ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

থাইল্যান্ড সফরের প্রাপ্তি

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ২ মে ২০২৪

থাইল্যান্ড সফরের প্রাপ্তি

জাতিসংঘের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কমিশনের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ  হাসিনা

থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক জাতিসংঘের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কমিশনের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ  হাসিনা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরাইল-ইরান ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার যুদ্ধ বন্ধ করতে বিশ^নেতাদের প্রতি আহ্বান জানাই। কারণ, যুদ্ধের ভয়াবহতা আমরা জানি। বাংলাদেশ কোনো যুদ্ধ চায় না। আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। উক্ত সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত নিয়ন্ত্রণে আসিয়ানকে ভূমিকা রাখারও আহ্বান জানান জননেত্রী শেখ হাসিনা

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই যুগে বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই একা পথ চলতে পারে না। প্রতিটি দেশই কোনো না কোনোভাবে অন্য কোনো দেশের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব রাজনীতিতে সফলতার সঙ্গে টিকে থাকতে হলে বিশে^র বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় সম্পর্ক, তার তাৎপর্য অপরিসীম। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় গুরুত্বপূর্ণ এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রাষ্ট্রগুলোর সরকারপ্রধানের বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে সফর তার গুরুত্ব অপরিসীম।

কোনো একটি রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের বিদেশ সফর ঐ রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনীতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় যে সম্পর্ক রয়েছে, তা আরও বেশি জোরদার করার লক্ষ্যে ছয় দিনের থাইল্যান্ড সফর শেষে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। গত সোমবার (২৯ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ১১টায় প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমানটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

এর আগে স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ১০ মিনিটে থাইল্যান্ডের ডন মুয়াং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করে বিমানটি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা থাই প্রধানমন্ত্রী গ্রেথা থাভিসিনের আমন্ত্রণে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উভয় সফরে গত ২৪ (বুধবার) এপ্রিল বিকেলে ব্যাঙ্ককে যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমনে ডন মুয়াং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে লালগালিচা উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। সেখানে তাকে জানানো হয় গার্ড অব অনার ও গান স্যালুট।
সদ্য শেষ হওয়া ৬ দিনের থাইল্যান্ড সফরের যে তাৎপর্য তার গভীরতা অনেক বেশি। এই সফরে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে দুই দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে থাইল্যান্ড সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। থাই প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজ বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করেন যে, এ সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রেরণা জোগাবে।

তিনি বলেন, সরকারি এ সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এটি দুদেশের মধ্যে ফলপ্রসূ অংশীদারিত্বের একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। আমাদের জনগণ ও দেশের পারস্পরিক সুবিধার জন্য আগামীতেও সম্পর্কের নবায়নের এ গতিকে আমাদের ধরে রাখতে হবে।
সফর চলাকালীন গত শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাই প্রধানমন্ত্রী থাভিসিনের সঙ্গে গভর্নমেন্ট হাউসে (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেন। যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে পাঁচটি দ্বিপক্ষীয় নথি স্বাক্ষরিত হয়। নথিগুলো হচ্ছে- একটি চুক্তি, তিনটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ), একটি লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই), যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী গ্রেথা থাভিসিনের উপস্থিতিতে স্বাক্ষর হয়।
নথির মধ্যে অফিসিয়াল পাসপোর্ট হোল্ডারদের জন্য ভিসা ছাড়সংক্রান্ত চুক্তি, জ্বালানি সহযোগিতা, শুল্ক বিষয়ে সহযোগিতা ও পারস্পরিক সহায়তা এবং পর্যটন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক এবং ২০২৪ সালের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা সংক্রান্ত লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) রয়েছে।

থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক জাতিসংঘের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কমিশনের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরাইল-ইরান ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার যুদ্ধ বন্ধ করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানাই। কারণ, যুদ্ধের ভয়াবহতা আমরা জানি। বাংলাদেশ কোনো যুদ্ধ চায় না।

আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। উক্ত সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত নিয়ন্ত্রণে আসিয়ানকে ভূমিকা রাখারও আহ্বান জানান জননেত্রী শেখ হাসিনা। দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর ব্যাঙ্ককে এটাই হলো বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধানের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। এ উপলক্ষে গত সপ্তাহে যৌথ বিবৃতি প্রচার করে ঢাকা ও ব্যাঙ্কক।

তাতে বলা হয়, আসন্ন সফরের মধ্য দিয়ে দুই বন্ধু দেশের মধ্যে ‘সহযোগিতার নতুন জানালা’ উন্মোচিত হবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশের জন্য থাইল্যান্ড একটি সম্ভাবনাময় অংশীদার। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সমুদ্রবন্দর কেন্দ্রিক যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক, ভাষাগত এবং অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত। আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ।
শেখ হাসিনা এই সফরে থাই প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং ব্যবসা সহজীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি থাই পক্ষকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাই-টেক পার্কগুলোতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগের এবং বিশেষভাবে একটি এসইজেড সুযোগ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের জন্য থাইল্যান্ড জ্বালানি সহযোগিতায় নিয়োজিত একটি সম্ভাব্য অংশীদার। জ্বালানি সহযোগিতার সম্ভাবনা অনুসন্ধান সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর এখানে স্বাক্ষরিত দ্বিতীয় নথি।

থাই জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং সেরা পর্যটন অনুশীলন থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ পর্যটন ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশী স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনা থাই প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখারও প্রস্তাব দিয়েছেন। 
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গত ২৫ এপ্রিল জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনএসক্যাপ) ৮০তম অধিবেশনে যোগ দেন। এই অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি সব বিশ^নেতাকে যুদ্ধ, আক্রমণ এবং আগ্রাসন বন্ধ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেছেন, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা। 
সবদিক পর্যালোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দেশের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে শেখ হাসিনা ৬ দিনের থাইল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সবসময় চান বাংলাদেশ কখনো সংকটে না পড়ুক। এ দেশের মানুষের শান্তির জন্যই মূলত তিনি বিদেশ সফর করেছেন। অথচ বিএনপি-জামায়াতের মতো স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিগুলো, যারা এই সফরের গুরুত্ব বোঝে না, তারাই এ সম্পর্কে কটাক্ষ করে যাচ্ছে।

শেখ হাসিনা দেশ বিক্রি করতে বিদেশে যাননি, গিয়েছেন দেশের উন্নয়নের উচ্চতা বাড়াতে। অমোঘ এই সত্যটি বাংলাদেশে উন্নয়ন ও অগ্রগতি বিরোধী অপশক্তিগুলো মেনে নিচ্ছে না। তারা প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ এই সফর নিয়ে মনগড়া সমালোচনা করছে, যা কোনোভাবেই বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক  একটি দেশের রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 
শেখ হাসিনার সদ্য থাইল্যান্ড সফর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। এটি আমাদের দুই দেশের মধ্যে ফলপ্রসূ অংশীদারত্বের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যার গুরুত্ব অপরিসীম। জনগণ ও দেশের পারস্পরিক স্বার্থের জন্যে আগামীতেও সম্পর্কের নবায়নের এই গতিকে যেকোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর ঐতিহাসিক এক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

কারণ, ১৯৭২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর, এটিই হয়েছে সরকারপ্রধান স্তরের প্রথম সফর। পাশাপাশি চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এটা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বিদেশ সফর। এই সফর বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার নতুন নতুন অনেক সুযোগ সৃষ্টি করবে।

লেখক : অধ্যাপক, উপাচার্য
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

×