ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শ্রমিকের শ্রম-ঘামে নির্মাণ হচ্ছে রেল সেতু 

খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা কেমন আছেন?

ইফতেখারুল অনুপম

প্রকাশিত: ০১:০৯, ৩ মে ২০২৪

খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা কেমন আছেন?

শ্রমিকদের ঘাম ঝরানো কষ্টে তৈরি হচ্ছে রেল সেতু

নাম আবু হানিফ। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদরে। চার সদস্যের সংসার তার পরিবারে। একটি তাঁতপল্লিতে কাজ করতেন। করোনার সময় তিনি তাঁত বন্ধ হয়ে যায়। এতে বেশ কিছুদিন বাড়িতে বসা ছিলেন। তারপর বিভিন্নজনের কাছে ঘুরে খোঁজখবর নিয়ে বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে নির্মাণ শ্রমিকের চাকরি নেন। বঙ্গবন্ধু সেতু রেল ট্যাগে শুরু থেকেই কাজ করে চলেছেন। মধ্যবয়সি আবু হানিফ বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে কাজ করে আনন্দ পাচ্ছি। এত বড় কাজের আমি একজন শ্রমিক হয়ে কাজ করছি এটা আল্লাহপাকের ইচ্ছা। এখানে আমার মতো আরও বহু শ্রমিক কাজ করছেন।

এ কাজ করার পর থেকেই আমার সংসার ভালো চলছে। এখানে রেলের ক্যাবল, ক্লিপ লাগানোর কাজ করি। বর্তমানে রোদ উপেক্ষা করে খুব কষ্ট নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তারপরও তো করতে হবে, আমার ওপর নির্ভর করে সংসার। রোদ আর জিনিসপত্রের যে দাম সে অনুযায়ী আমাদের পোষায় না। এখানে কাজের জন্য মাসে ১৩-১৪ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি। আমাদের বেতন ১৮-২০ হাজার হলে পরিবার নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারব। কষ্ট হলেও আনন্দ পাই, কারণ দেশে এত বড় একটা রেল সেতু হচ্ছে। আমার পরিবার ও আমি গর্ব করে বলতে পারব এখানে কাজ করেছি। দেশের জন্য কাজ করছি, ভালো লাগে। 
বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ কাজে শুধু আবু হানিফ নন, তার মতো বিভিন্ন পদে কাজে নিয়োজিত রয়েছেন শত শত শ্রমিক। সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে। শত শত শ্রমিকরা সেখানে কাজ করছেন। কেউ পাথর টানছেন, আবার কেউ রেল সেতুর কাজ করছেন। এভাবেই শ্রমিকরা প্রতিনিয়তই কাজ করে যাচ্ছেন। আরেক শ্রমিক শহিদুল ইসলাম বলেন, এর আগে অন্য জায়গায় কাজ করতাম। যমুনা নদীতে রেল সেতুর কাজ শুরু হলে এখানে চাকরি নেই।

এটাতে বেতন ভালো দেখে এখানেই রয়েছি। আমি ১৮-২০ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি। পরিবার নিয়ে বর্তমানে অনেক সুখে আছি। এখন অনেক রোদের মধ্যে কাজ করতে হয়, অনেক কষ্ট হয়। তারপরও ভালো লাগে, কারণ ছেলেমেয়ে গর্ব করে বলতে পারবে বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে আমার বাবা কাজ করছেন। তিনি আরও বলেন, এক ছেলে ও এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে আমার সংসার। মেয়ে এমএ পাস করেছে। ছেলে অনার্স শেষবর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের একটা চাকরি হলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে। এই রোদের মধ্যে কাজ করতে হবে না।

এখানে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর আমার বাড়ি। সেখান থেকে এসে ডিউটি করি। পরিবারের সঙ্গেও সময় দিতে পারি। অনেক ভালো লাগে এখানে কাজ করে। আমি পদ্মা সেতুতে কাজ করেছি, বরিশালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করেছি। বর্তমানে এখানে কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে এত বড় রেল সেতু নির্মাণ হচ্ছে। আমরাও কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর কাজ শেষ হওয়ার পর আবার কোথায় যাবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই কাজ শেষ হওয়ার পর কি করব জানি না, আল্লাহ কপালে যেখানে রেখেছেন সেখানেই হবে।
অপর শ্রমিক আবু রাজ্জাক বলেন, আমি ২৪ বছর টেক্সটাইলে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেছি। ছায়ার মধ্যে সব সময় থাকতাম। ওই কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে কাজ করছি। এখন প্রচ- রোদে পুড়ে কাজ করতে হচ্ছে। কাজ করতে খুব কষ্ট হয়। তবুও কি করব, বসে থাকলে তো পেট চলবে না। বউ-পোলাপান না খেয়ে মারা যাবে।

প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়, যা বেতন পাই ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করিয়ে সংসার কোনো রকম চলে। আমাদের বেতন যদি বাড়ানো হয় তা হলে পরিবার নিয়ে ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে ভালোভাবে চলতে পারব। জানা যায়, যমুনা নদীর ওপর নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর শেষ ৪৯তম স্প্যানটি বসেছে গত ২০ এপ্রিল। এর মধ্যদিয়ে দৃশ্যমান হলো দেশের দীর্ঘতম রেল সেতুর পুরো অবকাঠামো। রেল সেতুতে যুক্ত হলো যমুনা নদীর দুই পাড়। এখন রেলপথ বসানোসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হলে এ সেতু দিয়ে চলবে ট্রেন। উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেলযাত্রীদের এখন সেটিরই অপেক্ষা।
সূত্র জানায়, গত ২০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর পশ্চিম অংশে ৫ থেকে ৬ নম্বর পিলারে ৪৯তম স্প্যান বসানো হয়। এর মধ্য দিয়ে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর সব স্প্যান বসল। আর এ পর্যন্ত সেতুর ৮৪ শতাংশ কাজ শেষ হলো। অবশিষ্ট কাজ শেষ হলে আগামী আগস্ট নাগাদ পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল ও ডিসেম্বরের শেষদিকে সেতু দিয়ে নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এতে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু দিয়ে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর ন্যূনতম ৩০ মিনিট (ক্ষেত্রবিশেষে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত) সময় সাশ্রয় হবে।

সেই সঙ্গে দিনে কমপক্ষে ৮৮টি ট্রেন দ্রুতগতিতে সেতু পার হতে পারবে। বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে সর্বশেষ স্প্যান বসানোর খবরে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বইছে উচ্ছ্বাসের হাওয়া। দেশি-বিদেশি ৫ সহস্রাধিক প্রকৌশলী-শ্রমিক দিন-রাত সুদক্ষভাবে সেতুটি বাস্তবায়নের কাজ করছেন। দেশের বৃহৎ রেল সেতু নির্মাণের সাক্ষী হতে পেরে উচ্ছ্বসিত তারাও।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, মূল সেতুর অবকাঠামোর কাজ শেষ। ফলে দৃশ্যমান হয়েছে রেল সেতুটি। অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করে টেস্টিং, কমিশনিং করে ডিসেম্বরের (২০২৪) শেষে বা জানুয়ারির (২০২৫) প্রথম সপ্তাহের দিকে সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শেখ নাইমুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর ভৌত কাজ শেষ হয়েছে ৮২ শতাংশ।

আর্থিক কাজের অগ্রগতি ৬০ দশমিক ৬১ শতাংশ। প্রকল্পের কাজ ডিসেম্বরে শেষ হলেও যাত্রী চলাচল শুরু হতে জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে বলে ধারণা এ প্রকল্প কর্মকর্তার। তিনি আরও বলেন, ফিক্সিং ও ট্র্যাক বসানো হচ্ছে এখন। একইসঙ্গে টেলিকমিউনিকেশনের কাজও শেষ করা হচ্ছে।
ইফতেখারুল অনুপম
টাঙ্গাইল

×