
আমাদের এখানেও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছিল
আমাদের এখানেও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছিল। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ‘সুশিক্ষিত’ ‘সম্মানীয়’ কিছু মানুষ এক হয়েছিলেন। তারা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব কমানোর কথা বলেছেন। রাজনৈতিক হানাহানি, অসহিষ্ণুতা, সংকীর্ণতা ইত্যাদি ঘোচাতে কাজ করবেন বলেছেন। দু’দলের ব্যর্থতা ধরিয়ে দেবেন। প্রচলিত ক্ষমতার রাজনীতির কাছে জিম্মি দেশের মানুষের আকাক্সক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে বড় ইস্যুতে তাদের হয়ে কাজ করবেন। তারা হয়ত ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কর্মসূচি পালন করতে কিভাবে মাঠে নামবেন তা বোঝাতে পারেননি। সংগঠিত হওয়ার পরও তাদের প্রবীণ শ্রদ্ধেয় এক সদস্য একটি ইস্যুতে একাই শহীদ মিনারে প্রতিবাদে নেমেছিলেন
উনিশ শ’ বিরাশি সালে স্যার এ্যাটেনবরো ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্র বানিয়ে দেশ-বিদেশের অনেক দর্শকের মনোযোগ কেড়েছিলেন। মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীর জীবনীনির্ভর এ চলচ্চিত্র নিউইয়র্ক চলচ্চিত্র সমালোচকদের বিচারে বছর সেরার পুরস্কার পেয়েছিল। এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে চার দশকেরও বেশি সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা গান্ধীর অহিংস নীতি চলচ্চিত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। কাহিনীর বিস্তৃতি উনিশ শ’ চৌদ্দ থেকে আটচল্লিশ সাল। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাস গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ্যাটেনবরো গান্ধীর অহিংসার প্রতি জোর দিয়েছেন। যেমনটা ইতিহাসে তাঁর ভাবমূর্তি নির্মিত হয়েছে। যদিও দুর্মুখেরা তাঁর চরিত্রে অহিংসার বৈপরীত্যও খুঁজে পান।
তারা বলেন, প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইংরেজ সৈন্যদের সেবার জন্য এ্যাম্বুলেন্স কোর গঠন করেছিলেন এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগও নিয়ে ছিলেন। বিদেশী বেসামরিক নাগরিকের সেবা নিতে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তারা আপত্তি জানালে তাঁর সে উদ্যোগ সফল হয়নি। গত শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় আইন পেশায় জড়িত থাকা গান্ধী বিশ্বযুদ্ধ শুরুর চার মাস পর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফেরেন। তারপর তো রাজনীতির নানা অভিঘাত এবং শেষ পর্যন্ত অহিংস ইমেজ।
গান্ধী মারা যাওয়ার সাঁইত্রিশ বছর পর এ্যাটেনবরো তাঁর জীবনীনির্ভর চলচ্চিত্র বানান। আমাদের এখানে তখন দ্বিতীয় দফায় সেনা শাসন শুরু হলেও প্রচারমাধ্যমের গগনভেদী দাপট শুরু হয়নি। দিন গেছে, সেনাশাসনের প্রতি বিন্দু বিন্দু ক্ষোভ জমে শেষে বিস্ফোরণ ঘটে নব্বইয়ে। বিরাশী সালের পর কেটেছে অনেক বছর। হঠাৎই যেন ফিরেছিল অহিংসার বাণী। শহীদ মিনারে মোম জ্বালানো, অনশন, মানববন্ধন ইত্যাদি তো ছিলই। আন্দোলনের মস্ত বড় মাঠ হয়ে এলো টেলিভিশন। নানা বিষয়ে প্রাজ্ঞ তার্কিক-বিশ্লেষকরা মাতিয়ে রাখেন সে মাঠ। শ্রোতা দর্শক মধ্যবিত্ত ভদ্রজনরা। ঠিক সন্ধ্যায় নয়, রাত একটু ঘনিয়ে এলে আসর জমে। তখন শুধু রিমোটের বাটন টেপা আর নিজেকে ‘সমৃদ্ধ’ করা। এ আরামের ওম প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছে যে রাজনীতির আসল উৎস অন্যখানে। আরামহীন জনস্রোত বয়ে চলেছে যেখানে। সেখান থেকেই এসেছে বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর ও নব্বই।
ইউরোপ-আমেরিকার বেকারদের আন্দোলন, আরব বসন্ত, অহিংস আন্দোলনে নোবেল বিজয় কিংবা দুর্নীতিবিরোধী অহিংসতায় অনেকে প্রাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু এসবই সাময়িক বিভ্রম। পুঁজিবাদ সংকটে পড়েছে এবং তা কাটাতে নানা ধরনের কৌশল নেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু জনগণের কাছে যাদের যাওয়ার কথা তারা কৌশল বদলাতে পারছেন না। পুরনো সীমানায় ঘুরপাক খাচ্ছেন। তাদেরও কৌশল বদল প্রয়োজন তা কি তারা উপলব্ধি করতে পারছেন? অন্যদিকে আরেক দল করপোরেট তন্ত্রের বিভঙ্গে কেবলই মোহগ্রস্ত হচ্ছেন।
গান্ধীর অহিংসাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে কয়েক বছর আগে ভারতে মাঠ গরম করেছিলেন আন্না হাজারে। জনলোকপাল বিল নিয়ে কসরত করেছেন। আগস্টে শুরু করে মাঝে সরকার নমনীয় হওয়ায় একটু থেমে ছিলেন। তারপর আবার জেগেছিলেন। শরীরে কুলোচ্ছিল না বলে সেবার পূর্ণদৈর্ঘ্য অনশনের ঝুঁকি না নিয়ে প্রতীকী অনশন সেরেছিলেন। লোকপাল বিল আরও কঠোর করার দাবি করছেন। মহারাষ্ট্রের দুর্নীতিবিরোধী এ নেতা দিল্লির যন্তর মন্তরে গিয়ে ‘হীরক রাজার দেশে’র পাগলা বিজ্ঞানীর যন্তর মন্তরের মতো কিছু মানুষের মাথা ঘোরাতে পেরেছিলেন এবং প্রতি মুহূর্তে সে খবর ওয়েবে ছড়িয়েছে। কিন্তু মহারাষ্ট্রে লেগে থাকা ছোট-বড় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে কখনো তিনি ছিলেন এমন খবর কোথাও পাওয়া যায়নি। অথবা অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা করে মাঠে নেমেছেন এমন খবরও ছিল না।
দুর্নীতিপরায়ণ কিছু মন্ত্রী এবং আমলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেও দীর্ঘদিনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গোটা আর্থসামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেননি কখনো। যে সিস্টেম মন্ত্রী-আমলাদের সামনে দুর্নীতির দরজা খুলে দেয় তা নিয়ে তিনি ভাবেননি। অবশ্য এসব ভাবলে তিনি হয়তো সেলিব্রিটি হতেনই না। রামলীলা ময়দানে অনশন, দলিত ও মুসলিম শিশুর হাতে পানি খেয়ে অনশন ভাঙ্গা ইত্যাদি খবরের চটকদার ফেইসভ্যালুর কাছে মতাদর্শিক লড়াইয়ের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের চিত্র বড় ম্লান।
আমাদের এখানেও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছিল। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ‘সুশিক্ষিত’ ‘সম্মানীয়’ কিছু মানুষ এক হয়েছিলেন। তারা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব কমানোর কথা বলেছেন। রাজনৈতিক হানাহানি, অসহিষ্ণুতা, সংকীর্ণতা ইত্যাদি ঘোচাতে কাজ করবেন বলেছেন। দু’দলের ব্যর্থতা ধরিয়ে দেবেন। প্রচলিত ক্ষমতার রাজনীতির কাছে জিম্মি দেশের মানুষের আকাক্সক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে বড় ইস্যুতে তাদের হয়ে কাজ করবেন। তারা হয়ত ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কর্মসূচি পালন করতে কিভাবে মাঠে নামবেন তা বোঝাতে পারেননি।
সংগঠিত হওয়ার পরও তাদের প্রবীণ শ্রদ্ধেয় এক সদস্য একটি ইস্যুতে একাই শহীদ মিনারে প্রতিবাদে নেমেছিলেন। তার আগে ক্রান্তিকালে দেশের বিবেকবান মানুষের করণীয় সম্পর্কে এক দৈনিকে লিখেছিলেন, ‘সব যুগে সব দেশে ভলতেয়ার, সাত্রেরা থাকেন না। কিন্তু সব কালে সব দেশেই বিবেকবান নাগরিকেরা তাদের অভাব কিছু পূরণ করেন। অন্যায় অবিচার দেখলে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বেব উঠে তারা প্রতিকার চান। প্রতিবাদ করেন সরকার যেহেতু মানুষরাই চালান, সুতরাং যে কোনো সরকারেরই ভুল হতে পারে। ভুল ধরিয়ে দিলে তা সংশোধন করা সম্ভব। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাইলে, ভুল ধরিয়ে দিতে গেলে, একটা সাইড নিতেই হয়। এক পক্ষকে সমর্থন দিলে আরেক পক্ষের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নিতেই হবে।’
সংগঠিত হওয়ার পর তাদের প্রথম সম্মিলিত মত পাওয়া গিয়েছিল ডিসিসি ভাগে হরতাল প্রশ্নে। তারা ওই হরতাল সমর্থন করে খবরের কাগজে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন। তবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের আগ মুহূর্তে দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের নতুন ইতিহাস শুনিয়ে, যুদ্ধাপরাধী এক নেতা কিছু কথা বলেছিলেন। যেমন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ‘অভিযোগ’ নয় অপবাদ। একাত্তরে তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তার বিরুদ্ধে একটি অপরাধও প্রমাণ করা যাবে না। পঁচিশ মার্চের পর নুরুল আমীনের নেতৃত্বে তিনি টিক্কা খানের সঙ্গে বসেছিলেন দেশের মানুষকে কিভাবে নিরাপত্তা দেওয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা করতে।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতো রাও ফরমান আলী যুদ্ধের সময় তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন আর তিনি ও তার বাহিনী জনগণের নিরাপত্তার দায় কাঁধে নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। সে কাজের দু’একটা উদাহরণও দিয়েছেন। যেমন মুক্তিবাহিনী ব্রিজ উড়িয়ে দিলে মিলিটারি এসে এলাকার লোকজনকে মারধর করত, তারা তখন এলাকাবাসী রক্ষায় এগিয়ে যেতেন। যে সময়ে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে মানুষ উত্তেজনায় রয়েছে, সে সময়ে এ ধরনের কথাবার্তা বলার প্রতিবাদে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় নিবেদিত ওই সংগঠন কিছু বলেনি।
তারা সম্মিলিতভাবে বলতে পারতেন আমরা এ বক্তব্যের বিরোধিতা করছি। যে উদ্দেশ্যে এ সাক্ষাৎকার প্রচার হয়েছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। যেমন বলেছিলেন, ডিসিসি ভাগের হরতালের সময়। বলেছেন দেশবাসীর মনে কথা ‘ফোকাস’ করতে চাইছেন। এ দেশের যে সাধারণ মানুষরা মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারিয়েছেন বা পঙ্গু হয়েছেন, যে নারীরা নির্যাতিত, অপমানিত হয়েছেন তাদের নিয়ে কথা বলতে পারতেন।
আন্দোলনের চমক টিভি পর্দায় বা ইন্টারনেটে যতই দেখা যাক, জনগণকে বাদ দিয়ে কোনো মৌলিক পরিবর্তন পৃথিবীর কোনো দেশেই সম্ভব নয়। টেলিভিশন বা ইন্টারনেট নির্ভরতা দেশে দেশে যেভাবে আন্দোলনের ভাবমূর্তিতে পরিবর্তন এনেছে বা নতুন ভাবমূর্তি গড়ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। ইন্টারনেটে সামাজিক নেটওয়ার্ক মুহূর্তে এক দেশের সঙ্গে বহুদূরের আরেক দেশের যোগাযোগ ঘটাতেই পারে। কিন্তু প্রতিটি দেশ তার সামাজিক আচরণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে স্বতন্ত্র। একই সঙ্গে সে সত্যও অস্বীকার করার সুযোগ নেই।