
ছবি: জনকণ্ঠ
প্রতি বছর বাবা দিবস আসে, যায়। কেউ উদ্যাপন কোরে একটি ছবি পোস্ট করে, কেউ একটি উপহার দিয়ে, কেউ শুধু মন ভরে মনে করে। আর কেউ কেউ আছেন—যাঁদের কাছে বাবা দিবস মানেই স্মৃতির ভারে চোখ ভেজানো এক দিন।
আমার জীবনেও একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর প্রতিচ্ছবি এখনো আমার চারপাশে জ্বলজ্বল করে। তিনি আমার পিতা—প্রফেসর এবিএম আব্দুল বারী।
তিনি কেবল একজন শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন এক জীবনাদর্শ । বাংলা ও আরবি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর কিন্তু অধ্যাপনার জন্য বেছে নিয়েছিলেন বাংলা ভাষাকে। তাঁর ভাষা-প্রেম, সংস্কৃতিচেতনা আমাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছিল যে, আজ আমি একজন আবৃত্তিশিল্পী ও সংগঠক হিসেবে যে পথ চলছি, তার প্রথম প্রেরণা ছিলেন আমার বাবা।
ছোটবেলায় আমাদের কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না। আমাদের পড়াশোনা হতো বাবার শাসনে, তাঁর নিজের হাতে গড়া নিয়মে। রাত্রি যতই গভীর হোক, যদি পড়ার সময় হতো—বাবা পাশে বসতেন। আবার আমাদের মায়ের সঙ্গে মৃদু বিতণ্ডা হতো আমাদের শাসন নিয়ে। তিনি মাকে বলতেন—
"Spare the rod and spoil the child!" যার অর্থ - বেত ছেড়েছো তো ছেলে গোল্লায় গেছে। আর হাসতে হাসতে বলতেন—"খাওয়াবে রাজভোগ, দেখাবে বাঘের চোখ!"
এই কথাগুলোর পেছনে ছিল গভীর বাস্তবতা—তিনি চেয়েছিলেন, আমরা শুধু শিক্ষিত না, মানুষ হই। তাঁর প্রিয় উক্তি ছিল—"মনের ভেতর ইচ্ছের আগুনকে জ্বালিয়ে রেখ—অর্থাৎ কখনো স্বপ্ন দেখতে ছেড়ো না।"
এই একটি বাক্যই যেন আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছিল।
বাবা ছিলেন বহু গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর লেখা বই—‘বাংলা শিক্ষার নতুন পদ্ধতি’, ‘শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞান’, ‘ইসলামী আদর্শবাদের কথা’ বিএড কলেজে পাঠ্য ছিল। ‘মুক্তিসংগ্রামের প্রথম শহীদ তিতুমীর’ প্রকাশ করে ইসলামী ফাউন্ডেশন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার নাট্য রূপ দিয়েছিলেন, যে সংকলনটির নাম তিনি রেখেছিলেন "কবির সেরা রবি কবি "। তিনি ছিলেন শিক্ষক, গবেষক, সংগঠক, এবং সমাজসেবক—একজন পূর্ণাঙ্গ আলোকিত মানুষ।
আমার বাবা ১৯৩০ সালের ১ লা জুন, রমজান মাসের এক শুভ প্রত্যুষে পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগনার বাদুরিয়া থানার বিনেরআটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তখন ছিল অবিভক্ত বাংলা। তার পড়াশোনা এই পূর্ব বঙ্গ তথা বাংলাদেশেই হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলর জিন্নাহ বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কলেজ, কারমাইকেল কলেজ সর্বশেষ যশোর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ১৯৮৬ সালে অবসরে গমন করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট মাত্র ৬৬ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন। আজ, এত বছর পরেও বাবার রেখে যাওয়া আদর্শ, মূল্যবোধ, এবং ভালোবাসা আমার প্রতিটি সিদ্ধান্তে, উচ্চারণে, কর্মকাণ্ডে ছায়ার মতো জড়িয়ে থাকে।
আমরা চার ভাই-বোন। বড় ভাই সরকারি প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, বোন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের উপাধ্যক্ষ, ছোট ভাই কালবেলা পত্রিকার সিনিয়র নিউজ এডিটর। আমরা সবাই বাবার দেখানো আলোর পথে চলার চেষ্টা করছি—আলহামদুলিল্লাহ।
আজ বাবা দিবসে আমি শুধু শ্রদ্ধা জানাতে চাই না, আমি চিরঋণ স্বীকার করতে চাই। তাঁর শাসনের, ভালোবাসার, শ্রমের, এবং সবচেয়ে বড় কথা—স্বপ্ন দেখানোর। কারণ তিনিই শিখিয়েছিলেন—"জীবন মানে শুধু বেঁচে থাকা নয়, কিছু রেখে যাওয়া।"
আজকের এই বাবা দিবসে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন। "রব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সগীরা।”
শিহাব