ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লন্ডনরে চঠিি

পার্থক্যটা আসলে ল অ্যান্ড অর্ডারে

সাগর রহমান

প্রকাশিত: ২১:০০, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

পার্থক্যটা আসলে ল অ্যান্ড অর্ডারে

সাগর রহমান

কয়েক বছর আগের কথা। আমি তখন লন্ডনের একটি পত্রিকায় (অধুনালুপ্ত) খণ্ডকালীন কাজ করি। কাজ মানে নানান খবরের লিখিত ফাইল হতে আকর্ষণীয় খবরগুলো বেছে বের করে পত্রিকায় পাতা অনুযায়ী সম্পাদককে সাজিয়ে দেই। উনি ওখান থেকে যে সংবাদগুলো ছাপা হবে, পছন্দ মতো সেগুলো তুলে নেন। পত্রিকার অফিসটি ছিল একটি রেস্টুরেন্টের বেজমেন্টে (মাটির তলার ঘর)।

সময়টা ছিল রোজার। সন্ধ্যায় ইফতারের জন্য ডাক পড়ল রেস্টুরেন্টে। গিয়ে দেখি বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিকে (নাম বলছি না) ঘিরে বেশ জমজমাট ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের সম্পাদক মহাশয় আমাকে উনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি বেশ উচ্চৈঃস্বরে ‘হ্যালো ইয়াং ম্যান’ বলে হাত মেলালেন। সমস্যা হলো, ভদ্রলোকের ছবি আমি কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু তখনও চিনতে পারছি না।

চেয়ারে বসে ফিসফিস করে পাশের জনের কাছে নেতার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, যার একটাই অর্থ: গাঁড়ল নাকি ছেলেটা! তবে শেষ পর্যন্ত পরিচয়টা দিলেন। পরিচয় পেয়ে বুঝলাম, নেতা ভদ্রলোক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রীতিমতো কিংবদন্তি তার কিছু কর্মকা-ের কারণে। ইফতার পার্টিতে উপস্থিত প্রায় সবাই আমার তুলনায় মুরব্বি। দেখলাম, নেতাকে বেশ তোয়াজ করছেন। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ধূমপানের অনুমতি নেই।

কিন্তু সেটার তোয়াক্কা না করে এবং চারদিকে এত রোজাদার মানুষের অনুভূতিকে সম্মান করার ভদ্রতা না দেখিয়ে দিব্যি সিগারেট ফুঁকে চলেছেন। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে তিনি নানান মন্তব্য করছেন, তাকে ঘিরে থাকা ক্ষুধার্ত মানুষজন সেসব কথা বেশ তমিজ সহকারেই শুনছেন। দরকার মতো হাসছেন, দরকার মতো মুখ গম্ভীর করে তার বাণীর মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করছেন।
আমি পারতপক্ষে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ছায়া মাড়াই না। রাজনীতির মতো জটিল বিষয়ে আমার জ্ঞানের অসীম দরিদ্রতা এর অন্যতম কারণ। সুতরাং ইফতার পার্টিতে বেশ আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলাম। বার বার ঘড়ি দেখছি। টেবিলে কাজ রেখে এসেছি। তাড়াতাড়ি ইফতার শেষ করে কাজে ফিরতে পারলে বাঁচি। যত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে পারব, তত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারব।

কিন্তু সমস্যা হলো, ইফতারের পর শুরু হলো মূল আলোচনা। আলোচনার বিষয়বস্তু বাংলাদেশের মানুষের ‘বাঙালিয়ানা’।  অর্থাৎ, বিশ্বের অন্যান্য জাতির তুলনায় বাঙালি হিসেবে আমাদের কর্মকা- যে কতটা ‘বাঙাল’, তারই রসালো আলোচনা। বক্তা একজনই, বর্ষীয়ান নেতা। তিনি নানান উপলক্ষে বিশ্ব ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন একসময়। নানান জাতির লোকজনের সঙ্গে মিশেছেন।

অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করেছেন। অনেক বছর ধরে ইউরোপে থাকেন। সুতরাং, তিনি তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে নানান গল্প বের করে করে মুগ্ধ শ্রোতাদের তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিটি গল্পের শেষে ঈশপের গল্পের নীতিবাক্যের মতো জুড়ে দেন, এই জাত (বাঙালি জাতি) থেকে আপনি কী আশা করতে পারেন?
নিজ জাতি বিষয়ে এমন হীন ধারণা পোষণকারী জাত আর আছে কি না, আমার ঘোর সন্দেহ আছে। নানান উপলক্ষে নানান দেশের মানুষকে যতটুকু জানার বা বোঝার সুযোগ হয়েছে, আমার এ ধারণা দিন দিন প্রবল হয়েছে। সমস্যা হলো, সাধারণ মানুষ না হয় স্রফে কথার ঝোঁকে অমন বারোয়ারি মন্তব্য করে বসে থাকে। কিন্তু এই ভদ্রলোক, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যার একসময় বেশ প্রতাপ ও প্রভাব ছিল, যার অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী আছে- যারা সবাই বাঙালি, ইনার মতো একজন লোকের মুখে এসব রসালো গল্প আমার ভেতরে ভেতরে কেমন জ্বালা ধরিয়ে দিতে লাগল।

আমার আপত্তির প্রধান কারণ, নিজ জাতির লোক সম্পর্কে এই যদি হয় একজন রাজনীতিবিদের ধারণা, যিনি ধরেই নিয়েছেন বাঙালির উন্নতির কোনো আশা নেই, তবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তার সেই জাতির মানুষের জন্য রাজনীতি করতে আসাই বা কেন! যে বক্তা বিশ্বাস করেই আছেন যে তার শ্রোতার উন্নয়নের কোনো আশা নেই, তবে তার ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে তাদের কল্যাণে গলা ফাটানোর অধিকারটা খর্ব হয়ে যায় না কি? আমি মানুষের সামনে কথা বলতে পারি না।

কথাটাও সবার সামনে বলতে গেলে কেমন খেই হারিয়ে ফেলি। সুতরাং, নেতার কথার সঙ্গে একমত না হয়েও মুখ ব্যাজার করে বসেছিলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার কথার একটা বেমক্কা প্রতিবাদ করার জন্য উসখুস তৈরি হচ্ছিল। সুযোগটা এলো হঠাৎ।
তিনি তখন জাতি হিসেবে ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দিচ্ছেন। তাদের সাধারণ ন্যায়-নীতি বোধ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নয়ন, সদাশয় সামাজিকতা, অবাধ গণতন্ত্র, দেশের আইনের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাবোধ ও মান্য করার প্রবণতাÑ মোট কথা, সবটাতেই তারা যে আমাদের বাঙালিদের তুলনায় কতটা ‘ধোঁয়া তুলসি পাতা’ তার মনোজ্ঞ বর্ণনা করে যাচ্ছেন, তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের ফোড়ন কাটা ও রসালো মন্তব্যে বেশ জমজমাট পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

সমস্যা হলো, তার বর্ণিত ইংরেজ জাতির গুণগান যে খুব একটা মিথ্যে- সেটা নয় বটে। কিন্তু তাদের সঙ্গে তুলনা করে আমাদের জাতিকে অমন হাস্যস্পদ করে তোলাটা আমি আর নিতে পারছিলাম না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হয় প্রতিবাদ করতে হয় অথবা উঠে যেতে হয়। যেহেতু প্রতিবাদ করার মতো ‘স্মার্টনেসের’ অভাব আছে, তাই ভাবলাম সটকে পড়ি। কিন্তু হঠাৎ ভদ্রলোক সরাসরি আমার নাম ধরে ডাক দিয়ে বললেন, ‘দেখি এ বিষয়ে বর্তমান প্রজন্মরা কী ভাবছে? ইয়াং ম্যান, তোমার মন্তব্য কী?’ আমি সুযোগ পেয়েই, আগ পিছ না ভেবে একটু রূঢ় স্বরেই এক গাদা কথা হড়বড় করে বলে ফেললাম।

আমার বক্তব্যের সার কথাটা ছিল, ব্রিটিশ জাতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে হাজার হাজার সিসিটিভি দ্বারা। এদের এই সব সিসিটিভি খুলে ফেলে রেখে বছরখানেক মানুষগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে তারপর এ ধরনের প্রতিতুলনায় নামলে ভাল হতো। অমন ফুট খানেক দূরে দূরে সিসিটিভি বসানো থাকলে যে কোনো জাতিই দেশের আইন-কানুন মানতে বাধ্য থাকবে। বলাবাহুল্য, আমার উক্ত ‘সিসিটিভি’ বলতে কেবল ক্লোজসার্কিট টেলিভিশন বোঝাচ্ছি না, সিসিটিভি বলতে আমি আইনের নজরদারির কথাটাও বোঝাতে চেয়েছি।

আমার কথাটা নেতা এবং উপস্থিত ভক্তরা কেউই নিতে পারলেন না। নেতা ভদ্রলোক বেশ ভর্ৎসনা করে বসলেন। এ জাতি যে হাজার বছর ধরেই সুসভ্য, সে কথাটা অনেক রেফারেন্সসহ বলতে শুরু করলেন। আমাকে তখন বলতেই হলো, সুসভ্য এখানে, নিজ দেশে। কিন্তু অসভ্যতা করে এসেছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে। কোথাও শাসন ও শোষণ করে, কোথাও প্যাঁচ লাগিয়ে রেখে এসে। সারা পৃথিবীর সম্পদ নিয়ে এসে নিজেদের বাগান সাজানো হয়েছে।

সমৃদ্ধ করে তোলা হয়েছে নিজেদের মানুষকে। এদের আর সভ্য হতে বাধা কোথায়! থাকত যদি আমাদের মতো ক্ষণে ক্ষণে বর্গির ধান লুটে নেওয়ার দুশ্চিন্তা, তবে বুঝতাম। বলাবাহুল্য, অনর্থক এসব তর্ক, যার কোনো তলানিতে পৌঁছানো যায় না। সেদিনও যায়নি। স্বভাবতই তিনি আমার কথা অল্পবয়সের প্রগলভতা ভেবে সবার সামনে হেসেই উড়িয়ে দিলেন। আমি খানিকটা চোখমুখ লাল করে উঠে গিয়েছিলাম। 
আজকে হঠাৎ এই কথাগুলো মনে পড়ল এখানকার একটি পত্রিকার রিপোর্ট দেখে। ব্রিটিশ পুলিশদের কুকীর্তি সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন। মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন মুখপাত্র পত্রিকা মারফত জানাচ্ছেন, তারা এক হাজারেরও বেশি যৌন হয়রানি ও ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের কেস সম্পর্কে তদন্ত করতে যাচ্ছেন, যাতে অন্তত আটশ’ পুলিশ অফিসারের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মেট্রো পুলিশের এই গণতদন্তে নামার সূত্রপাত হয়েছে কিছুদিন আগে ডেভিড ক্যারিক্স নামক একজন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ভয়ংকর সব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়।

ডেভিড তার বিরুদ্ধে উত্থিত অভিযোগের ঊনপঞ্চাশটি স্বীকার করেছে, যার মধ্যে আছে চব্বিশটি যৌন নিপীড়নের অভিযোগ। যেগুলো সংঘটিত হয়েছে অন্তত বারোজন নারীর বিরুদ্ধে, আঠারো বছর সময়কাল ধরে। উল্লেখ্য, এই আঠারো বছরে তার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ উঠলেও প্রতিবারই সেগুলো থেকে সে মাপ পেয়ে আসছে এবং তার কাজে বহাল ছিল দিব্যি। যদিও তার অনেক সহকর্মীই এসব অপর্কীতির খানিকটা জানত।

তারচেয়েও বড় কথা, পুলিশ অফিসার পরিচয়ের সুবিধা নিয়েই সে বেশিরভাগ অপরাধ সংঘটিত করত। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে মেট্রোপলিটন পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে করা অন্তত দুই তিনটি কেস উঠতে থাকবে কোর্টে। মেট্রো পুলিশ কমিশনার স্যার মার্ক রওলিয়ের বরাতে জনগণকে এসব খবর পড়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলছে পত্রিকা। ব্রিটিশ পুলিশদের কর্মদক্ষতা ও সততা মোটামুটি জগদ্বিখ্যাত।

যে কোনো প্রয়োজনে কিংবা বিপদে যে কেউই নিশ্চিন্তে তাদের সাহায্য চাইতে পারে বলে জনগণের মনে দৃঢ় ধারণা প্রচলিত আছে। এই প্রতিবেদনের পর নানামুখী মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই। আর গত কিছুদিন ধরে এদেশের মন্ত্রী, এমপি পর্যায়ে যেসব অনিয়মের অভিযোগ উঠছে, সেসব আলাপ না হয় আজ বাদই থাকল।
কথাটা হচ্ছে, যদি বাঙালির সঙ্গে তাদের তুলনা করতেই হয়, তবে পার্থক্যটা খুব সম্ভবত হবেÑ ল অ্যান্ড অর্ডারে। মানুষ আসলে প্রকৃতিগতভাবে স্বেচ্ছাচারিতার জীবাণু নিয়ে জন্মায়। দেশ ও সমাজের আইন সেটার সীমা নির্ধারণ করে দেয়। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সেই সীমা মানা হচ্ছে কি না, তার নিশ্চয়তা বিধান করে।

উন্নত দেশগুলোতে অন্যায় করার পরে আপনি যদি ধরা পড়েন, সে আপনি সাধারণ জনগণ কিংবা প্রধানমন্ত্রী যেই হোন না কেন, আপনাকে শাস্তি পেতে হবে। এ জায়গাটাতেই মূল পার্থক্যটা ঘটে যাচ্ছে। আমাদের একটাই সমস্যা, আইন আছে আইনের মতো, সেটাকে প্রয়োজন মতো প্রয়োগ করার পরিবেশটা নিশ্চিত করতে পারছি না। 

লন্ডন, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ 

লেখক : কথাসাহিত্যিক

[email protected]

×