ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

অনন্য এক কন্যার কাহিনী

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২৮ নভেম্বর ২০১৮

অনন্য এক কন্যার কাহিনী

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) শেখ হাসিনার বক্তব্যে উঠে আসে তিনি কেমন আছেন পাকিস্তানের কারাগারে, সেটাও তারা কখনও জানতে পারেননি। পাক সেনাবাহিনী পরিবেষ্টিত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর পরিবারও স্বস্তির জীবন কাটাতে পারেনি। সেই নয় মাসের দুঃসহ যন্ত্রণা আজও স্মৃতির পাতাকে ক্ষত-বিক্ষত করে রেখেছে। ১৬ ডিসেম্বর অনিবার্য বিজয়কে পাকিস্তানী সরকারের পক্ষে আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতার করুণ আখ্যানই শুধু নয়, প্রায় ১ কোটি গৃহহীন বাঙালীর ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়াÑসবই যেন এক বিভীষিকাময় বিপর্যয়। এমন সমূহ শ্বাপদ সঙ্কুল অরণ্য থেকে সংগ্রামের দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় পাশে এসে দাঁড়ায় ভারত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে দৃপ্ত মনোবল আর অসম সাহসে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এবং বাঙালীদের পাশে এসে দাঁড়ান, তার নজির সত্যিই বিরল। অবশেষে স্বাধীনতা এলো। মুক্ত দেশে বঙ্গবন্ধু নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন। বহুকাক্সিক্ষত স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে লন্ডন হয়ে ভারতে যাত্রা বিরতি করে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন। দেশে ফিরে মুক্তির আনন্দে বিহ্বল না হয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত মাতৃভূমিকে নতুন করে গড়ার প্রত্যয়ে নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশীয় রাজাকার-আলবদরদের বাঙালী বিবেচনায় তাদের সীমাহীন ঘৃণ্য অপরাধকে মার্জনার আবরণে ঢেকে দিলেন। নয় মাসের সংগ্রামী পথযাত্রায় নিজ পরিবারের অসহনীয় দুর্ভোগকে অদম্য মনোবলে অতিক্রম করলেন স্বাধীনতার লাল সূর্যকে অভিনন্দন জানিয়ে। যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে যে সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিলেন তিনি, সেখানে নিজের সর্বশক্তি আর আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলেন না সময় স্বল্পতার কারণে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি গড়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়ার বদলে বঙ্গবন্ধুকেই অকালে, অসময়ে বিদায় নিতে হয় কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী মহলের নৃশংস ষড়যন্ত্রে। জাতির পিতার সঙ্গে থাকা পুরো পরিবারের পরিণতিও অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক। দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকার কারণে মৃত্যুকে জয় করলেও, সেই দুঃসময় থেকে সামনে চলার পথ কখনও সুনিশ্চিত, নির্বিঘœ এবং নিরাপদ হতে পারেনি। যশসী পিতার অতি সাধারণ কন্যার কাহিনী তো সেই থেকে শুরু। পরিচালক দুঃসাহসিক পিতার লাজুক, নম্র কন্যার কাহিনীর গতি নির্ণয়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক ও ঐতিহাসিক সময়গুলোকে যে মাত্রায় অভিষিক্ত করেন সেখানে বাবা-মেয়ের আন্তরিক বন্ধন, সময় কাটানো, প্রতিদিনের পারিবারিক বিশুদ্ধ আঙ্গিনায় পারস্পরিক সহমর্মিতা সবই শৈল্পিক সুষমায়, বাস্তব জীবন বোধে পরিশীলিত ও স্বাভাবিকতার বাতাবরণে দর্শকের সামনে চলে আসে। মনে হয় না কোন চলচ্চিত্র দেখছি। স্বাভাবিক, সাবলীল ধারায় শেখ হাসিনার দুর্বিপাকে পড়া জীবন কাহিনীকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যায় না। বেলজিয়ামের সেই বর্ণাঢ্য পার্টির আয়োজন থেকে ছিটকে পড়ে জার্মানির উদ্দেশ যাত্রা এবং রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সার্বিক সহযোগিতায় ভারতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয় এবং সান্নিধ্য লাভ করার কঠিন পথপরিক্রমা সত্যিই বিস্ময়ের, কষ্টকর, মর্মস্পর্শী বাস্তব জীবনের এক করুণ আখ্যান। ছবিতে শেখ রেহানার একটি বিষাদঘন মর্মকথাÑ আব্বাকে হারানোর ব্যথা সারা জাতিকে নিয়েই অনুভব করতে হয়েছে। আব্বা তো শুধু তাদের নয়, মুক্তিকামী আপামর বাঙালীর। সেদিন তাদের সঙ্গে সারা বাংলাও নিঃস্ব হয়, পিতৃহীন হয়। কিন্তু মাকে হারানোর ব্যথা দুই বোনকেই একা বহন করতে হয়েছে। সেই অসহনীয় বেদনাঘন বিয়োগ আর কারও সঙ্গে ভাগ করা যায়নি। সন্তানের জীবন গড়াই শুধু নয়, সার্বক্ষণিক সাহচর্যে মাতৃত্বের অনন্ত মহিমায় যেভাবে চলার পথ অবারিত হয়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভবে ছেলেমেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নকে পূর্ণতায় নিয়ে যায় তার অভাব আবার কতখানি তাদের নিঃসঙ্গতা আর শূন্যতায় ভরিয়ে দেয়, সে যন্ত্রণা প্রতিমুহূর্তে দিশেহারা করেছে। ভারতে কয়েক বছরের অবস্থানে প্রতিদিনের যাপিত জীবনের চালচিত্র দর্শকদের শুধু মুগ্ধই করে না, জাতির স্থপতির কন্যাদের কঠিন ও বাস্তবাসম্মত চ্যালেঞ্জকেও একেবারে সামনে নিয়ে আসে। এক সময় শেখ রেহানা ইংল্যান্ডে চলে যান। আর তখন প্রধানমন্ত্রী একাই জীবনের দুর্গম, বিপন্ন পথ পাড়ি দিতে দিতে ১৯৮১ সালের মে মাসে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। এর পরও সংগ্রাম, বিপর্যয়, টানাপোড়েনের দুঃসহ অভিযাত্রা প্রতিদিনের সঙ্গী হিসেবে পাশেই থাকে। ১৯৯০ সালের এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান হলে নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ধারা সূচীত হয়। ইতোমধ্যে পিতার রেখে যাওয়া দল এবং শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের সমন্বয়ে নতুন উদ্যমে তৈরি হওয়াÑ সেও জীবনের এক অবধারিত পর্ব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন, যা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় অনিবার্য ছিল, সেই প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক ভোটাধিকারের রায়ে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মতো আসন না পাওয়ায় দেশের শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে সংগঠনের ভিত্তিকে আরও শক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এক দীর্ঘ সময়ের মহাসঙ্কট থেকে পুনরায় উজ্জীবনের প্রত্যয় ব্যক্ত করে দলকে যে মাত্রায় সংহত আর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে চালিত করেন, তার সুফল পেতেও বেশি দেরি হয়নি। বিরোধী দলের ভূমিকায় নিজের অবস্থান যতই শক্ত আর দৃঢ় হোক না কেন, বিপন্ন জীবনের ধারাবাহিকতায় সে অবধি কোন সুস্থির কিংবা নিরাপদ থাকার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারেনি। স্বাধীনতাবিরোধী এবং প্রতিপক্ষ অপশক্তি সব সময় চক্রান্তের ব্যুহ রচনা করে জীবন মরনসহ বার বার হয়রানি করতে পিছপা হয়নি। কত অশনি সঙ্কেত, বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, ইতিহাসে সে চিত্রও জীবন্ত এবং দৃশ্যমান। সমস্ত প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে ১৯৯৬ সঙ্গে ২১ বছর পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগিরষ্ঠতা পেয়ে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে নিজেকে নিবেদন করতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। কারণ ২১ বছরের আবর্জনা এবং অভিশাপকে মুছে ফেলা ছিল সময়ের ব্যাপার। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের প্রক্রিয়ায় হাজির করাও ছিল প্রধানমন্ত্রীর জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ এই জঘন্য হত্যার বিচার হতে পারবে না বলে সংসদে আইন পাস করা ছিল। তাকে অতি সহজে বাতিল করাও ছিল দুঃসাধ্য। পুরনো আইনকে নাকচ করে নতুন বিধি প্রবর্তন করাÑসেও এক অবর্ণনীয় কঠিন কর্মপ্রক্রিয়া। শেষ অবধি এই জঘন্য নরহত্যাকে বিচারিক আওতায় আনা হলে নতুন আইনে মামলা শুরু করা হয়। সেও এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যার জন্য ৫ বছর ছিল অতি অল্প সময়। শুধুই কি বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার? যে সব স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি বাংলাদেশের পতাকাবাহী গাড়িতে চড়াই শুধু নয়, মন্ত্রিত্বের মর্যাদাপূর্ণ আসনকে কলঙ্কিত করেছে, সেই সব চক্রান্তকারীকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে দ্বিতীয়বার (২০০৮) ক্ষমতায় আসতে হয়। ২০০১ সালে আবারও চক্রান্তের শিকার হন। ফলে ঘটে ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার মতো এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সেই আগস্ট মাসে। পরিকল্পিত হত্যাকা-ের বিচার শেষ মেশ সর্বসাধারণের সম্মুখে আসতেও অনেক সময় লাগে। সে বিচারের রায়ও আজ প্রকাশিত। ২০০৮ সাল থেকে বীরবিক্রমে বঙ্গবন্ধু তনয়ার এগিয়ে যাওয়া আজ নিরন্তর গতিপ্রবাহে উন্নয়নের ধারাকে অবারিত করে যাচ্ছে মাত্র দশ বছরে। তাঁকে আরও মুক্ত ও অবাধ করতে হলে শেখ হাসিনার বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। (সমাপ্ত) লেখক : সাংবাদিক
×