ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পাটকল শ্রমিকদের সুখ-দুঃখ

প্রবীর বিশ্বাস

প্রকাশিত: ০১:১১, ৩ মে ২০২৪

পাটকল শ্রমিকদের সুখ-দুঃখ

পাটকলে কর্মরত ৬৫ বছর বয়সী আনোয়ারা বেগম

আনোয়ারা বেগম, বয়স ৬৫। বসবাস খুলনা নগরীর খালিশপুরে বিআইডিসি রোড। গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। ১৪ বছর আগে স্বামী মারা যান স্ট্রোক করে। ছোট দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় জীবন-সংগ্রাম। শ্রমিকের কাজ পান পিপুলস জুট মিলে। সাপ্তাহিক আয় ছিল এক হাজার ছয়শ টাকা। টানাটানির মধ্যেও কোনোমতে চলছিল সংসার। বিয়ে দিয়েছেন ছেলে ও মেয়েকে।

কিন্তু প্রায় চার বছর আগে মিল বন্ধ হওয়ায় আবার নতুন করে জেঁকে বসে আর্থিক অসচ্ছলতা। তবে গত ছয় মাস আগে বেসরকারিভাবে দৌলতপুর জুট মিল চালু হলে সাড়ে ছয় হাজার টাকা বেতনের কাজ পান ফিনিশিং বিভাগে। দিনে আট ঘণ্টা ডিউটি করে বাসার কাজ সেরে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটে তার। বলেন, ভালোই আছি বাবা। ছেলে রিক্সা চালায় আর আমি যা পাই তা দিয়ে সংসার চলে যাচ্ছে।
৫৭ বছর বয়সী আরেক শ্রমিক শেখ ফরিদ। খুলনাতে বাবার কর্মসুবাদে শিশুকালেই ভোলা সদর উপজেলা থেকে এসে বসতি করেছেন। ১৮ বছর বয়স থেকে কাজ নেন ক্রিসেন্ট জুট মিলে। সেই হিসাবে ৪০ বছর পার করেছেন সোনালি আঁশ পাট, সুতা আর মেশিনের সঙ্গে। সাপ্তাহিক ৫২৪ টাকা বেতন থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত বেতনে কাজ করেছেন।

মিল বন্ধ থাকায় সাড়ে তিন বছর নানা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু পাটকলের মেশিনের চিরচেনা শব্দ তাকে আবার ডেকে নেয়। বেসরকারিভাবে চালু হওয়া দৌলতপুর পাটকলে আবার কর্ম খুঁজে পান তিনি। সময়মতো বেতন পাই, মালিক ও ম্যানেজার সবসময় খোঁজ-খবর নেন। মিল আবার চালু হওয়াতে আমরা ভীষণ খুশি বলে জানান তিনি। 
একইভাবে আনন্দ প্রকাশ করেন একই মিলের রোল ও ভিম বিভাগে কাজ পাওয়া ফোরকান আলী। এর আগে সরকারিভাবে চালু থাকা এই মিলেরই শ্রমিক ছিলেন আট বছর। তারও আগে পিপুলস জুট মিলে কাজ করেছেন প্রায় ১১ বছর। তার মতোই পুরনায় পাটকলে কাজ পেয়েছেন মো. আলাউদ্দিন, শিমু বেগম, মিন্টু হাওলাদার ও মাহাফুজা আক্তাররা। যারা মিলের সপনার, ব্রেকার, ড্রইং, স্পিনিং, রোল, কফ, ভিম, দুস্টার ও ফিনিশিং বিভাগসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মরত। বলেন আপাতত ছোট পরিসরে হলেও দুইশ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে এখানে। 
তবে দুঃখ হাসমত আলীর। তিনি শ্রমিক ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল প্লাটিনামের। বলেন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাহিদামতো কাঁচা পাট সরবরাহ না করার কারণে মিলটিও বন্ধ হয়ে যায়। শেষ বয়সে এসে নতুন করে আর কিছু করা হয়নি। ২০২০ সালের ১ জুলাই সরকার একযোগে দেশের ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করেছিল। এর মধ্যে খুলনা অঞ্চলের ৯টি।

পাটকলগুলো হলো ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, স্টার, আলীম, ইস্টার্ন, যশোরের কার্পেটিং ও জেজেআই। যেখানে স্থায়ী শ্রমিক ছিল প্রায় ১৫ হাজার। আর অস্থায়ী শ্রমিক ছিল প্রায় দ্বিগুণ। তবে সরকার সেদিন গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়েছিলেন। এরও আগে দেশে ৩২টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মধ্যে বাকি ছয়টি পাটকল বন্ধ করেছিল সরকার।
প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলের লিটন শেখ জানান, গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে তিনি প্রায় ১৫ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকার এক অংশ দিয়ে গ্রামে ধানের জমি কিনেছেন। এক অংশ খরচ করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আর এক অংশ ব্যাংকে জমা আছে। যেখান থেকে প্রতি মাসে পান লভ্যাংশ। ছেলে ইজিবাইক চালায়। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে খালিশপুরে বসবাস করেন।

নাতি-নাতনির মায়ায় কখনো তিনি তাদের কাছে থাকেন আবার কখনো গোপালগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে চলে যান। বেশ ভালোই আছেন তিনি। তার মতো অনেকেই নগদ অর্থ পেয়ে জমি কিনেছেন, কেউ ঘর করেছেন, কেউ দিয়েছেন দোকান। আবার কেউ কেউ ইজিবাইক কিংবা ভ্যান কিনে নিজেই চালাচ্ছেন। বেশি বয়সী শ্রমিকদের সন্তানেরাও অনেকে ইতোমধ্যে সংসারের হাল ধরেছেন। 
তবে পয়সার উল্টো পিঠের গল্পটাও ভীষণ তেতো। অনেক শ্রমিক এখনো সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ পাননি। মিল বন্ধের সময় বেতনসহ সমুদয় পাওনাদি বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় করার ঘোষণা থাকলেও কেউ কেউ এখনো সেগুলো থেকে বঞ্চিত। অনেক অর্থ ঢেলেও কাজ হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মিলের শ্রমিক নেতা ও বিজেএমসির কর্মকর্তাদের ওপর তাদের অভিযোগের অন্ত নেই।

ঘামের মূল্য পাওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন, বিজেএমসি, পাট মন্ত্রণালয়ে দেন-দরবার করেছি। করতে করতে এখন অনেকেই ক্লান্ত। পাওয়া কিংবা না পাওয়া পুরো ব্যাপারটাই ছেড়ে দিয়েছি আল্লাহর হাতে। চোখের পানি ঝরিয়ে এমন আবেগমিশ্রিত কথাগুলো বলছিলেন স্টার জুট মিলের তাবারক হোসেন। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন মিলে অস্থায়ী শ্রমিকরা। এমন একজন প্লাটিনামের সাবেক শ্রমিক জহির মোল্লা বলেন, গত প্রায় চার বছর মিল বন্ধ।

বন্ধের এক মাসের মাথায় মিল কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মিলের আবাসিক থেকে নোটিস দিয়ে নামিয়ে দেয়। স্কুল-কলেজ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মিলের পাশে দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া করে আছি। মাস গেলেই বাসা ভাড়া বাবদ ছয় হাজার টাকা গুনতে হয়। তা ছাড়া আনুষঙ্গিক বিদ্যুৎ বিল, খাদ্য খাবার, বাজার সদয় মিলে প্রতি মাসেই ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচের কোনো মাপ নাই। গচ্ছিত যৎসামান্য এখন শেষ। আমাদের আর কোনো অবলম্বন নাই। মিল চালু হলে হয়তো আবার কাজ করার সুযোগ তৈরি হতো।
ক্রিসেন্টের আরেক শ্রমিক শামীম হোসেন বলেন, অনেকে অঞ্চল ত্যাগ করে গ্রামে কিংবা অন্য কোথাও চলে গেছেন। প্রতিদিন মিলের গেটে আছি। পুরনো দুই-চারজনের সঙ্গে দেখা হয়। ২০/২৫ বছর কাজ করেছি; একটা মায়া হয়ে গেছে। তাই কষ্ট হলেও কোথাও যেতে পারি না। টুকটাক কাজকর্ম করে দিন চালাচ্ছি। কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছি। নিত্যপণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাওয়া অনেকেরই এখন আয়ের উৎস শুধুমাত্র দিনমজুরী।
জোবাইদা বেগম নামের এক শ্রমিক বলেন, সরকার দুই মাসের ভেতরে সকল শ্রমিকের সকল পাওনা টাকা পরিশোধ ও তিন মাসের মধ্যে বন্ধ সকল মিলের উৎপাদন চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ৪৬ মাস হয়ে গেলেও স্থায়ী শ্রমিকের সঞ্চয়পত্র, গ্রাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও অন্যান্য পাওনা পরিশোধ হয়নি। অথচ শ্রমিকরা বেকার হলেও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।

দৌলতপুর জুট মিলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ইসহাক আলী জানান, আপাতত স্বল্প পরিসরে চলু করেছি। প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার বস্তা উৎপাদন করছি। বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ৩০ বছরের জন্য প্রতি মাসে ৯ লাখ টাকায় সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছি। যা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ১০ শতাংশ করে বর্ধিত হবে। আগামী ডিসেম্বর থেকে বড় পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। তখন দুই হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছি। তিনি আরও জানান, আমরা কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কাঁচা পাট খরিদ করি যাতে করে মধ্যস্বত্ব ভোগীরা সুবিধা না পায়।

বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) খুলনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে থাকা ২০২০ সালের ১ জুলাই খুলনাঞ্চলের নয়টি মিল বন্ধ করে দেয় সরকার। এরপর শুরু হয় বেসরকারিভাবে পাটকলগুলো পুনরায় চালু করার উদ্যোগ। গত ছয় মাস আগে দৌলতপুর জুট মিলস ইজারা নিয়ে চালু করে ফরচুন গ্রুপের ইউনিওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যার টেকনোলজি লিমিটেড। দ্রুত সময়ের মধ্যে উৎপাদনে যাবে রেডিয়েন্ট ফার্মার ইজারা নেওয়া খালিশপুর জুট মিলস।

এ ছাড়া ইস্টার্ন ও কার্পেটিং চালু করেছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মোহন গ্রুপ এবং আকিজ গ্রুপ চালু করেছে জেজেআই। বাকি স্টার, আলিম, প্লাটিনাম ও ক্রিসেন্ট যত দ্রুত সময়ের মধ্যে চালু করা যায় সে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শ্রমিকের পাওনা নিয়ে তিনি জানান, প্রায় সকল শ্রমিক তাদের পাওনা বুঝে পেয়েছেন। কাগজপত্রসহ অন্যান্য সমস্যার কারণে কিছু শ্রমিকের পাওনা বাকি আছে। সেগুলোও ঠিক হয়ে যাবে।
বিজেএমসি আরও জানায়, গত শতকের ৫০-এর দশকে খুলনা মহানগরীর ভৈরব নদের তীরে প্রথম জুট মিল স্থাপিত হয়। লাভজনক হওয়ায় এরপর একের পর এক গড়ে ওঠে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল। মূলত সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাব, সময়মতো কাঁচামাল কিনতে না পারা, উৎপাদনের কাজে অদক্ষ শ্রমিকের ব্যবহার ও শ্রমিক অসন্তোষ এবং দীর্ঘ প্রায় ৭০ বছরের পুরনো মেশিনারিজ ব্যবহারের কারণে জুট মিলগুলোতে কাক্সিক্ষত উৎপাদন না হওয়ায় মিলগুলো বন্ধ করে দেয় সরকার।
    প্রবীর বিশ্বাস, খুলনা অফিস

×