ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে গণতন্ত্রের বিজয়

সাজ্জাদ কাদির

প্রকাশিত: ২১:২৬, ২৮ মে ২০২৩

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে গণতন্ত্রের বিজয়

.

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হওয়ায় এই নির্বাচন ভবিষ্যতের বাংলাদেশে বারবার উদহারণ হিসেবে উচ্চারিত হবে। বাংলাদেশে ভোট মানেই কেন্দ্র দখলের অভিযোগ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ না হওয়া- এই পরিস্থিতির বিপরীত চিত্র দেখা গেছে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে। ভোটের দিন সকাল ৮টায় ভোট শুরু হওয়ার আগেই কিছু কেন্দ্রে ছিল ভোটারের দীর্ঘ লাইন। কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণে ধীরগতি এবং কয়েকজন প্রার্থীর এজেন্ট না থাকা ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি ছিল শান্তিপূর্ণ। ভোট চলাকালে এবং ফল ঘোষণার পরেও কোথাও কোনো বড় ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। সরকার, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন প্রার্থী সকলের অসামান্য অবদান রয়েছে এমন একটি সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন হওয়ার পেছনে। ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ ভোট পড়া এই নির্বাচনে ফল গণনার শুরু থেকেই টানটান উত্তেজনা ছিল। দীর্ঘদিন একতরফা নির্বাচনের দেশে পরিণত হওয়া পরিস্থিতিতে নিকট ভবিষ্যতে এমন উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচন বহুদিন মানুষ দেখেনি। এজন্য মধ্য রাত পর্যন্ত সারাদেশের মানুষের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল গাজীপুর। সুস্থ মস্তিষ্কের শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশের মানুষ তো এমনটাই চায়।

আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় গাজীপুর সিটি নির্বাচনে যেহেতু অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের শক্ত প্রার্থীর অংশগ্রহণ ছিল না, সেহেতু শাসক দল আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী নৌকা মার্কার অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানের নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছিল। এর বাইরে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী দেওয়াল ঘড়ি প্রতীকের জায়েদা খাতুনের নামও ব্যাপকভাবে ছিল আলোচনায়। জায়েদা খাতুন অপরিচিত একজন মানুষ বিধায় তার নাম আলোচিত হওয়ার কথা নয়। আলোচিত হওয়ার একমাত্র কারণ, তিনি সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলমের মা। জাহাঙ্গীর নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অযোগ্য ঘোষিত হওয়ায় জাহাঙ্গীরেরই ভিন্ন নাম ছিল তার মা জায়েদা খাতুন। জাহাঙ্গীরসহ আরও দুই ছেলে এবং এক মেয়ের মা জায়েদা খাতুনের স্বামী মারা গেছেন বছর আগে। এসবের বাইরে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে আর কিছুই জানা যায়নি জায়েদা খাতুন সম্পর্কে। অন্যদিকে, স্বাধীন বাংলাদেশে গাজীপুর আওয়ামী লীগের ইতিহাস এবং অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানের নাম এক অভিন্ন। একটি বাদ দিয়ে আর একটির ইতিহাস বর্ণনা করা কঠিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে প্রথম ব্যাচের ছাত্র অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন সক্রিয়ভাবে। তরুণ বয়সে টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরপর তিনবার ছিলেন এই দায়িত্বে।

নিজ হাতে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় আছে তার অবাধ বিচরণ। গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনবার। গত সাত বছর গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য ছিলেন তিনি। নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় কিছু মানুষকে বলতে শুনেছি, আজমত উল্লাহ যোগ্যপ্রার্থী ছিলেন না। প্রশ্ন হচ্ছে- আজমত উল্লাহর মতো দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ যদি যোগ্য না হন, তাহলে গাজীপুরের মাটিতে যোগ্যপ্রার্থী কে?

গাজীপুর নির্বচনে যোগ্যতার চেয়ে অন্যান্য নানা ফ্যাক্টরের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। গাজীপুর শিল্পাঞ্চল হওয়ায় সেখানে স্থানীয় আদি বাসিন্দার চেয়ে অর্ধেকের বেশি উত্তরাঞ্চলের অধ্যুষিত বিভিন্ন জেলা থেকে আগত স্বল্পশিক্ষিত ভাসমান শ্রমিক ভোটার। তাদের কাছে যোগ্যতার মাপকাঠি ভিন্ন। টঙ্গী এলাকায় আজমতের শক্তিশালী সমর্থকগোষ্ঠী থাকলেও নানা কারণে জাহাঙ্গীরের গাজীপুর সদর উপজেলার ভোটারদের মধ্যে প্রভাব রয়েছে, জাহাঙ্গীরের নিজস্ব ভোটব্যাংক এবং পোষাবাহিনী রয়েছে। আর বিএনপি-জামায়াত জোট যেহেতু নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেহেতু আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারাতে তারা জাহাঙ্গীরে ভর করেছিল। কারণ, তারা দীর্ঘদিন ধরে ভরের রাজনীতি করছে। এতে তারা ডাবল স্টান্ডার্ড সুবিধা পেয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, জাহাঙ্গীরের বয়সের চেয়েও আজমত উল্লাহ খানের রাজনীতির বয়স বেশি হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতি এবং আইনজীবী পেশা ছাড়া আজমত উল্লাহ খানের আর কোনো পেশার কথা জানা যায় না। অন্যদিকে, জাহাঙ্গীর মাত্র এই শতকের শুরুতে বা গত শতকের শেষে তথাকথিত ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দিয়েই এক সাধারণ পরিবার থেকে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, একই সঙ্গে শিল্পপতি হয়ে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে গত টার্মে মেয়র নির্বাচিত হয়ে মাত্র অর্ধেক মেয়াদ দায়িত্ব পালন করেই সরকারি বরাদ্দের প্রতিটি খাতে অর্থ লুটপাট, দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে ৭৪০০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে দুদকের খড়গ তার মাথার ওপরে রয়েছে। নির্বাচনে টাকার খেলায় আজমত উল্লাহর চেয়ে জাহাঙ্গীর এগিয়ে ছিলেন। নির্বাচন পরিচালনায় আপাতদৃষ্টিতে জাহাঙ্গীরকে একা মনে হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যে অফিসিয়াল আওয়ামী লীগ ছাড়া জাহাঙ্গীরের পক্ষে ছিল সকল বিরোধী শক্তি। এমনকি আওয়ামী লীগেরও একটি পক্ষ নীরবে সঙ্গে ছিল। অন্যদিকে, নানা কারণে অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান এবং আওয়ামী লীগ একা হয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে এই নির্বাচনে। দ্রব্যমূল্য সিন্ডিকেটকে দমন করতে না পারা, আওয়ামী লীগে নব্য হাইব্রিডদের অনুপ্রবেশ তাবের তা- মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলছে। যার প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে।

ভোটগ্রহণ গণনা শেষে ওইদিন রাত দেড়টায় পুরো সিটিতে মোট ৪৮০ কেন্দ্রের সবটাতে বেসরকারি ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার ফরিদুল ইসলাম। এতে স্বতন্ত্র টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী জায়েদা খাতুন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানের চেয়ে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোট বেশি পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। জায়েদা খাতুন পেয়েছেন দুই লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট আর অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান পেয়েছেন দুই লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। ভোটের ফলে জায়েদা খাতুন বিজয়ী হন মেয়র হেসেবে।

এখন প্রশ্ন হলো এই নির্বাচনে আসলে কে জিতলেন? ভোটপ্রাপ্তির বিচারে অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান পরাজিত হলেও তিনি কিন্তু হারেননি, হারেনি আওয়ামী লীগ, নির্বাচন কমিশন এবং সরকার। নির্বাচনে হেরে গেলে অভিযোগ তোলার রেওয়াজের এই সমাজে আজমত উল্লাহ খান সঙ্গে সঙ্গে ফল মেনে নিয়েছেন এবং বিজয়ী মেয়রকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ফল মেনে নিয়ে বিজয়ীকে অভিনন্দন জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটিকে সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছে এবং সরকার কোনোভাবেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেনি। সে জন্যই বলতে চাই এই নির্বাচনে কেউ হারেনি; জিতেছে সবাই।

লেখকতথ্যচিত্র টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা

[email protected]

 

×