ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

জাতীয় বাজেটে কর-রাজস্ব আদায়

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২১:০১, ২ মে ২০২৪

জাতীয় বাজেটে কর-রাজস্ব আদায়

আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট

আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট বা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি-দর্শন পেশ করবেন প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রী হওয়া আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বলা হচ্ছে, দেশের সব নাগরিক যাতে আসছে বাজেট থেকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সুবিধা পান, বাজেট যাতে জনবান্ধব হয় এবং মূল্যস্ফীতি যাতে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা যায়, সে জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। যারা এ কথা বলছেন তাদের কাছে সবিনয় প্রশ্ন, গত বেশ কয়েকটি বাজেটে সরকারি নীতিনির্ধারকেরা প্রকাশ্যেই বলেছেন, বাজেট হবে জনবান্ধব।

আর অর্থমন্ত্রী বড় ব্যবসায়ীদের কথা মেনে জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন ব্যবসায়ীবান্ধব বাজেট। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা, ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বরতা, প্রতিবেশী মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ, বৈশি^ক অর্থনীতির অস্থিরতার অভিঘাত সামলে অর্থনীতিকে সচল করতে বাজেটে ব্যবসা-বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে বিগত বেশ কয়েকটি বাজেটে যেভাবে ব্যবসায়ী ও ধনীক শ্রেণিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তাতে অর্থনীতির সমস্যা আরও গভীর হয়েছে।

ফলে সরকারকে এখন অনেকটা বাধ্য হয়েই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আরও বেশি হারে অর্থ সংগ্রহে অর্থাৎ কর-রাজস্ব আদায়ে নামতে হচ্ছে। বাংলাদেশের কর-রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা যেহেতেু পরোক্ষ করনির্ভর, সেহেতু বোঝাই যাচ্ছে, এবারও বাজেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ওপর সবচেয়ে ‘অন্যায় কর’ অর্থাৎ ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) এবং সম্পূরক শুল্কের মতো পরোক্ষ করের বোঝা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে যাচ্ছে।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ২০০৫ সালে প্রণীত ট্যাক্স আইন পুরোটাই পরোক্ষ করনির্ভর। তাই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরোক্ষ কর বাড়িয়ে দেওয়া জনগণের সঙ্গে আসলে প্রতারণা করা । কারণ, বাংলাদেশে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ করের অনুপাত ৭০:৩০। এর মধ্যে আবার ৩৫ শতাংশই আসে ভ্যাট থেকে, যার চাপ সবচেয়ে বেশি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। 
অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান শাস্ত্রের পরিম-লে কাজ করার সূত্রে দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি, প্রতিবছর বাজেট পেশের সময় হলেই একদিকে নানা কথাবার্তা শুরু হয়। এ সময় যারা অর্থনীতির ‘অ’-ও বোঝেন না, বিশেষভাবে ব্যবসায়ী-আমলানির্ভর-মুফতে রাজনীতিবিদ ব্যবস্থার স্বংখ্যাস্বল্প লোকজন (মোট জনসংখ্যার বড়জোর ২০ শতাংশ) বেশি বেশি গুরুগম্ভীর বক্তব্য দেন এবং নিজের বিচরণ করা অঙ্গনের জন্য সুকৌশলে নানা বুদ্ধি-পরামর্শ (আসলে নিজের স্বার্থ) দেন।

রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থায় তাদের অবস্থান ও প্রভাব বেশি হলে বাজেট দলিলে বুদ্ধি-পরামর্শ সন্নিবেশিত হয়। অর্থাৎ তারা নানা সুযোগ-সুবিধা পান। অন্যদিকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ (৮০ শতাংশ) মানুষ এ সময় সামনের দিনগুলোয় পরিবারের বাজেট কিভাবে সামলাবেন, তা নিয়ে মানসিক দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তাদের কাছে বাজেট মানেই জিনিসপত্রের দাম, জীবনযাত্রার ব্যয় ও কষ্ট-দুর্ভোগ আরও বেড়ে যাওয়া।

সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অংশের মানুষ রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ব্যবস্থার অনেক কিছু না বুঝলেও এখন এটুকু অন্তত বোঝেন, স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ ৫৩ বছর পরেও বঞ্চনা-বৈষম্যের অনেক কিছুই এখনো বাংলাদেশে বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে এবং তা ক্রমাগত হারে বাড়ছে। 
উপরোক্ত কথাবার্তায় অনেকের মনে হতে পারে, সরকার বুঝি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্য কিছুই করে না। আসলে তা নয়।

পুঁজিতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার চাপে পড়ে সরকার আসলে বাজেট পেশের পরে নিশ্চিত করতে চায়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন দর্শনে ঘোষিত কথাবার্তার চুঁইয়ে পড়া অংশের ভাগ যাতে জনগণ কিছুটা হলেও পায়। অর্থনৈতিক দর্শনের এই অবস্থা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ধনী-গরিব প্রায় সব দেশেই চলছে। অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হলেও এ কথাই সত্যি, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ১০ জনের মাত্র দুজন দেশটির সরকারকে বিশ্বাস করে।

২০২৩ সালে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ‘জেনোসাইড জো’ নামে অভিহিত হওয়া প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির ২৫ শতাংশ অন্ধভক্ত বলছে, সরকারের প্রতি তাদের আস্থা আছে। অর্থাৎ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা ৭৫ শতাংশ ডেমোক্রেট সমর্থকই তাদের সরকারকে বিশ্বাস করে না। ধনাঢ্য এই দেশটির সরকারি সংস্থা ডিপার্টমেন্ট অব হাউজিং অ্যান্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬,৫৩,১০৪ আমেরিকান গৃহহীন হয়ে রাস্তায়-পার্কে জীবন কাটাচ্ছেন, যা ২০২২ সালের চেয়ে ১২.১ শতাংশ বেশি।

সরকারি হিসাবে ২০২৩ সালে দেশটিতে দারিদ্র্যের হার ছিল ১১.৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৯ লাখ আমেরিকান দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্রে কর-জিডিপি অনুপাত ২৭.৭ শতাংশ। অবস্থাভেদে সাধারণ পরোক্ষ করের পরিমাণ ০-১৩ শতাংশ। সাতটি আয়কর বন্ধনীতে হার যথাক্রমে ১০ শতাংশ, ১২, ২২, ২৪, ৩২, ৩৫ এবং ৩৭ শতাংশ।

অধিকাংশ আমেরিকান ধনী তোষণকারী কর ব্যবস্থায় নাখোশ থাকলেও দেশটির রাজস্ব বিভাগের ২০২৪ সালের ২ জানুয়ারি-৩ ফেব্রুয়ারি পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে,  ৪১.৯ শতাংশ করদাতা বলেছেন, তারা রাজস্ব বিভাগের কর সেবায় অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছেন, আর ৪৭.৩ শতাংশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ২০২২ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ৩৭.৪ এবং ৫১.২ শতাংশ। 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র্য ও কর-রাজস্বসংক্রান্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানুষের বদ্ধমূল ধারণা, কর ব্যবস্থার অবকাঠামো খাতের খাতা-কলম-পেন্সিল আর ইট-কাঠ-পাথরগুলোও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ অর্জনের জন্য বসে থাকে। এ অবস্থার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ উন্নয়নে নির্মোহভাবে কাজ করে যাওয়া ব্যক্তিবর্গ বলতে পারছেন, ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের ৮৭ শতাংশ কোনো ধরনের আয়কর দেন না।

এই মানুষদের কাছ থেকে কর আদায় করা গেলে বাংলাদেশের কোনো রাজস্ব ঘাটতিই থাকত না। বিদেশী সংস্থা ও সরকারের কাছ থেকে নানা রকম শর্ত-সুদে ঋণের জন্য আবেদন-নিবেদন করতে হতো না। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে মাত্র ১৮ লাখ মানুষ কর দেন, যাদের ১০ লাখই সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিত আছেন। ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে আয়কর দেন বড়জোড় ৮ লাখ। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের সংখ্যা কমপক্ষে ৭৮ লাখ ৩২ হাজার।

ধনীদের ছাড় দিয়ে আয়কর ব্যবস্থার এই দুর্বলতা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর থেকে। এরপর থেকে দীর্ঘ কয়েক যুগ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নানা আবরণে সরকারের ক্ষমতায় বসা ব্যক্তিবর্গ কেবল গুটিকয় মানুষের ধনী ও প্রভাবশালী অংশকে খুশি রাখতে তোষণ ও তুষ্টির কর-রাজস্ব কাঠামো ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে।

বিগত একযুগ ক্ষমতাসীন সরকার কর-রাজস্ব ব্যবস্থায় নানা সংস্কার সাধনের চেষ্টা করলেও আইন প্রণয়নের ব্যবস্থায় ব্যবসায়ী-আমলা-মুফতে রাজনীতিবিদ হওয়া শ্রেণির নিরঙ্কুশ আধিপত্য সেসব চেষ্টাকে অনেকটা দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই সরকার অন্তত ৩৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় করছে ভ্যাট থেকে, সামনে যা আরও বাড়বে বলে অনেকেই বলছেন।

এ রকম এক প্রেক্ষাপটে কিছুটা অর্থনীতি বোঝা লোকজন বলছেন, বছরে ৪০০ কোটি টাকা আয় করা নানা উপাধি যোগ করা পরজীবী ‘ক’ সাহেবের ১ লিটার পানি, তেল, দুধ কিনতে ‘১ টাকা’ ভ্যাট দেওয়া আর ওই একই পণ্যে বছরে ৪ লাখ টাকা আয় করা পরিশ্রমে মাথার ঘাম পায়ে পড়ার আগেই শুকিয়ে যাওয়া ‘খ’ সাহেবের ‘১ টাকা’ ভ্যাট দেওয়া যদি রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নকারীদের কাছে ন্যায্য মনে হয়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে তো গাছতলায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
যেকোনো কিছুর উপসংহারে কিছু পরামর্শ দিতে হয়, পর্যবেক্ষণ থাকে। এই লেখায় তেমনটা থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এমন একটা সময় আসে যখন মনে হয়, কী হবে সেসব পরামর্শ-পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে। আমাদের সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালকরা এই সহজ-সরল হিসাবের সবকিছুই জানেন-বোঝেন।

তারপরও তারা তেমন কিছু করতে পারছেন না, করছেন না। কারণ, তারা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার ফাঁদে পড়ে গেছেন। তবে তাদের মনে রাখতে হবে, এখনো তাদের এই ফাঁদ থেকে বাংলাদেশকে নিস্তার  দেওয়ার সময় আছে। নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের ভালোর জন্যেই দেশকে ফাঁদ থেকে বের করে আনার উদ্যোগ তাদের নিতেই হবে।

যারা বাংলাদেশকে নিংড়ে-খুবলে নিজেদের আত্মীয়-পরিজনকে উন্নত পাশ্চাত্যে সেটল করতে চাইছেন, তাদের জানা প্রয়োজন যে সেখানে কিন্তু নতুন অভিবাসীরা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক মর্যাদাই পান। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণির মানুষের করুণ অবস্থার কথা জানতে চাইলে বলে রাখি, সেখানে ৯০ শতাংশ সাধারণ নাগরিক তীব্র বিরোধিতা করলেও মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ প্রতিনিধিত্বকারী ইহুদি উগ্রবাদীরা সুদ ও সরকারি আনুকূল্যে অর্জিত অর্থ দিয়ে রাজনীতিবিদদের কিনে নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঘাড়ে বসেই বিশ্বের প্রায় ৬০০ কোটি মানুষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গণহত্যা চালাচ্ছে।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×