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন। তার পরোপকার আর মহৎ হৃদয়ের গল্প এতটাই অবিশ্বাস্য যে তিনি স্থান পেয়েছেন ইতিহাস, উপকথার পাতায়।
হাতেম-আল-তাঈয়ের পুরো নাম হাতেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবন সাদ আত-তাঈ। অর্থাৎ বাবার নাম আব্দুল্লাহ। দাদা সা’দ আবু সাফফানা ছিলেন তাঈ বংশের। তাঈ বংশ বাস করত সৌদি আরবের উত্তর পশ্চিম কোনে ‘হাইল’ নগরীতে। তাঈ বংশ ছিল আরবের হাইল অঞ্চলের শাসক- কর্ণধার। তারা ছিল আরব খ্রিস্টান। যদিও বাংলাতে প্রচলিত কাহিনী পড়লে অনেকের এই ধারণা থাকতে পারে, হাতেম তাঈ বুঝি মুসলিম ছিলেন। ইয়েমেন থেকে তাদের আগমন। হাতেম তাঈ যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন মুহাম্মাদ (সা.) এর বয়স ছিল মাত্র আট বছর। সেটা ছিল ৫৭৮ সাল। বহু বছর পর ৬৩০ সালে তাঈ বংশ থেকে পৌত্তলিকতা অপসারণের জন্য আলী (রা.)-কে প্রেরণ করেন মুহাম্মাদ (সা.)। হাইল বিজয় করে মুসলিম বাহিনী। তখন হাতিম পুত্র আদি নিজেই নবী (সা.)-এর কাছে আসেন। আদি তার পিতা হাতেম তাঈয়ের কথা জানালেন, নবীজী তাকে আগেই চিনতেন, যদিও ইসলাম আসবার আগেই হাতেম দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। নবীজী বললেন, ‘তোমার বাবা স্মরণীয় হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন।’
এরপর তিনি আদিকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান করলেন। তিনি তাই করেন। সঙ্গে সঙ্গে সকল যুদ্ধবন্দী এবং হাইলবাসী ইসলাম গ্রহণ করেন।
কথিত আছে, যখন হাতেমের মা গর্ভবতী হন তখন স্বপ্নে দেখেন তাকে বলা হচ্ছে, তুমি কি দশজন গড়পড়তার সন্তান চাও, নাকি একজন উদার সন্তান চাও? তিনি উদার সন্তান চাইলেন। এভাবেই নাকি হাতেমের জন্ম হয়। তার মা গুনাইয়া বিনতে আফিফ তাঈয়াও ছিলেন অসাধারণ দানশীলা নারী। তার থেকেই এই গুণটা পান হাতেম। খুব ছোট বয়সেই বাবা আব্দুল্লাহকে হারান হাতেম। এরপর দাদা সা’দের কাছে বড় হন তিনি। শহরের আর বাকি শিশুর সঙ্গেই বেড়ে উঠতে লাগলেন হাতেম। জীবনে কোনোদিন কোনো গালি মুখে আনেননি। সকলের প্রতি ছিলেন দয়ালু। রাজ্যের সকলেই তাকে বড্ড ভালোবাসত। দাদা মারা গেলে রাজা হন রাজপুত্র হাতেম তাঈ।
হাতেমের দানশীলতার গল্প দেশ বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। বাইজান্টাইন সম্রাট এই ঘটনার সত্যতা পরীক্ষা করতে চাইলেন। তিনি শুনেছিলেন, হাতেম আর যাই বিলিয়ে দিক না কেন, কখনোই তার ঘোড়া দেন না, এটা নাকি তার খুব প্রিয়। সম্রাট দরবার থেকে এক লোককে পাঠালেন। লোকটি যখন হাতেমের বাসায় পৌঁছালো তখন রাত। আর সেটা এমন মৌসুম ছিল যে সব ঘোড়া অনেক দূরে এক অঞ্চলে চড়াতে নিয়ে যেতে হতো। বাসায় হাতেমের নিজের ঘোড়া বাদে আর কোনো ঘোড়া ছিল না। রাতে ভালো মতই আপ্যায়ন করলেন হাতেম। লোকটি মুগ্ধ হয়ে গেল।
পরদিন সকালে লোকটি হাতেমকে বলল, সম্রাট হাতেমের ঘোড়াটি চেয়েছেন। হাতেম সঙ্গে সঙ্গে বিচলিত হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘কাল রাত্রে এসেই এই কথা বললেই পারতেন! আমি তো আপনার আতিথেয়তার জন্য এ বাসায় থাকা একমাত্র ঘোড়াটি জবাই করেছি কাল, ওটাই আমার ঘোড়া ছিল, আমি চাইনি একজন অতিথি আসবেন আর ভালোমন্দ খাওয়াতে পারব না!’ উল্লেখ্য, আরবে জনপ্রিয় খাবার ছিল ঘোড়ার মাংস। হাতেম তার সেরা ঘোড়াগুলো লোকটিকে দিয়ে দিতে চাইলেন। পুরো ঘটনা শুনে সম্রাট একমত হলেন, হাতেমের চেয়ে দানশীল আর কেউ হতে পারে না।
ওদিকে আরো একজন আরব রাজা নওফেল হাতেম তাঈর রাজ্য কেড়ে নিতে চাইতেন। তিনি হাতেমের কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বান করে পত্র দিলেন। সকলেই বললেন, এ রাজ্যের অনেকেই আপনার জন্য রক্ত দেবে জীবন দেবে, আমরা যুদ্ধ করব। কিন্তু হাতেম বললেন, তিনি তার জন্য একজনকেও রক্ত ঝরাতে দেবেন না।
হাতেম রাজ্য ত্যাগ করে এক গুহায় চলে গেলেন, আর সেখানেই একাকী বাস করতে লাগলেন। ওদিকে রাজা এসে রাজাহীন রাজ্য দখল করে নিলেন বিনা রক্তপাতে। কিন্তু অনুভব করলেন যে, সবার আনুগত্য আসলে আগের রাজা হাতেমের প্রতিই। তিনি ঘোষণা করলেন, যে হাতেমকে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে ৫,০০০ স্বর্ণমুদ্রা দেয়া হবে। ঘটনাক্রমে হাতেম যেখানে থাকতেন, তার কাছেই এক কাঠুরে পরিবার থাকত। একদিন ছদ্মবেশী হাতেম শুনলেন, কাঠুরে বলছে স্ত্রীকে, ‘আমি তো এখন বুড়ো, আমরা যদি হাতেমকে ধরে দিতে পারতাম তাহলে অন্তত বাচ্চাগুলোর জন্য কিছু করে যেতে পারতাম।’ তখন স্ত্রী তাকে কড়া ভাষায় এ জঘন্য কথা বলবার জন্য শাসায়।
এ কথাগুলো চলবার সময়ই হাতেম নিজেকে প্রকাশ করে বললেন, ‘এই নাও, আমি ধরা দিচ্ছি, এতে যদি তোমার পরিবারের উপকার হয়, তবে এ মৃত্যুতেই সার্থকতা।’ বুড়ো লোকটি লজ্জায় শেষ হয়ে গেল, ‘না না, আমি এ কাজ পারব না।’ তার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল।
ওদিকে আশপাশের লোকজন হাতেমকে দেখে তাকে বেঁধে ফেলল এবং অর্থলোভে তাকে রাজার কাছে নিয়ে গেল। পেছন পেছন গেল সেই কাঠুরে। সকলে দাবি করতে লাগল যে সে নিজেই হাতেমকে ধরেছে। আর হাতেম ও কাঠুরে নীরবে দেখতে লাগল। অবশেষে হাতেম নিজেই বললেন, ‘সকলের সামনে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, এই কাঠুরে লোকটিই আমাকে ধরেছে, তাকে ৫,০০০ সোনার মুদ্রা দেওয়া হোক।’ রাজা এতটাই অবাক হলেন হাতেমের কথাতে যে তিনি হাতেমকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন আর তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে চলে গেলেন। বৃদ্ধ কাঠুরিয়াকে বাদশা যথেষ্ট পুরস্কার দিলেন।
হাতেম তাঈর প্রথম স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেন তার দুই ছেলে আব্দুল্লাহ এবং আদি ইবনে হাতেম তাঈ এবং এক কন্যা সুফানা। যতদিন স্ত্রী বেঁচে ছিলেন তিনি আর বিয়ে করেননি। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ঘাসানের রাজকন্যা মারিয়া হন হাতেম তাঈর দ্বিতীয় স্ত্রী। হাতেম নিজে কবি মানুষ ছিলেন। হাতেম যখন মারা গিয়েছিলেন তখন তার কবর হয় এক পাহাড়ের চূড়ায়। তার কবরের ওপর দুটো পাথরের পাত্রের আকারে ভাস্কর্য বানানো হয়, যা তার দানশীলতা প্রকাশ করে, যে পাত্র থেকে তিনি গরিবদের খাওয়াতেন। হাতেম তাঈ মারা যাওয়ার পর রাজা হন তার ছেলে আদি ইবনে হাতিম। খ্রিস্ট ধর্মের পাশাপাশি তারা মূর্তিপূজাও শুরু করে দেয়। তার রাজত্বের শেষ দিকে এসে তিনি আবারো তাঈ বংশের হাইল রাজ্য হারাবার আশংকায় পড়েন আরেকজন আরব নেতার কাছে। সে আরব নেতা আর কেউ নন, ইসলাম ধর্মের শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)।
৬৩০ সালে হাইল বিজয় করে মুসলিম বাহিনী। আর রাজপরিবার ও তাঈ সেনাবাহিনী যুদ্ধবন্দী হয়ে পড়ে। রাজা আদি ইবনে হাতিম তাঈ পালিয়ে সিরিয়া চলে যান। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিলেন সুফানা, হাতিমের কন্যা। সুফানা নবীর কাছে অনুরোধ করেন ভাইকে খুঁজতে যাওয়ার অনুমতি দিতে। মুহাম্মাদ (সা.) হাতেম তাঈর বদান্যতা স্মরণ করে তাকে ভালো কাপড় চোপড় দিয়ে, টাকা পয়সা আর ভালো বাহন দিয়ে পাঠান। যেদিন তিনি তার ভাই আদিকে খুঁজে পান, তখন আদি বিশ্বাস করতে পারেননি সুফানার এত ভালো অবস্থা দেখে। তখন আদি নিজেই নবী (সা.)-এর কাছে আসেন। তিনি ভেবেছিলেন কোনো প্রাসাদ দেখবেন। কিন্তু দেখলেন সামান্য এক মসজিদ। নবীজী (সা.) তার শত্রু আদি ইবনে হাতিম (রা)-কে বসালেন কুশনে, সেই কুশন আবার সামান্য খেঁজুর পাতাতে তৈরি। আর নবীজী (সা.) নিজে বসলেন মাটিতে। বললেন, ‘তুমি প্রজাদের থেকে ২৫% খাজনা চাও, তাই না?’ আদি বললেন, ‘হ্যাঁ।’
নবীজী বললেন, ‘এটা কিন্তু তোমার ধর্মে অবৈধ।’ আদি বললেন, ‘তা ঠিক।’ এরপর তিনি আদি-কে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান করলেন। তিনি তাই করেন। সঙ্গে সঙ্গে সকল যুদ্ধবন্দী এবং হাইলবাসী ইসলাম গ্রহণ করেন। অবশ্য কবি জুহাইরের লেখনি থেকে জানা যায়, হাতেম তাঈ নাকি তার খ্রিস্ট ধর্মগ্রন্থ থেকে ধারণা লাভ করে আগে থেকেই তার সন্তানদের আসন্ন আরবীয় নবীর বিষয়ে বলে গিয়েছিলেন। দু’বছর পর মুহাম্মাদ (সা.) এর ওফাত হলে আরবের কিছু গোত্র ইসলাম ত্যাগ করে। কিন্তু হাতেম তাঈয়ের গোত্র এই কঠিন সময়েও মুসলিম থেকে যায়। বরং তারা আলী (রা.) এর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে ছিল।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব [email protected]