ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দাবদাহে বিপন্ন নারীসমাজ

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:২২, ৩ মে ২০২৪

দাবদাহে বিপন্ন নারীসমাজ

দাবদাহে বিপন্ন নারীসমাজ

একজন কন্যাশিশু তার শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্তের সময় ভেতরের বোধে যে মমত্ব মাখানো অনুভবকে লালন-ধারণ করে সেখানেই অন্তর্নিহিত এক শক্তিময়তায় মাতৃত্বের যে শৌর্য আলো ছড়ায় তাই যে কোনো নারীকে সফলতা, সম্মান আর গৌরবের শীর্ষ শিখরে নিয়ে যায়। যেখানে শ্রম শক্তির পরম কর্মসাধনা অনন্য এক উচ্চাসনে অভিষিক্ত করা অনিবার্য তো বটেই। সব নারীর জন্য

সারাদেশে প্রবাহিত হচ্ছে দাবদাহের তীব্রতা। সব মানুষই প্রখর রৌদ্রতাপের অসহনীয় দাপটে বিপন্ন। বারবার হিট অ্যালার্ট জারি করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এবার বৈশাখের খরতাপ চৈত্রের মধ্যভাগ থেকে শুরু হওয়া এক প্রচ- দাবদাহ। স্কুলগামী শিক্ষার্থী থেকে গৃহিণী ও কর্মজীবী নারীরা রয়েছে চরম অস্বস্তিতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এতদিন বন্ধ থাকলেও তা সময়মতো খুলে দিলেও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবারো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দেশের পাঁচ জেলায়। ছুটি বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

তার মধ্যে নতুন করে শনিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকাও শিক্ষার্থীদের গরমে নাভিশ্বাস হওয়ার আশঙ্কিত বিষয়। শ্রমজীবী নারীদের অসহনীয় রৌদ্রের দাপট সহ্য করে তার কর্মসংস্থানে যোগ দেওয়াও তাপপ্রবাহকে আলিঙ্গন করা। উপায়ই নেই। জীবন যতই অসহিষ্ণু আর বিপন্ন হোক না কেন সবার আগে মানুষকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে হয়।

সেখানে কাঠফাটা রোদ কিংবা বর্ষণমুখর দিনযাপন নতুবা তীব্র শীতের অসহনীয় কম্পনকে অবজ্ঞা, উপেক্ষায় কর্মস্থলে হাজিরা দেওয়া থেকে শুরু করে রান্নাবান্নার আয়োজন- সবই সারতে হয় বিরামহীন গতিতে। আর সব জায়গায় মধ্যমণির মতো অবস্থান করে সমসংখ্যক নারী। কোথায় নেই তারা এই মাত্রাতিরিক্ত গরমে? উদয়াস্ত শ্রমে পরিবার থেকে সমাজ সংস্কারের দায়িত্ব পালনে গৃহিণী কর্মজীবী নারীদের যে পরিমাণ ব্যস্ত থাকতে হয় তা আড়ালে আবডালে আর নেই।

সারাদিনের রান্নার আয়োজনে তীব্র তাপপ্রবাহেও গরম চুল্লির অগ্নিশিখায় পরিবারের সকলের আহারের সংস্থান করতে হয় গৃহিণীকে। হ্যাঁ, গৃহিণীর একজন সাহায্যকারী থাকে। সেও কিন্তু কিশোরী কোনো বালিকা। আবার ঠিকা বুয়ারা যারা ঘণ্টার বিনিময়ে কাজ করে পারিশ্রমিক নেয় তারাও যুবতী কিংবা বয়স্ক কোনো নারী। সংসার ধর্মের চাকা সচল রাখতে নারী শ্রমের আসলেই কোনো বিকল্প নেই। আর অন্যদিকে শ্রমজীবী কল-কারখানার নারীদের অবস্থাও হিসাবের মধ্যে আনা বাঞ্ছনীয়।

তার ওপর বাংলাদেশে এই মুহূর্তে চলছে উন্নয়ন যজ্ঞের মহাপ্রকল্প। সেখানে অবকাঠামো বিনির্মাণের বহুতল ভবন থেকে সড়ক-মহাসড়ক তৈরির কর্মপ্রবাহ নারীদের মূল্যবান শ্রম বিনিয়োগে এগিয়ে যাচ্ছে বলাই যায়। রৌদ্রতাপের অসহনীয় জ্বালা সহ্য করে তারা যে মাত্রায় নিজেদের কর্মযোগকে শাণিত করে সেখানেও যে কত বিসদৃশ্য, বৈষম্য নগ্নভাবে উঠে আসে তা ধারণা করাই যায় না। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে উঠে আসছে শ্রম সময়, ধরন এবং শ্রমের কোনো ফারাক না থাকা সত্ত্বেও নারী মজুরি শ্রমিক তার পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় বেতন পায় নাকি কমই।

পুরুষ সহকর্মী যদি দিনমজুরিতে ৫০০ টাকা পায় সেখানে নারী পাচ্ছে ৩৫০ টাকা। বহুবার এমন দৃষ্টিকটু ব্যবধান নিয়ে সাড়া জাগলেও আজ অবধি তার কোনো সুরাহা পাওয়া যায়নি। তার ওপর নারী শ্রমিককে তার সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করে কর্মস্থলে হাজিরা দিতে হয়। কিন্তু পুরুষ সহকর্মী ঘুম থেকে উঠেই তৈরি করা সকালের নাশতা খেয়ে তার কর্মস্থলে আসেন। বিভাজন যে কত জায়গায় তার সীমা-পরিসীমা থাকেই না। শুধু কি তা-ই? পরিবারের শিশুও বৃদ্ধদের যতœআত্তির সবই তো গৃহিণী ও নারী শ্রমিকেই পালন করা যুগ-যুগান্তরের সমাজ সংস্কারের অলঙ্ঘনীয় বিধি। 
যা আধুনিককালের যাত্রাপথকে মান্ধাতা আমলের অপসংস্কারে ঢেকে রেখেছে। আবার এই নারীই কোনো এক সময় সন্তান সম্ভবা হয়। জঠরে লালন-ধারণ করতে হয় আধুনিক প্রজন্মকে। সুস্থ স্বাভাবিকভাবে শিশুটিকে পৃথিবীর আলো দেখানো মাতৃত্বের অপার মহিমা। তেমন অসাধ্য সাধন করার যে অভাবনীয় শক্তি নারীর শরীরে জিইয়ে থাকে তার দাম কোনো কিছুর বিনিময়ে হয়ই না। ধারণা করা হয় দশ মাস দশ দিন গর্ভে রাখার দামও নাকি সন্তানরাই সারা জীবন শোধ করতেই অপরাগ। এমন শক্তি সৌন্দর্যে নারীর মহিমান্বিত কর্মযোগ সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই আজ অবধি ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বিভিন্ন পত্রিকায় দশ্যমান হয়েছে দাবদাহে প্রসূতি এবং গর্ভজাত সন্তান চরম অস্বস্তিতে দুঃসময় পার করছেন। গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কা থেকেও মুক্ত নয়। বিভিন্ন হাসপাতালে সরাসরি তদারকি আর জরিপের মধ্য দিয়ে এমন উপাত্ত সবাইকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেওয়ার মতোই। গর্ভজাত শিশুটিও তার সচরাচর নিরাপদ আশ্রয় মায়ের জঠরে স্বস্তিতে নেই। সুতরাং পরিবেশ পরিস্থিতি যেমন অগ্নিদাহ পাশাপাশি সমসংখ্যক নারীরাও চরম বিপাকে। আর শিশুদের হরেক রোগ বালাই, ডায়রিয়া, ঋতুজনিত ঠান্ডা লাগা আবার গরমে ঘাম বসে জ্বরের আশঙ্কা সব মিলিয়ে মায়েদেরই যেন চরম অসময়।

শিশু পরিচর্যায়ও জন্মদাত্রীর বিকল্প অন্য কিছু নয়। আবার পরিবারের বয়োবৃদ্ধ মানুষের যতœআত্তির গৃহিণী কিংবা কর্মজীবী নারীর ওপরই বর্তায়। এটাই সমাজ সংস্কারের অলিখিত নিয়ম। অগ্নিস্নাত প্রখরতায় চুলার আগুনের আঁচ সহ্য করে নারীদের যে খাবার তৈরির কাজে নেমে পড়তে হয় সেটাও যে কতখানি অবদান পরিবার সংসারের জন্য তা বলাই বাহল্য। তার পরেও নারী শ্রমের অবমূল্যায়ন আজ অবধি এক অলিখিত বিধিই বলা যায়।

বিশেষ করে সূর্যের আলো বিচ্ছুরণ হওয়া থেকে  যে পারিবারিক কর্মযোগে নারীদের সারাদিন পার হয়ে যায় সেটার মূল্যমান নির্ধারণেরও অতীত। মাপাই যাবে না কোনো কিছুর বিনিময়ে। অর্থ দিয়ে তো নয়ই। তবে অফিস-আদালতে কর্মজীবী নারীরা অনেকটা সহনীয় এবং নিরাপদে তাদের দাপ্তরিক কাজ সামলাতে পারেন। সেখানে বেতন বৈষম্য এবং ভিন্ন মাত্রার কোনো পার্থক্য দৃশ্যমান থাকে না। 
পারিবারিক আবহে নারী শ্রমের মূল্যায়ন নিয়ে কথা উঠেছে বিভিন্ন সময়। কিন্তু শেষ অবধি কোনো কিছু হতে না পারাও পরিস্থিতির বিরূপ দুরবস্থা। মূলত আলোচনা করছিলাম খরতাপের চরম দুঃসময়ে নারীদের ঘরের কাজ এবং বাইরের পেশা সামলানো কত ঝক্কি ঝামেলার বিষয় তা নিয়ে। অনেক কিছুর মূল্যমান আসলেই হয় না। স্পর্শকাতর স্বাভাবিক মনোবৃত্তি বিবেচনায় রেখে সহৃদয় সহযোগিতাই সবচেয়ে বড় উপহার। সমাজ-সভ্যতার চিরায়ত নিয়ম অনুযায়ী নারীর কর্মসাধনা নিত্যনৈমিত্তিক এক অনন্য কাজের জগৎ। সেটা পারিবারিক কিংবা দাপ্তরিক যেখানেই হোক না কেন।

কিন্তু মাতৃজঠরে আগত সন্তানকে নিরাপত্তার বেষ্টনীতে ঘিরে পৃথিবীর আলো দেখানোর বিষয়টা কিন্তু অত সহজসাধ্য নয়। মূল্যায়ন কিংবা মূল্যমান নির্ধারণ ততোধিক কঠিন। একজন কন্যাশিশু তার শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্তের সময় ভেতরের বোধে যে মমত্ব মাখানো অনুভবকে লালন-ধারণ করে সেখানেই অন্তর্নিহিত এক শক্তিময়তায় মাতৃত্বের যে শৌর্য আলো ছড়ায় তাই যে কোনো নারীকে সফলতা, সম্মান আর গৌরবের শীর্ষ শিখরে নিয়ে যায়। যেখানে শ্রম শক্তির পরম কর্মসাধনা অনন্য এক উচ্চাসনে অভিষিক্ত করা অনিবার্য তো বটেই। সব নারীর জন্য।

×