ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

ড. মোঃ জামাল উদ্দিন

খাদ্যে ভেজাল রোধে করণীয়

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

খাদ্যে ভেজাল রোধে করণীয়

তোমরা যারা লাভের আশায়, মেশাও ভেজাল খাবারে! অন্যের মেশানো ভেজাল আবার, ফিরবে তোমারও আহারে! বন্ধুবর প্রফেসর নুরুল আলম ভাইয়ের চার লাইন ছড়া নিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। ছড়াটির মধ্যেই শিরোনামের মূল ভাবার্থ নিহিত আছে। লাভের আশায় খাবারে যেমন ভেজাল মেশায় এটা যেমন ঠিক, তার আহারেও ভেজাল চলে আসে তার অজান্তে, এটা আরও সঠিক। তারপরও ভেজালকারী ছল-চাতুরি করে খাবারে ভেজাল মেশায়। এটা তার সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু এটা নৈতিকতাবিরোধী কাজ। খানিক লাভের আশায় তারা মত্ত থাকে। হুশ-জ্ঞান সব ঠিক থাকলেও টাকার নেশায় থাকে মত্ত। কত মানুষের জীবন নষ্ট করে! ধরা পড়লে এমন ভাব দেখায় মনে হয় মনের অজান্তেই ভেজাল মিশিয়েছে। এটা কোন মানবিক গুণাবলী হতে পারে না। খাবারে ভেজাল মেশানো মারাত্মক অপরাধ, আইনত দ-নীয়। ‘ভেজাল’ একটি নেতিবাচক শব্দ। যার অর্থ মিশ্রিত, মেকি বা খাঁটি নয় এমন। উৎকৃষ্ট দ্রব্যের সঙ্গে নিকৃষ্ট দ্রব্যের মিশ্রণকে ভেজাল বলে। অন্য কথায় খাদ্যের পরিমাণ, স্থায়িত্ব অথবা স্বাদ বৃদ্ধির জন্য কাঁচা বা প্রস্তুতকৃত খাদ্য সামগ্রীতে এক বা একাধিক ভিন্ন পদার্থ সংযোজন করাকে বোঝায় ভেজাল। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ মতে, ‘বিভিন্ন উপায়ে খাদ্যে পরিবর্তন সাধন করে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, আইনের অধীন নিষিদ্ধ, খাদ্য দ্রব্যের ক্ষতি হয়েছে, গুণাগুণ বা পুষ্টিমান কমে গেছে, খাদ্য ক্রেতার আর্থিক বা স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়েছে’ এমন খাদ্যই ভেজাল খাদ্য। খাদ্যে ভেজাল দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদ- ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। বিশুদ্ধ খাদ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি এখন দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। ভেজালকারী অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে নষ্ট হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তিও। ভেজালমিশ্রিত খাবার খাওয়ার ফলে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সার, হৃদরোগ, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি অনেক বেড়ে যাচ্ছে। শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়াও এ্যালার্জি, এ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্য বিষক্রিয়া, অরুচি, উচ্চরক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট এ্যাটাক প্রভৃতি রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ ছাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসবের বেশিরভাগই ভেজাল খাদ্যের প্রভাব। খাদ্যে ভেজাল এখন মানব জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। ভেজালের প্রবণতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে মানুষ খাদ্যে ভেজাল দিয়ে থাকে। এর মধ্যে অধিক মুনাফা লাভের আশা, নৈতিকতার অভাব, তদারকির অভাব, আইনের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব, যথাযথভাবে টাটকা খাদ্য সংরক্ষণের সুযোগ-সুবিধা বা প্রযুক্তির অভাব, খাদ্য পরিবহন ও সংরক্ষণকালীন অপচয় পুষিয়ে নেয়া এবং ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ ইত্যাদি। খাদ্যে ভেজাল দেয়ার কারণ পর্যালোচনা করলে ভোগী মনোবৃত্তি ও বিবেকহীনতার পরিচয় মেলে বেশি। স্বল্প সময়ে অধিক উপার্জন করার দিকেই ভেজালকারীদের লক্ষ্য থাকে বেশি। খাদ্যে ভেজাল দিতে গিয়ে মানুষের যে চরম সর্বনাশ ঢেকে আনছে, সেটা বিবেচনা করার মতো বিবেকবোধের চরম অভাব। তাদের মনোজগতের পরিবর্তন দরকার। আর তা করতে হলে মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে বেশি বেশি ধর্মীয় বক্তব্য প্রদান করে পরকালীন শাস্তির কথা বলে ভেজালকারীদের সতর্ক করা যেতে পারে। সে সঙ্গে আইনের বিষয়ে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে চালানো যেতে পারে প্রচারণা। মাঝে মাঝে আইনের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি মোবাইল কোর্ট বসিয়ে জরিমানা চলমান রাখা যেতে পারে। বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিও জরুরী। সেই সঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। সরকার খাদ্যে ভেজাল রোধে দেশে বিশেষায়িত পরীক্ষাগার স্থাপন করার উদ্যোগ গ্রহণসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’ এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করেছে। নিরাপদ খাদ্য আইনে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য বা এর উপাদান বা বস্তু, কীটনাশক বা বালাইনাশক, খাদ্যের রঞ্জক বা সুগন্ধি বা অন্য কোন বিষাক্ত সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়া সহায়ক কোন খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভুক্তি অথবা উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ মজুদ, বিপণন বা বিক্রয় করলে অনুর্ধ পাঁচ বছর থেকে চার বছর কারাদ- বা অনুর্ধ ১০ লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। আবারও একই অপরাধ সংঘটন করলে পাঁচ বছর কারাদ- বা ২০ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-। এ ছাড়াও খাদ্য নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপন, নিবন্ধন ছাড়া খাদ্যপণ্য বিপণন, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত কাউকে দিয়ে খাদ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ-ের বিধান রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ এ যেসব কার্যকলাপকে অপরাধ গণ্য করা হয়েছে তা হলোÑ আইন ও বিধি দিয়ে নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও পণ্যে মোড়ক ব্যবহার না করা; মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা; সেবার মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা; ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা; ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা; খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশ্রণ করা; মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা; প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা; ওজনে কারচুপি করা; বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শন করা; পরিমাপে কারচুপি করা; দৈর্ঘ্য পরিমাপক কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা; পণ্যের নব প্রস্তুত বা উৎপাদন করা; মেয়াদোত্তীর্ণ কোন পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা; সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করা এবং অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দিয়ে সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ঘটানো। ভোক্তা অধিকার আইন ও নিরাপদ খাদ্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে খাদ্যে ভেজাল দেয়ার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। পাশাপাশি দেশের প্রধান খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) আরও সতর্ক ও সক্রিয় হয়ে ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে। শহরের দোকান ও রেস্টুরেন্টে ভেজালবিরোধী অভিযান চালানোর পর কিছুদিন ভেজালমুক্ত খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়। কিন্তু পরেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। মনোজগতের পরিবর্তন না এলে এটা হতেই থাকবে। এর থেকে পরিত্রাণে আমাদের সামাজিকভাবে নীতি-নৈতিকতা ও সততা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ভেজালরোধে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবোধ, উৎপাদক, বিপণনকারী, ভোক্তা সবাইকেই সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থা সমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভেজালবিরোধী কার্যক্রমকে আরও বেগবান করা সময়ের দাবি। ভেজালমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান করতে টাটকা অবস্থায় খাদ্যের দীর্ঘ সংরক্ষণের ব্যবস্থা যেমন জরুরী, তেমনি স্বল্প-খরচের এসবের প্রযুক্তি উদ্ভাবন দরকার। প্রযুক্তি ব্যবহারে খাদ্যের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি হবে বটে, কিন্তু তাতে টাটকা পণ্যের খাদ্যমান বজায় থাকবে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে বেসরকারী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক টাটকা পণ্যের উপযোগী উন্নত প্রযুক্তি ও স্থাপনা নির্মাণ করে ভেজালমুক্ত খাদ্য সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা যেতে পারে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিটি এলাকায় পণ্য ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে সমিতির নিবন্ধিত টাটকা পণ্য বা খাবার ক্রয় করে স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে উন্নত প্যাকেজিং ও লেবেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারলে খাদ্যের ভেজাল যেমন রোধ করা যাবে, তেমনি অপচয়ও অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তবে ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে কিনা, সেটার মনিটরিং ব্যবস্থা থাকা উত্তম। পাইকারি বাজারগুলোকে উন্নয়নের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গড়ে তুলে টাটকা খাবার বা পণ্যের উন্নত সংরক্ষণ ও ডিসট্রিবিউটর বা হোম ডেলিভারির মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থা করতে পারলে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ বাড়বে। ভেজাল রোধে দরকার ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা, প্রচার মাধ্যমের দায়িত্বশীলতা, প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন বন্ধ করা, সামাজিক প্রতিরোধ, নৈতিক শিক্ষা, উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত সব ধাপে নজরদারি, ভেজালবিরোধী আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান জোরালো করা এবং ব্যবসায়ীদের ভাল মানসিকতা। তবে খাদ্যে ভেজাল রোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। ‘একজন অন্যজনকে ঠকাবো না’ এমন মানসিকতাই পারে খাদ্যে ভেজাল রোধ করতে। রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারী উদ্যোগে বিজ্ঞাপন আকারে ভেজালবিরোধী প্রচার চালালে সুফল আসতে পারে। সংবাদ মাধ্যম, ইউটিউব এবং সেমিনারের মাধ্যমে নিজ নিজ উদ্যোগে প্রচার চালানো যেতে পারে। লিফলেট, পোস্টার, নাটক, জারিগান, কার্টুন ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনসচেতনতার ব্যবস্থা করা, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার পাঠ্য বইয়ে খাদ্যপণ্যে ভেজাল নিয়ে সমসাময়িক বিষয় অন্তর্ভুক্ত এবং মুক্ত আলোচনা করা, খাদ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা অতীব জরুরী। পূর্বঘোষণা ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলে খাদ্যে ভেজাল রোধ সম্ভব। সেই সঙ্গে পাড়া বা মহল্লায় যুব সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খাদ্যে ভেজাল রোধে সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে সুফল মিলবে অনেক বেশি পরিমাণে। লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ সিনিয়র বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি); সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, এফএও
×