
২০২৩-এর ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন অনুমোদন করেছে
২০২৩-এর ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন অনুমোদন করেছে। এই আইন অনুযায়ী সরকারী কর্মচারীদের ছাড়া ১৮ থেকে ৫০ বছরের যে কোনো নাগরিককে পেনশন দেওয়ার জন্য সরকার একটি সর্বজনীন পেনশন তহবিল গঠন করবে। এই তহবিলে ইতোমধ্যে সরকারী পেনশন স্কিমের আওতায় অন্তর্ভুক্ত সরকারি কর্মচারিদের বাইরে ১৮-৫০ বছরের যে কোনো কর্মচারী বা ব্যক্তি নির্ধারিত হারে ন্যূনপক্ষে ১০ বছর চাঁদা জমা দিয়ে ৬০ বছর হওয়ার পর আমৃত্যু পেনশন পেতে পারবেন।
তিনি যদি ৭৫ বছরের আগে মারা যান, তাহলে তার মনোনীত উত্তরাধিকারী ৭৫ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত তেমনি পেনশন পেতে থাকবেন। পেনশন তহবিলে চাঁদা দেয়া শুরু করার পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে যদি পেনশন প্রকল্পের আওতাধীন ব্যক্তি মারা যান, তাহলে তার মনোনীত উত্তরাধিকারী পেনশন তহবিলে গৃহীত অংকের অর্থ সুদাসলে ফেরত পাবেন। পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থের ওপর কোনো কর আরোপ করা হবে না। পেনশন তহবিলে জমা দেওয়া বা গৃহীত চাঁদা বা প্রিমিয়াম তেমনি রাষ্ট্রের কর আরোপণের বাইরে থাকবে।
সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নিম্ন আয় অর্জনকারী ও দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে পেনশনের জন্য নির্ধারিত প্রিমিয়ামের অঙ্ক পূরণ করার নিমিত্ত সরকার পেনশন তহবিলে অনুদান বা ভর্তুকি প্রদান করবে। শুরুতেই এই ব্যবস্থার আওতায় পেনশন তহবিলে অংশগ্রহণকারী প্রতিমাসে ৫০০ টাকা চাঁদা প্রদানকারী ৬০ বছর বয়স হলে প্রতিমাসে ৩৪০০ টাকা করে এবং তেমনি মাসিক ১০০০ করে চাঁদা প্রদানকারী ৬০ বছর বয়স হলে মাসিক ৬৪০০ টাকা করে আমৃত্যু পেনশন পাবেন। মাসিক বা ত্রৈমাসিক কিস্তিতে চাঁদা দেওয়ার সুযোগ থাকবে।
সরকার বাধ্যতামূলক না করা পর্যন্ত এই পেনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ হবে ঐচ্ছিক। সরকারী মন্ত্রণালয় বা বিভাগের বাইরে সরকারি সংস্থা, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মীরা এই আইনের আওতায় পেনশন প্রাপ্যতার ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। এদের ক্ষেত্রে দেয় প্রিমিয়ামের পরিমাণ এসব সংগঠনের কর্তৃপক্ষ যথাআইন ও বিধি নির্ধারণ করবে।
সরকার থেকে প্রাপ্ত ভর্তুকি পেনশনের প্রিমিয়ামে অন্তর্ভূক্ত হলে বা থাকলেও এই হারে পেনশন প্রাপ্তির কোনো হেরফের ঘটবে না। তবে ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে নির্ধারিত প্রিমিয়ামের দেয় হারে কমতির পরিমাণ পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি বিশেষের সামর্থ্যরে পরিমাপে নির্ধারিত হবে। গৃহীত পেনশনের বিপরীতে প্রদত্ত প্রিমিয়ামের বিপরীতে পেনশনধারী ৫০% ঋণ সুদসহ পরিশোধের শর্তে নিতে পারবে।
পেনশন প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও তহবিল পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হবে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি শাসক পর্ষদকে। এই পর্ষদের অন্যান্যের মধ্যে থাকবেন সরকারের অর্থ সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সমাজকল্যাণ বিভাগের সচিব, শ্রম সচিব, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বাংলাদেশ নিয়োগকারীদের ফেডারেশনের সভাপতি ও সিকিউরিটি এবং এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রধান।
সরকারের অর্থমন্ত্রী এই পর্ষদের চেয়ারম্যান হবেন। এই পর্ষদের তত্ত্বাবধানে নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবেন সরকার কর্তৃক নিয়োজিত ৫ সদস্যের একটি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। সরকার ইতোমধ্যে জাতীয় পেনশন শাসক পর্ষদের নিযুক্তি দিয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সকল নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থাকরণ, কর্মের অধিকার, যুক্তিসংগত বিশ্রাম ও অবকাশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা যথা- বেকারত্ব, ব্যাধি ও পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃ-পিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত বা আয়ত্তাতীত অভাবগ্রস্ততার কারণে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করার অনুশাসন দেওয়া হয়েছে।
এই লক্ষ্যে সরকার সাম্প্রতিককালে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজ সেবার ক্ষেত্রে দুই যুগ আগের তুলনায় বিস্তৃত উন্নয়ন ও সেবা কার্যক্রম বাস্তবায়িত করে আসছে। গ্রামাঞ্চলে পঙ্গু এবং বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ততার জন্য ভাতা ও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে সরে আসার জন্য সহায়তা বিস্তৃত করা হয়েছে এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিমূলক কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়েছে। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইতোমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক, সর্বজনীন, বিনামূল্যে পুস্তক সরবরাহ ও সর্বজনীন উপবৃত্তিভিত্তিক করা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা রক্ষণ এবং প্রসারণ (সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদ), সুযোগের সমতা বিধান (সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদ) এবং সকলের অনুকূলে অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া ও সাধারণভাবে অনুপার্জিত আয় ভোগকরণ বন্ধের (সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২০) লক্ষ্যে এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে যথা প্রয়োজন, যথা কর্তব্য কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অনুশাসন দিয়েছে।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে জনকল্যাণমুখী (ওয়েলফেয়ার) রাষ্ট্রে উন্নীত করেছেন। এই কার্যক্রম গ্রহণ করে তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র ও সমাজের দার্শনিক প্রবক্তা উইলিয়াম বিভারিজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৩০ দশকের মহামন্দার সময়ের সাহসী রাষ্ট্রনায়ক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভল্টের মতো রাষ্ট্রের তরফ থেকে জনগণের সকল কল্যাণমুখী দায়িত্ব গ্রহণ ও পালনের সারথি হিসাবে ইতিহাসে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
এক্ষেত্রে তাঁর সহযোগী হিসেবে অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল প্রশংসার্হ ভূমিকা পালন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্র কর্তৃক সামাজিক কল্যাণ বিধানের গোড়া পত্তন করেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টÑ১৯৩০ সালে সামাজিক কল্যাণ শীর্ষক আইন গ্রহণ করে। এই আইনকে ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমান্বয়ে সমকাল পর্যন্ত বেকারত্ব বিমা, নির্ভরশীল সন্তানদের সহায়তা, বৃদ্ধ বয়সী বিমা ও সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা ও মৌলিক শিক্ষা বিষয়ক আইনাবলি সংশোধন ও কার্যক্রমাদি গৃহীত হয়।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৬৫ মিলিয়ন নাগরিককে জীবনযাপনের নিরাপত্তামূলক আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৯ সালে ১ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি পরিমাণ সমাজকল্যাণমূলক সহায়তা দেওয়া হয়েছে নাগরিকদের। সাম্প্রতিক হিসাব অনুসারে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে মাসিক ১৫৫১ ডলার পরিমাণ সমাজকল্যাণ উপযোগ সহায়তা প্রাপ্তির যোগ্য বা দাবিদার মার্কিন নাগরিকরা পেয়েছেন। এর মধ্যে কর্ম-অপারগতার কারণে সহায়তা নিয়েছেন ৮.২ মিলিয়ন ব্যক্তি।
সমকালে যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ও রাজ্য সরকারের তরফ হতে বার্ষিক ১.১৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদের (জিডিপি) ৫% সামাজিক কল্যাণ বাবদ প্রযুক্ত হয় বলে হিসাব করা হয়েছে। এর জন্য শ্রমিক বা কর্ম প্রাপ্তরা তাদের আয়ের ৬.২% এবং নিয়োগকর্তারা তাদের দেওয়া বেতনভুকদের বেতনাদির ৬.২% এবং স্বনিয়োজিতরা তাদের আয়ের ১২.৪% ফেডারেল বিমা তহবিলে জমা দিয়েছেন । স্বাস্থ্যসেবা (মেডিকেয়ার) বাবদ ব্যয় অনেকাংশে এর অতিরিক্ত। তথাপি একথা সত্য যে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদের অনুপাতে যুক্তরাজ্য সরকারের কল্যাণ কাজের পরিধি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি।
সমকালে যুক্তরাজ্য দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদের ২০% কল্যাণ কর্মকা-ে প্রয়োগ করে থাকে। রাষ্ট্রীয় পেনশন প্রদানে, বেকারত্ব প্রশমনে, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে খাদ্যসেবা পরিবর্ধনে, যুক্তরাজ্য অন্যান্য রাষ্ট্র ও সরকারকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছে। ১৯৩৭ সালে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে রাশিয়ায় সামাজিক কল্যাণের কার্যক্রম ১৯৯৭ সালের বিপ্লবোত্তর সময়ের তুলনায় আরও বিস্তৃত করা হয়েছে। ১৯৯৩ সালের সংবিধানে রুশ ফেডারেশনকে একটি সামাজিক রাষ্ট্র হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং এর কর্তব্য হিসেবে নাগরিকদের পেনশন দেওয়ার দায়িত্বের কথা উল্লিখিত হয়েছে।
এর বাইরে শিক্ষা প্রসারণে মাতৃত্ব ও শিশু জন্মকালীন প্রয়োজনে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এবং বার্ধক্য পোষণে, কর্মকালীন অপঘাতের প্রতিকূলে পূর্ণ সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। জনগণের প্রতি ও অনুকূলে রাষ্ট্রের করণীয় কর্তব্য, সেবা বিস্তৃত ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে লভ্য করা হয়েছে। ফেডারেল, আঞ্চলিক ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থা তাৎপর্যমূলকভাবে বিস্তৃত সহজলভ্য করা হয়েছে।
জাপানে সাম্প্রতিককালে সামাজিক কল্যাণধর্মী সেবা সরকার ও কর্ম প্রদানকারী বেসরকারি কোম্পানিসমূহ দিয়ে আসছে। পরিবার কেন্দ্রিক বাঁধন ও সেবার ঐতিহ্য জাপানি সমাজের কুশলীয় কাজ, যত্ন বা সেবাকে অনেক যুগ ধরে সরকারি কার্যক্রমের বাইরে অভিযোগবিহীন অবয়বে রেখেছে। এই ঐতিহ্যের ধারক হয়ে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে জাপানে এখনও পরিবার ও স্থানীয় সংস্থা এবং সমাজ ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে আসছে।
সমকালে জাপানে সরকার থেকে মৌলিক জীবনযাপনের ব্যয়, আবাসিক প্রয়োজন, বাধ্যতামূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ, স্বাস্থ্যবিমা এমনকি মৃত্যুপরবর্তী সৎকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকার থেকে সহায়তা দেওয়া হয়। এরূপ সরকারি সহায়তার আওতায় জনসংখ্যার ১.৭% আশ্রয় এবং উপযোগ পায়। সহায়তা প্রাপ্তদের ৫০.৮% গৃহস্থালি হলো বৃদ্ধদের, ২৬.৬% হলো কর্ম অক্ষম ব্যক্তিদের এবং ৬.২% হলো একক স্ত্রী বা নারী পালিত সন্তান নিয়ে থাকা পরিবারদের।
জাপানে উপরোক্ত সরকারি সহায়তার বাইরে সকল ক্ষেত্রে বেসরকারি শিল্প-বাণিজ্য কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা, কর্মচারী বিমা, বেকার বিমা, কর্মীদের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ বিমাকরণে আইনের আওতায় বাধ্য। এসব বিমার মধ্যে একমাত্র শ্রমিকদের দুর্ঘটনা বিষয়ক বিমার সকল ব্যয় সংশ্লিষ্ট নিয়োগকারী সংস্থা, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান বহন করে। অন্যান্য সকল বিমার ব্যয় নিয়োগকর্তা ও শ্রমিক কর্মচারীরা বহন করেন।
অনুরূপভাবে বিমা সুবিধার আওতাধীন এসব প্রতিরক্ষণের বাইরে জাপানে সকল জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা বিদ্যমান। এরূপ স্বাস্থ্যবিমার ব্যয় সরকার, শ্রমিক কর্মচারী, মালিক পক্ষ ও বেকাররা শ্রেণি নির্দিষ্ট হারে বহন করেন। সংগৃহীত বিমার প্রিমিয়ামের শতকরা ১৬% ভাগ সরকার বহন করে। আর শ্রমিক ও মালিক পক্ষ শ্রমিকের দেয় বেতনাদির ৮.২% এরূপ বিমা তহবিলে জমা দিয়ে থাকেন।
এসবের বাইরে জাপানে নি¤œতম দেয় মজুরি বিষয়ক আইন বিদ্যমান। নি¤œতম দেয় মজুরি এলাকা ও শিল্পভেদে সরকার, শ্রমিক ও মালিক পক্ষের প্রতিনিধি ভিত্তিক মতামতের আলোকে নির্ধারিত ও প্রশাসিত হয়।
সুইডেনে সামাজিক নিরাপত্তার আবরণ বেশ বিস্তৃত। সেদেশে কোনো ব্যক্তির আয় যদি না থাকে কিংবা নির্দিষ্ট অঙ্কের নিচে হয়, তাহলে সরকার স্থানীয় পৌরসভার মাধ্যমে তার প্রয়োজনীয় গৃহায়ন, খাদ্য, পোশাক ও টেলিফোনের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়। এর বাইরে নাগরিকদের পারিবারিক জীবনে প্রবেশক্রমে ও থাকার লক্ষ্যে এবং সন্তান ধারণ ও পোষণের জন্য বাবা মা উভয়কে ১৬ মাস পর্যন্ত ভাতা এবং প্রতিবছর অসুস্থ সন্তানের সেবার জন্য ৪ মাস পর্যন্ত ভাতা ও বেতনসহ ছুটি দেওয়া হয়।
তাদের হাসপাতালে সেবা ও চিকিৎসা এবং সন্তান জন্মের জন্য হাসপাতালে যাওয়া আসার ব্যয়, সন্তানদের ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভরণপোষণ ভাতা, শিশুদের ৭ বছর বয়স পর্যন্ত দিবাসেবার ব্যবস্থাপনার ব্যয় বহন করা এবং ২৯ বছর পর্যন্ত সকল নাগরিকের গৃহভাতা দেওয়া হয়। তদুপরি অসুস্থ ও কর্মকরণে অসমর্থ ব্যক্তিদের ভাতা সহায়তা এবং সকল নাগরিককে ৬১ বছর বয়স থেকে বয়স্ক ভাতা বা পেনশন প্রদানের বিধান ও ব্যবস্থা সুইডেনেও বিদ্যমান। বিস্তৃত সামাজিক কল্যাণ বাবদ সুইডেনে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদের প্রায় ৪৮%, যা সকল দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রযুক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশে সম্প্রতি গৃহীত সর্বজনীন পেনশন প্রদানীয় আইন সমাজকল্যাণ বিস্তার ও নিশ্চিতকরণের পথে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ সুবিন্যস্ত ও অধিকতর ফলপ্রসূ করার প্রক্রিয়ায় নিম্নে বর্ণিত ক্ষেত্রে সযতœ নজর ও তত্ত্বাবধান প্রয়োজন হবে। এক, বিদ্যমান ও চলমান শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম (উদাহরণত- পঙ্গু ও বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তাদের দেয় ভাতা, গৃহহীনদের গৃহ দেওয়া, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, অন্ন সহায়তা ও অন্যান্য) পেনশন দেওয়ার কার্যক্রমের বাইরে চালাতে ও প্রয়োজনবোধে বাড়াতে হবে।
যারা বেকার আছেন কিংবা থাকবেন, তাদের বেকার ভাতা ব্যবস্থা করে পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ দেওয়া অর্থব্যবস্থায় অনুৎপাদনশীলতায় ম্রিয়মাণ থাকার সুযোগ সৃষ্টি করবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারি কার্যক্রম বা সেবার পরিসর কমিয়ে কেবল পেনশনের সর্বজনীনতা প্রবর্তন করে বা হার বাড়িয়ে সরকারের সাংবিধানিক এবং যুগ ধরে গৃহীত দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিসর কমানো যাবে না। দুই, প্রয়োজনে এখন বা ভবিষ্যতে প্রবর্তিত বেকার ভাতার আওতাভুক্ত জনগোষ্ঠীকে এই পেনশন ব্যবস্থার বাইরে রাখা উত্তম হবে।
বেকার ব্যক্তিদের বেকার ভাতার অতিরিক্ত পেনশনের প্রিমিয়াম দেওয়া অবান্তর বলে বিবেচনা করা সংগত। তিন, সরকারি পেনশন ব্যবস্থার বাইরে বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত ভবিষ্যৎ তহবিল সর্বজনীন পেনশন তহবিলে আহরিত ও জমাকৃত অর্থসহ উৎপাদন ও উন্নয়নমুখী কার্যক্রমে প্রয়োগ ও বিনিয়োগ করার আইনি পরিধি সৃষ্টি করতে হবে। সমকালে এই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধান অস্পষ্ট ও অপর্যাপ্ত।
এই ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গত ৬/৭ দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে এই প্রেক্ষিতে ও লক্ষ্যে আইনি পরিধি এখনই সৃষ্টি করা উত্তম হবে। চার, তর্কাতীতভাবে এই আইনের আওতায় প্রদেয় উপযোগ অপেক্ষাকৃত উঁচু, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-উচ্চবিত্তদের উপযোগে প্রযুক্তীয়। নিঃসন্দেহে যে ব্যক্তি বা পরিবার প্রতিমাসে ৫০০ টাকা বিমার প্রিমিয়াম দেবেন বা দিতে পারবেন, তিনি আমাদের সমাজে বিত্ত স্বল্প ব্যক্তি বা পরিবার প্রধান নন। নিঃসন্দেহে বিত্ত স্বল্পদের অনুকূলে এই আইনের আওতায় সামাজিক বিমা প্রসারিত করা সামাজিক কুশলের সূত্র অনুগামী হবে।
পাঁচ, সরকারি ও বেসরকারি সকল ক্ষেত্রে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজনকে কোনোক্রমেই অবহেলা করা যাবে না। একথা ভুললে চলবে না যে, সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে সম্পদ সৃজন বা সার্বিক উৎপাদন না বাড়িয়ে দারিদ্র্য দমন কিংবা পরিহার করা যায় না। মনে রাখতে হবে যে, দেশের জাগতিক উন্নয়ন ছাড়া কোনো মেয়াদি জনকল্যাণমূলক কিংবা সম্পদ বিতরণীয় কার্যক্রম সফল করা যায় না। সর্বজনীন পেনশন প্রবর্তণমূলক আইন নিঃসন্দেহে একটি কল্যাণমুখী পদক্ষেপ। কিন্তু নিছক এই পদক্ষেপের দোহাই দিয়ে দেশের সার্বিক সঞ্চয় ও বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ানোর প্রয়োজন অবজ্ঞা করা জনস্বার্থিক হবে না।
লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী