ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

হার্ভার্ড  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ২ মে ২০২৪

হার্ভার্ড  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন

হার্ভার্ড  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জ্ঞানচর্চার এই তিন কেন্দ্রে এই ধরনের সিদ্ধান্ত ও কর্মজ্ঞান আহরণ ও বিচ্ছুরণের প্রতিকূলে পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃতব্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক স্বাধীন সমাজে এ ধরনের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে জ্ঞানের চর্চা ও বিচ্ছুরণের দর্শনকে কালিমাযুক্ত করেছে। হার্ভার্ডের চত্বরে বেশ সংখ্যক শিক্ষক ও ছাত্রের সঙ্গে আলোচনাক্রমে আমার ধারণা হয়েছে যে, হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট ড. গের এরূপ বিরুদ্ধাচরণ তাদেরকে ব্যথিত করেছে। হামাসের নিন্দনীয় আক্রমণের বিপরীতে ইসরাইলের প্রতিশোধমূলক আক্রমণে এখন পর্যন্ত যে ৩৫ হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে তাও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আঁতেল ও শিক্ষক, ছাত্রদের প্রতিবাদে নিন্দিত হয়েছে

বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনক্রমে ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর অর্থনীতিতে শিক্ষার সময় পার্শ^বর্তী জগতবিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। পারস্পরিক স্বীকৃতি ও সহযোগিতার সূত্র অনুযায়ী আমরা কয়েকজন চার্লস নদীর পশ্চিমপাড়ে ম্যাসাচুসেটস প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (এমআইটি) ও হার্ভার্ডের অর্থনীতির প্রথিতযশা অধ্যাপক পল স্যামুয়েলসনের শ্রেণিকক্ষে মাঝে মাঝে পাঠ নিতাম এবং হার্ভার্ডে অর্থনীতিতে অধ্যয়নরত কতিপয় ছাত্রছাত্রী একই নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির জগতখ্যাত অধ্যাপক রোজেনস্টাইন রোডানের উন্নয়ন অর্থ বিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনার মিলন মেলায় অংশগ্রহণ করতেন।

তখন থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় প্রতি গ্রীষ্মে বস্টন ও হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ে ঘুরতে যেতাম এবং জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ও লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সকল উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের সূত্র অনুযায়ী পরিচালনার বিভিন্ন দিক ও ফলপ্রসূতা অনুধাবন করতে সচেষ্ট হতাম। দেশে প্রতিষ্ঠিত উচ্চশিক্ষার সকল প্রতিষ্ঠানে এই অভিজ্ঞান সঞ্চালিত করার লক্ষ্যে সুযোগমতো কাজ করতাম ও কথা বলতাম।

সেই সময়ের স্মৃতি ধারণ করে এই বছরের প্রথমদিকে আবার যখন বস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হার্ভার্ডের চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হলাম তখন স্তম্ভিত হয়ে শুনলাম যে, হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. ক্লডিন গে মাত্র ৭ মাস প্রেসিডেন্টের পদে কর্তব্য সম্পন্ন করার পর ২ জানুয়ারি ২০২৪ এ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।

অধ্যাপিকা গে হার্ভার্ডের প্রথম মহিলা ও কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার জন্ম হয়েছিল হাইতিতে, শিক্ষা প্রাপ্তি ঘটেছে ক্রমান্বয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত প্রিন্সটন, স্টানফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ে। স্টানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অভিসন্দর্ভ লিখে তিনি বিখ্যাত আনা লরা মেয়ার্স পুরস্কার পেয়েছিলেন। আর হার্ভার্ডে ১৯৯৮ সালে উত্তমতম পিএইচডি অভিসন্দর্ভ লেখার জন্য পেয়েছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমনি বিখ্যাত টপপান পুরস্কার।

২০০৬ সালে তিনি হার্ভার্ডে শিক্ষকতায় যোগ দেন, ২০১৫ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞানের ডিন নিযুক্ত হন এবং ২০১৮ সালে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন পদে অভিষিক্ত হন। হার্ভার্ডের এই অনুষদের ডিন বা সামগ্রিক শিক্ষা সারথীর ভূমিকায় তিনি শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে বিরাজমান জাত বৈষম্য দূর করে শ্রেণি বৈচিত্র্য অর্জনে জোরালো ভূমিকা রাখেন। ২০২১ সালে ডিনের ভূমিকায় ড. গে হার্ভার্ডের বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল শিক্ষা ও চর্চার পৃথক ও বিশাল ক্যাম্পাস চালু করেন। 
অধ্যাপিকা গে তার সঙ্গে কর্মরত অন্যান্য শে^তাঙ্গ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসকরা এই শতাব্দীর প্রথম থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত হার্ভার্ডে ছাত্র ভর্তির ক্রমে অনুন্নত, কৃষ্ণাঙ্গ ও বহিরাগত প্রার্থীদের অনুকূলে প্রান্তিক মাত্রায় ইতিবাচক বিবেচনার নীতি অনুসরণ করেছেন। তাদের বিবেচনায় ভর্তির ক্ষেত্রে এরূপ ইতিবাচক মনোভাবে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের সমহারে আনুভৌমিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা স্থাপন ও রক্ষণে সহায়ক।

দুর্ভাগ্যবশত ২০২৩ এর জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট এই ধরনের নীতিকে সামাজিক সমতার নীতিবিরোধী বিবেচনা করে অসাংবিধানিক বলে সিদ্ধান্ত দিলে ড. গে বলেছিলেন যে, সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত অলঙ্ঘনীয়ভাবে সকল ক্ষেত্রে অনুসরণীয় হলেও সামাজিক সমতা স্থাপনে ইতিবাচকভাবে ভর্তির সূত্র অনুসরণ হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয় লালিত মূল্যবোধের অন্যতম উপকরণ হিসেবে অপরিবর্তিত থাকবে। ড. গে ডিনের ভূমিকায় শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের লিঙ্গ কেন্দ্রিক স্বাতন্ত্র্যরক্ষণ, অসাম্প্রদায়িক সূত্র অনুসরণ করে অধ্যাপক নির্বাচন ও অধ্যাপকদের চাকরির স্থায়িত্ব নির্ণয়ক্রমে প্রগতিশীল বিবেচনা প্রয়োগে দৃঢ়তার পরিচয় দেন।

পৃথিবীর সবচেয়ে নামকরা এই বিশ^বিদ্যালয়ে তার উত্তম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দৃঢ় মূল্যবোধ উৎসারিত সংকল্প ও কার্যাবলী শিক্ষা ক্ষেত্রে কর্মরত সকল শিক্ষক ও প্রশাসকের দৃষ্টি ও সমর্থন আকর্ষণ করে। এই প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ১ জুলাই ড. গেকে ৬০০ অধ্যাপক- প্রশাসকদের প্রার্থিতা বিবেচনা করে তাদের মধ্য থেকে হার্ভার্ডের ৩০তম এবং ১ম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়।

তার নিয়োগের বৃত্তান্ত শুনে হার্ভার্ডের চত্বরে এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণালয়ে আমরা জ্ঞানচর্চার মুক্ত ও নির্ভীক পরিসর প্রসারণে হার্ভার্ড ও সমসারির বিশ^বিদ্যালয়ের অনুকূলে আমাদের বিশ্বাস ও সমর্থন বাড়িয়েছি, মুক্ত ও প্রগতিশীল জ্ঞানচর্চার অনুকূলে আমাদের কথা ও কর্মকা- এদেশে ও প্রসারণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি, হার্ভার্ডের ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রশাসনিক নীতি সকল দেশের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুসরণীয় বলে প্রচার করেছি। 
২০২৩ এর ৭ অক্টোবরে প্যালেস্টাইন বা পশ্চিমতীরস্থ ফিলিস্তিনিদের ‘হামাস’ ইসরাইলের ইহুদি অধ্যুষিত এলাকা আক্রমণ করে ১২০০ নিরপরাধ বেসামরিক লোকদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকা-কে পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় নিন্দা করতে বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে হার্ভার্ড এবং শিক্ষক- প্রশাসক হিসেবে এর প্রেসিডেন্ট ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়।

অভিযোগে এও বলা হয়েছে হামাসের অভিযানের পর ইহুদি ছাত্র ও শিক্ষকগণ ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরে নির্বিচারে জনহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত করে এলেও এসব বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রশাসনিক ভূমিকা রাখেনি। একই অভিযোগ ম্যাসাচুসেটস প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (এমআইটি) ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেও উত্থাপিত হয়। গেল ডিসেম্বরে এই ৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

দেশের কতিপয় রক্ষণশীল নেতা তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এই অভিযোগের সমর্থনে বিবৃতি দেন। ফলত প্রতিনিধি পরিষদের ৭০ সদস্য এই তিন বিশ^বিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টদের তাদের বিশ^বিদ্যালয়ের নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করার জন্য দাবি উত্থাপন করেন। এই পটে ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ এ হার্ভার্ডের ২৪৫২ শিক্ষকের মধ্যে ৭০০ জন লিখিত বিবৃতিতে ড. গের পদত্যাগের দাবির বিরোধিতা করেন।

হার্ভার্ড থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত সকল ছাত্রের প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড এলামনি অ্যাসোসিয়েশন ড. গের নেতৃত্বে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা রক্ষণ ও সকল শিক্ষক ও ছাত্রদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও প্রসারণে ড. গের ভূমিকার প্রশংসা করেন। ১২ ডিসেম্বর হার্ভার্ড কর্পোরেশনের পরিষদ এক বাক্যে ড. গের নেতৃত্বকে সমর্থন জানান। স্টানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ে এই পটে তার বিরুদ্ধে তিনি তার পিএইচডি পর্যায়ে দেওয়া গৃহীত অভিসন্দর্ভে নকলের আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠানো হয়।

উল্লেখ্য, ড. গের অভিসন্দর্ভ স্টানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় হতে সংশ্লিষ্ট বছরের উৎকৃষ্ঠতম অভিসন্দর্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়ে প্রখ্যাত আনা লরা মেয়ার্স পুরস্কার পেয়েছিল। এই অভিযোগ অস্বীকার করে ড. গে বলেন যে ঘৃণার বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম এবং পা-িত্যের নিরপেক্ষ দৃঢ়তা রক্ষাকরণে তার সংকল্পের প্রতিকূলে অবিশ^াস এবং তার বিরুদ্ধে জাতিগত বিবেচনায় ব্যক্তিগত আক্রমণ ও ভীতি প্রদর্শন তাকে মর্মাহত করেছে।

এই প্রেক্ষিতে ২০২৩ এর ২ জানুয়ারি তিনি হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে সংশ্লিষ্ট বিশ^বিদ্যালয়ে ইহুদিবাদের অসমর্থনের অভিযোগ উত্থাপনের কারণে এম আই টি ও পেনসিলভানিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টদ্বয়ও তাদের স্ব স্ব পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

এমআইটি ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টদ্বয়ের সঙ্গে হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ নিরপেক্ষ ও একনিষ্ঠ জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি বিরাট আঘাত বলে বিজ্ঞ মহলে বিবেচিত হয়েছে। মুক্ত জ্ঞানচর্চার অধিক্ষেত্র হিসেবে আমরা সবসময় হার্ভার্ড, এমআইটি, পেনসিলভানিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের নীতি, ব্যবস্থা ও নিশ্চয়তাকে সকল উচ্চশিক্ষার পরিচালনে অনুসরণীয় বলে সমর্থন জ্ঞাপন করে এসেছি। তেলআবিবে হামাসের আক্রমণ ও নিরপরাধ জনহত্যা এই তিন শিক্ষক প্রশাসক কোনো দিনই সমর্থন করেননি।

যারা এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন কিংবা যেসব ইহুদি ছাত্র ও শিক্ষকগোষ্ঠী বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফিলিস্তিনিদের বিরোধিতা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিরূপ মনোভাব বা আচরণ এ তিন বিজ্ঞ শিক্ষা প্রশাসকের আচরণ বা কথায় কোনোভাবেই প্রতিফলিত হয়নি। তেমনি এই আক্রমণের পর প্রতিশোধমূলক যেসব পদক্ষেপ ইসরাইলের তরফ থেকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে প্রায় ৩৫০০০ নিরপরাধ বেসামরিক জনগণের জীবন নাশ করা হয়েছে। তারও কোনো রকম বিরোধিতা বা প্রতিবাদ করেননি। এই প্রেক্ষাপটে বিশ^বিদ্যালয়ের নেতৃত্ব থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়া জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় স্বাধীন চেতনাভিত্তিক জ্ঞানের প্রবৃদ্ধির বিরোধী পদক্ষেপ বলে বিবেচ্য।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জ্ঞানচর্চার এই তিন কেন্দ্রে এই ধরনের সিদ্ধান্ত ও কর্মজ্ঞান আহরণ ও বিচ্ছুরণের প্রতিকূলে পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃতব্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক স্বাধীন সমাজে এ ধরনের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে জ্ঞানের চর্চা ও বিচ্ছুরণের দর্শনকে কালিমাযুক্ত করেছে। হার্ভার্ডের চত্বরে বেশ সংখ্যক শিক্ষক ও ছাত্রের সঙ্গে আলোচনাক্রমে আমার ধারণা হয়েছে যে হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট ড. গের এরূপ বিরুদ্ধাচরণ তাদেরকে ব্যথিত করেছে।

হামাসের নিন্দনীয় আক্রমণের বিপরীতে ইসরাইলের প্রতিশোধমূলক আক্রমণে এখন পর্যন্ত যে ৩৫ হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে তাও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আঁতেল ও শিক্ষক, ছাত্রদের প্রতিবাদে নিন্দিত হয়েছে (দ্রষ্টব্য : হামাস ফ্রিডম্যান, ইসরাইল, যুদ্ধবিরতি, বন্দি মুক্তি, গাজা ত্যাগ ও সবকিছুর চিন্তা, নিউইয়র্ক টাইমস, এপ্রিল ১০, ২০২৪ইং)।

চার্লস নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে তার তীরে অবস্থিত কেনেডি সরকার বিদ্যাপীঠে কিংবা তার সংলাপ আঁতেলদের কাছে  হেনরিয়েটার টেবিলে বিজ্ঞজন, ছাত্র ও প্রশিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে আমার প্রতীতি জন্মেছে যে মুক্ত জ্ঞানচর্চার প্রবাহে রাজনৈতিক সমর্থন-অসমর্থন কিংবা পক্ষপাতিত্ব অবাধ জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার প্রতিবন্ধক। মুক্ত বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞানচর্চার প্রতিকূলে বিশ^বিদ্যালয়ের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এই ধরনের পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সর্বত্র সমালোচনার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে।

আমাদের দেশেরও কতিপয় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রের সঙ্গে এই ঘটনা আমি আলোচনা করেছি। তাদের সবাইর সঙ্গে আমাদের মিলিত আশা, এই ধরনের পদক্ষেপ ভবিষ্যতে জ্ঞানচর্চার প্রবাহকে সীমিত, বিঘিœত ও কালিমাযুক্ত করবে না। আমাদের দেশে কোনো বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসন যাতে এরূপ সাম্প্রদায়িক কিংবা অগণতান্ত্রিক আচরণের শিকার না হয় কিংবা আমরা সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে আশ্রয় করে যেন কোনো বিশ^বিদ্যালয় পরিচালিত না করি তার জন্য আমাদের অধিকতর সচেতন থাকতে হবে।

হার্ভার্ডের প্রথম নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টকে মুক্ত জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দেওয়া যেন কোনো দেশের উচ্চতর জ্ঞানচর্চার নিলয়কে বাধাগ্রস্ত না করতে পারে সেজন্য পৃথিবীব্যাপী সর্বত্র আমাদের সচেতন থাকতে হবে এবং মুক্ত জ্ঞানচর্চাভিত্তিক অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিবাদ যে প্রক্রিয়া অনুসরণ ও মূল্যবোধে বলীয়ান হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭০ এর ৪ মে, লন্ডনে ১৯১০ সালের ১৮ নভেম্বর, বেজিং এর তিয়েনআনমেন চত্বরে ১৯৮৯ সালের ৩ জুনে এবং আমাদের ঢাকায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ধ্বনিত হয়েছে তার উত্তরাধিকার নিয়ে মানবতার জয়ধ্বনিত ও বিকশিত করার জন্য ও লক্ষ্যে হার্ভার্ডের নেতৃত্বে যে ব্যত্যয় ও স্খলন আমরা ২০২৩ এর ডিসেম্বরে প্রত্যক্ষ করেছি তা আমাদের বর্জন করার জ্ঞানসমৃদ্ধ শপথ নিতে হবে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রী

×