
দেশের শ্রমশক্তি দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর
দেশের অর্থনীতির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা যে কয়টি খাতের ওপর নির্ভরশীল তার মধ্যে অন্যতম রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। সরকারী হিসেবে বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশী কর্মী আছেন ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি। যাদের ঘাম ও শ্রমে উপার্জিত অর্থ দেশে এলেই তাকে আমরা প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স বলে থাকি। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রমাণ হয়েছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারীর সময়। করোনার পরপরই শুরু হওয়া বর্তমান বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কটেও প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রাই বাংলাদেশের বড় সম্বল।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার পর, বিশ্বব্যাপী দেউলিয়া আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যত নিয়েও যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, তাতেও আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে এই রেমিটেন্স। বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠিত বহুপক্ষীয় ট্রাস্ট ফান্ড দ্য গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্প্রতি জানিয়েছে, সব আশঙ্কা দূর করে ২০২০ সালে বাংলাদেশ ২২ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (১ ডলার = ৮৪ টাকা) রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় পেয়েছে। এর ফলে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে বাংলাদেশ ২০১৯ সাল থেকে এক ধাপ এগিয়ে ২০২০ সালে সপ্তম স্থানে উঠে আসে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-েও এ অর্থ ব্যয় হয়। রেমিটেন্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ ব্যয় হয় দৈনন্দিন খরচের খাতে। এতে ওই পরিবারগুলোর দারিদ্র্য দূর হচ্ছে।
রেমিটেন্স পাওয়ার পরে একটি পরিবারের আয় আগের তুলনায় ৮২ শতাংশ বাড়ে। সংখ্যাতাত্ত্বিক এসব হিসাবনিকাশের বিপরীতে যদি বলা হয়- বাংলাদেশ প্রবাসীদের কী দিচ্ছে- তাহলে আমাদের নিরাশ হতে হয়। সরকারের মতে, ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি প্রবাসীর অধিকার, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব শ্রম কল্যাণ উইংয়ের। কিন্তু বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশী কর্মীরা গেলেও তাদের সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষায় ২৬টি দেশের বাংলাদেশ মিশনে শ্রম কল্যাণ উইং আছে মাত্র ২৯টি, যার মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ইতালিতে ২টি করে।
সৌদি আরবে ২৩ লাখের বেশি বাংলাদেশী শ্রমিকের জন্য যে ২টি উইং আছে, সেখানে জনবল মাত্র ১২ জন। এত বিপুল সংখ্যক প্রবাসীর সেবা নিশ্চিত করা এত ক্ষুদ্র জনবল দিয়ে কিভাবে সম্ভব? আর যেসব দেশে উইং নেই, তাদের জন্য কী হবে? বিপদগ্রস্ত-দুর্ঘটনাকবলিত-বঞ্চিত প্রবাসীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, নারী কর্মীদের নিগ্রহ থেকে বাঁচানো, প্রবাসে লাশ হওয়া বাংলাদেশীর অধিকার রক্ষা ও ক্ষতিপূরণ আদায়সহ প্রবাসীদের যাবতীয় সমস্যার দেখভাল করাই মূলত শ্রম কল্যাণ উইংয়ের কাজ। কিন্তু প্রবাসীরা দীর্ঘদিন থেকেই এ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের ইমিগ্রান্ট নাগরিকদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়। উন্নত সব দেশেই প্রায় একই অবস্থা।
নাগরিক হয়েও যদি তারা তৃতীয় শ্রেণীর পরিগণিত হন, তাহলে অদক্ষ ও অল্প দক্ষ শ্রমিক-কর্মীরা কী সমাদর পান, তা সহজেই অনুমেয়। প্রবাসীদের আমরা অর্থনীতির মেরুদ- বলি। অথচ প্রায়ই দেখা যায়, নিজের দেশের বিমানবন্দরে প্রবাসী কর্মীদের প্রচ- দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়। হয়রানির শিকার হওয়া যেন তাদের নিয়তির লিখন।
১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে অনাবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থ বৈধ মাধ্যমে দেশে নিয়ে আসার জন্য মজুুুরি উপার্জনকারীর প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের মধ্যে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে প্রকল্পটি। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসীরা প্রায় ১১.৮ মিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স প্রদান করেছিলেন। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে যা ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর থেকে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রতিবছরই দেশে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণ বেড়েছে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ৬-৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন দেশে যায়। প্রতিমাসে বাংলাদেশ থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ বিদেশে যায়। এসব প্রবাসী বছরে গড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠায়। স্থানীয় মুদ্রায় যা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। যা দেশের মোট রফতানি আয়ের অর্ধেকের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩০ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরে নতুন যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বলা হয়েছে, রেমিটেন্স উর্ধমুখী হবে এবং চলতি অর্থবছরে গত বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২৮ দিনে গড়ে প্রতিদিন ৭ কোটি ডলার করে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত অর্থবছরে গড়ে প্রতিদিন ৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম ছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। ওই সময়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ওই অর্থবছরে প্রতিদিন গড়ে ৬ কোটি ৭৯ ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। কোভিডের কারণে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠাতে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনার কারণে সামষ্টিক পর্যায়ে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পায়। প্রতিবছর বাজেট এলেই প্রবাসীরা অপেক্ষা করেন বাজেটে তাদের জন্য কিছু আছে কি না, তা দেখতে। বেশির ভাগ সময় তাদের নিরাশ হতে হয়।
২০২১-২০২২ অর্থবছরের শুরুতে প্রবাসী আয় কিছুটা হ্রাস পেতে শুরু করায় বৈধপথে প্রবাসী আয় পাঠানোয় অধিকতর উৎসাহ দিতে সরকার প্রণোদনার হার ০.৫ শতাংশ বাড়িয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২.৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। প্রবাসীরা এতে খুশি হয়েছেন। কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের অনেক দাবি পূরণ এখনও অধরাই রয়ে গেছে। অথচ দেশে জীবনযাত্রার মান, কাঠামোগত নির্মাণ, আবাসন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে রেমিটেন্স। দেশের বিপুলসংখ্যক প্রবাসীরা তাদের পরিবারের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত টাকা পাঠায়।
ফলে, সরকারের বিপুলসংখ্যক পরিবারের দায়ভার নিতে হয় না। তা ছাড়াও প্রবাসীরা যদি নিজের সন্তান বা নিকট আত্মীয় একজনকে আত্মকর্মসংস্থান বা কুটিরশিল্প স্থাপনের জন্য অর্থ সহায়তা করে, তাহলে একসঙ্গে কয়েক যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং বেকার সমস্যার লাঘব হবে। অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হয়। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে কেমন অবদান রাখে তা প্রবাসী-অধ্যুষিত এলাকা এবং অন্য এলাকার উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মান তুলনা করে দেখলেই বোঝা যায়। প্রবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলে শিক্ষার হার ও জীবনযাত্রার মানের দ্রুত উন্নতি হয়।
বিএমইটির গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পুরুষ প্রবাসে গেছে কুমিল্লা জেলা থেকে। তারপরই রয়েছে চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল ও নোয়াখালী। অন্যদিকে সবচেয়ে কম পুরুষ প্রবাসে গেছে তিনটি পার্বত্য জেলা এবং উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে। প্রবাসী-অধ্যুষিত এলাকায় জমির মূল্য, আবাসন ব্যবসা, বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতাল প্রভৃতির সংখ্যা অন্য এলাকা থেকে অনেক বেশি। প্রবাসী-অধ্যুষিত জেলার মানুষের জীবনযাত্রার মান ও মাথাপিছু ব্যয়ক্ষমতা অন্য জেলার মানুষের তুলনায় বেশি।
প্রতিটি অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় তারা আরও বেশি রেমিটেন্স পাঠান। দেশের অর্থনীতিতে আশার আলো জ্বালান। আমরা তাদের এই অবদানের কতটা মূল্যায়ন করি? কতটা নিরাপদ তাদের প্রবাসজীবন? কিংবা কী প্রতিদান তারা পেয়েছেন? আড়ালে-আবডালে তাদের আমরা ‘কামলা’ বলি। বাংলাদেশের শ্রমিক অদক্ষ বা নিরক্ষর হওয়ায় তাদের নিম্নমানের কাজ করতে হয়। সেসব কাজের ঝুঁকি বেশি, কিন্তু বেতন অপর্যাপ্ত।
তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিকরণে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে। প্রবাসীদের সব সমস্যার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। তাদের ভোগান্তির শুরু হয় ঘর থেকে। রেমিটেন্স যোদ্ধাদের বেশির ভাগ গ্রামের অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ। দালালরা প্রবাস জীবনের কষ্টের কথা গোপন করে উচ্চ বেতন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাজের জায়গা, বিলাসী জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখিয়ে বিদেশ পাঠানোর ফাঁদে ফেলে তাদের। তারপর পাসপোর্ট, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ডাক্তারি পরীক্ষা, ভিসা, ইমিগ্রেশন, স্মার্টকার্ড এবং বিমান ভাড়া ইত্যাদির কথা বলে হাতিয়ে নেয় প্রয়োজনের কয়েকগুণ টাকা।
সহজ-সরল মানুষগুলো প্রবাসে গিয়ে দুর্দিন পার করে। দেশে মাত্র দুটি ব্যাংক প্রবাসীদের বিদেশ যেতে ঋণ দেয়- রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক অগ্রণী ও বেসরকারী প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। তাদের প্রদানকৃত ঋণও প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠানোর খরচও তুলনামূলক অন্যদেশের থেকে বেশি। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এক জরিপ শেষে বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বলে তথ্য প্রকাশ করে। সংস্থাটির মতে, পুরুষ কর্মীর ক্ষেত্রে তা ৭ লাখ টাকা এবং মহিলা কর্মীর ক্ষেত্রে তা ৯৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পৌঁছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা মাইগ্রেশন ডেটা পোর্টাল ২০১৭ সালের উপাত্তের ভিত্তিতে জানিয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে একজন ভারতীয় শ্রমিকের কাজ পেতে খরচ হয় ১ হাজার ১৫৬ ডলার বা ১ লাখ টাকা, যা সে দুই মাসে আয় করতে পারে।
একজন নেপালী খরচ করে ১ হাজার ৮৮ ডলার বা ৯৫ হাজার টাকা, যা তিন মাসের আয়। সবচেয়ে কম খরচ হয় ফিলিপিন্সের শ্রমিকের, যার অঙ্ক মাত্র ৪১৪ ডলার বা ৩৬ হাজার টাকা, যা তারা এক মাসেই আয় করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের শ্রমিক ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করে কাতারে যান এবং ১৫-২০-২৫ হাজার টাকার নিম্নবেতনেই কাজে নেমে পড়েন। এত অভিবাসন ব্যয়ের সমপরিমাণ টাকা আয় করতে তার বছরের পর বছর সময় লাগে। অনেক সময় বিদেশের কর্মস্থলে অমানবিক অবস্থা সত্ত্বেও বাংলাদেশী শ্রমিক-কর্মীকে বাধ্য হয়েই দাসের জীবন কাটাতে হয়। কারণ, বিপুল অর্থ খরচ করে তাকে প্রবাসে যেতে হয়েছে। যা তিনি জমি বেচে অথবা এনজিওর উচ্চ সুদে ঋণ করে সংগ্রহ করেছেন।
সরকারের যথাযথ নজরদারি ও অবহেলার কারণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালদের ওপর নিভর্রশীল। বাধ্য হয়ে বিদেশগামীরাও এসব মধ্যস্বত্বভোগীর ওপর নির্ভরশীল। এই অবস্থার জরুরী অবসান প্রয়োজন।
প্রবাসীদের ভোগান্তি দূর করতে প্রবাসজীবনের শুরু থেকেই কাজ করতে হবে। প্রবাস সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ দালালের ফাঁদে না পড়েন। মানব পাচারকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্মূলে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের শ্রমশক্তি দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করার লক্ষ্যে কর্মসূচী নিতে হবে। তাদের বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে।
রেমিটেন্সের প্রবাহ ঠিক রাখতে দক্ষদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিমানবন্দরের আসা-যাওয়ায় চরম ভোগান্তি দূর করতে হবে। প্রবাসীদের যাতায়াতের জন্য দেশের বিমানবন্দরসমূূহে পৃথক চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারাই আমাদের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কমাতে হবে অভিবাসন ব্যয়। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় অভিবাসন হলে ব্যয়ের বিষয়টি বিদেশে গমনেচ্ছুক ব্যক্তির স্বার্থে করতে হবে। প্রবাসে তাদের দুর্ভোগ নিরসনে আগামী পাঁচ বছরে ১০ হাজারের উর্ধে প্রবাসী-অধ্যুষিত দেশে প্রবাসী উইং প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দূতাবাস ও মিশনগুলোর স্বদেশী ও অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে সেবা দিতে হবে।
সরকারকে শ্রমবাজার বৃদ্ধি ও প্রবাসীদের কল্যাণ বিষয়ে গবেষণা সেল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রবাসীদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ বিস্তৃত করতে হবে, যাতে তারা উৎসাহিত হন। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি বৈদেশিক রেমিটেন্সের গুরুত্বকে অনুধাবন করে জনশক্তি রফতানি খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারীভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে জনসংখ্যার সমস্যাকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে দেশের বেকার সমস্যার নিরসনসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বিকাশে বিশাল সুযোগ হবে। বিদেশ গমনেচ্ছুদের জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি করে বিশেষায়িত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের বিদেশ গমনের জন্য সহজ শর্তে সরকারীভাবে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হলো, যারা বিদেশে যেতে চায় তাদের টাকার অভাব। এ সমস্যা দূরীকরণে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এর ফলে সরকার একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রচুর দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে। যে নীতিমালায় প্রবাসীদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি