ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রচণ্ড দাবদাহে করণীয়

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ২ মে ২০২৪

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রচণ্ড দাবদাহে করণীয়

প্রসঙ্গ ইসলাম

দুর্বিষহ গরম ও দাবদাহ চলছে দেশব্যাপী। কারও কারও মতে অতীতের সত্তর বছরের রেকর্ড ভেঙেছে এবার। কোথাও স্বস্তি নেই। তীব্র তাপপ্রবাহে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকেই, বিশেষ করে শ্রমজীবীরা। প্রখর রোদে কাজ না করলে পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয় তাদের। তাই বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বৈরি পরিবেশেও কাজ করতে হচ্ছে তাদের। পরিস্থিতি এতটাই  বেগতিক যে, ইবাদত-বন্দেগি করাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

এ সময় মুসলমান হিসেবে পরকালের কথা চিন্তা করে আমাদের আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসা উচিত। এই কঠিন সময়কে অফুরন্ত সওয়াব লাভের মাধ্যম বানানোর জন্য কিছু আমল করা যেতে পারে। পাশাপাশি মহান আল্লাহর দয়ায় পরিস্থিতি যেন অনুকূলে আসে সেজন্য দোয়া-দরুদের মাধ্যমে ফরিয়াদ করা প্রয়োজন। নিম্নে  কয়েকটি আমল তুলে ধরা হলো :
পানি পান : গরমে বেশিরভাগ মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে। তাই অফিস, দোকান কিংবা বাসা যেখানেই হোক বাইরে থেকে কেউ এলেই তাকে এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করানোর মাধ্যমে অফুরন্ত সওয়াব লাভ করা যেতে পারে। নিজেকেও প্রয়োজনীয় পানি পানের মাধ্যমে সিক্ত রাখতে হবে। অনেকে গরম থেকে বাঁচার জন্য ফ্রিজ কিংবা বরফের পানির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এটি স্বাস্থ্যকর নয়। কেননা এর ফলে ঘরে ঘরে বাড়ছে জ¦র, সর্দি, গলা ব্যথা প্রভৃতি।

হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, সাদ ইবনে উবাদা (রা.) বলেন, (একদিন) আমি (নবীজিকে) বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! কোন সদকা উত্তম? তিনি বলেন, পানি পান করানো। (নাসায়ি, হাদিস : ৩৬৬৫)। নবীজির (সা.) এই সুন্নতটা আরবদের মধ্যে বেশি প্রচলিত। সেখানে কোনো দোকানপাট অথবা অফিস-আদালতে গেলেই এক বোতল ঠান্ডা পানি হাতে তুলে দেয়। অনেককে আবার তীব্র গরমের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে পথচারীদের মধ্যে ঠান্ডা পানি বিতরণ করতে দেখা যায়।

পরিতাপের বিষয় আমাদের দেশে এমনটি খুব কমই দেখা যায়। কেউ পানি চাইলে তা দেওয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও না দেওয়া কোনোভাবেই উত্তম কাজ নয়। নবীজি (সা.) কেউ পানি চাইলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে বারণ করেছেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আয়েশা (রা.) বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এমন কী জিনিস আছে, যা সংগ্রহে বাধা দেওয়া হালাল নয়? তিনি বলেন, পানি, লবণ ও আগুন। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই পানি সম্পর্কে তো আমরা জানি।

কিন্তু লবণ ও আগুনের ব্যাপারে কেন বাধা দেওয়া যাবে না? তিনি বলেন, হে হুমায়রা! যে ব্যক্তি আগুন দান করল, সে যেন ওই আগুন দিয়ে রান্না করা যাবতীয় খাদ্যই দান করল। যে ব্যক্তি লবণ দান করল, ওই লবণে খাদ্য যতটা সুস্বাদু হলো তা সবই যেন সে দান করল। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানকে এমন স্থানে পানি পান করাল, যেখানে তা সহজলভ্য, সে যেন একটি গোলামকে দাসত্বমুক্ত করল এবং যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানকে এমন স্থানে পানি পান করাল, যেখানে তা দুষ্প্রাপ্য, সে যেন তাকে জীবনদান করল।-(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪৭৪)।
অন্যকে সাহায্য করা : তীব্র গরমে অনেক সময় অনেক মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক সময় অনেক বয়োবৃদ্ধ তাদের জরুরি কাজ সেরে নেওয়ার জন্য বাইরে যেতে পারেন না। তখন তাদের সাহায্য করার মাধ্যমেও সদকার সওয়াব পাওয়া যেতে পারে। আবু জার (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ।

তোমার সৎকাজের আদেশ এবং তোমার অসৎকাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ তোমার জন্য সদকাস্বরূপ। পথহারা লোককে পথের সন্ধান দেওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ, স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন লোককে সঠিক দৃষ্টি দেওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ। পথ থেকে পাথর, কাঁটা ও হাড় সরানো তোমার জন্য সদকাস্বরূপ। তোমার বালতি দিয়ে পানি তুলে তোমার ভাইয়ের বালতিতে ঢেলে দেওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ।  (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৫৬)। 
কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সেবা করা : অনেক সময় দেখা যায়, অতিরিক্ত গরমে অনেক মানুষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাদের সেবা করে, তাদের নিরাপদে বাসা বা হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যেতে পারে। সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, কোনো মুসলমান তার কোনো (অসুস্থ) মুসলিম ভাইকে দেখতে গেলে সে (যতক্ষণ সেখানে থাকে ততক্ষণ) যেন জান্নাতের ফল আহরণ করতে থাকে। (তিরমিজি, হাদিস : ৯৬৭)।

আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, কেউ উত্তমরূপে অজু করে নেকির আশায় তার কোনো (অসুস্থ) মুসলিম ভাইকে দেখতে গেলে তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর খরিফ (সত্তর বছরের) পথ দূরে রাখা হবে। আমি (সাবিত আল-বানানী) আবু হামজাহকে জিজ্ঞেস করি, খরিফ শব্দের তাৎপর্য কী? তিনি বলেন, বছর। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩০৯৭)
পশুপাখির প্রতি সদয় হওয়া : গরমে মানুষের পাশাপাশি পশুপাখিও অস্থির হয়ে পড়ে। মানুষের উচিত আশপাশে থাকা পশুপাখির প্রতি সদয় হওয়া। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, এক ব্যভিচারিণীকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সে একটি কুকুরের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল।

তখন সে দেখতে পেল কুকুরটি একটি কূপের পাশে বসে হাঁপাচ্ছে। বর্ণনাকারী বলেন, পানির পিপাসা এটাকে মুমূর্ষু করে দিয়েছিল। তখন সেই নারী তার মোজা খুলে ওড়নার সঙ্গে বাঁধল। অতঃপর সে কূপ হতে পানি তুলল (এবং কুকুরটিকে পানি পান করাল), এ কারণে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হলো। (বুখারি, হাদিস :  ৩৩২১)
ইবাদতে অবহেলা না করা : গরমের কারণে ইবাদতে অবহেলা না করা। কারণ জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার গরমের চেয়ে বহুগুণে উত্তপ্ত। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, পেছনে থাকা লোকগুলো আল্লাহর রাসুলের বিপক্ষে বসে থাকতে পেরে খুশি হলো, আর তারা অপছন্দ করল তাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে এবং তারা বলল, তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না। বলো, জাহান্নামের আগুন অধিকতর গরম, যদি তারা বুঝত। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৮১)। 
জোহরের নামাজ দেরিতে পড়া : নবীজি (সা.) প্রচণ্ড গরমের দিনে জোহরের নামাজ কিছুটা বিলম্বে পড়ার অনুমতি দিয়েছেন, যাতে গরমের তীব্রতা কমলে মুসল্লিরা সহজে মসজিদে আসতে পারে। আবু হুরায়রা (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন গরমের প্রচণ্ডতা বৃদ্ধি পায়, তখন গরম কমলে সালাত আদায় করবে। কেননা, গরমের প্রচণ্ডতা জাহান্নামের নিঃশ্বাসের অংশ।

(বুখারি, হাদিস : ৫৩৩)। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, গরমের তীব্রতা বেড়ে গেলে তোমরা জোহরের সালাত ঠান্ডা করে (গরম কমলে) পড়ো। কেননা, গরমের তীব্রতা জাহান্নামের উত্তাপবিশেষ। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৬৭৮)
আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া : মানুষের পাপাচারই মানুষের ওপর বিপদাপদ ডেকে আনে। তাই প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূল বানাতে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিকল্প নেই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ‘আর বলেছি, তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, আর তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন আর দেবেন নদী-নালা।’  (সুরা : নুহ, আয়াত : ১০-১২)।

কল্যাণকর বৃষ্টি, শীতল বাতাস আল্লাহর রহমতের অংশ। নবীজি (সা.) এ কল্যাণকর বৃষ্টির জন্য দোয়া করতেন। তিনি বলতেন : আল্লাহুম্মা সাইয়েবান নাফিয়াহ- হে আল্লাহ কল্যাণকর বৃষ্টি দাও আর অকল্যাণকর বারিধারা উঠিয়ে নাও। নবীজি মদিনার খরার মৌসুমে বৃষ্টির জন্য মসজিদে নববী থেকে বের হয়ে ভক্তদের নিয়ে বৃষ্টির জন্য দোয়া করেছেন। আজও সে পুণ্যস্মৃতিময় জায়গাটি মসজিদে গামামা বা মেঘের মসজিদ নামে পরিচিত হয়ে আছে। এ কাহিনী নিয়ে পবিত্র কুরআনুল কারিমে আয়াতও নাজিল হয়েছে।

সেদিনকার ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে যুগে যুগে মুসলমানরা অনাবৃষ্টিতে ইসতিসকার নামাজ পড়ে আসছেন। এসব দোয়ায় শিশুদের আহাজারি আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় ঢেউ খেলে থাকে। মহানবী (সা.) নিজে তার দুই প্রিয় দৌহিত্র হাসান ও হোসাইনকে সঙ্গে নিয়ে দোয়া করতেন। প্রসঙ্গত : বর্ণিত আছে, একবার মুছা (আ.) হাজার প্রশ্নের ভিড়ে আল্লাহর কাছে জানতে চাইলেন : খোদা তুমি যখন খুশি হও তখন কি কর?

আল্লাহ বললেন, বৃষ্টি দেই। মুছা নবী আবার বললেন, বেশি খুশি হলে? আল্লাহ বললেন, বান্দার বাসায় আত্মীয়-মেহমান পাঠাই। এবার মুছা আবার জানতে চাইলেন এর চেয়েও বেশি খুশি হলে? আল্লাহ বললেন, বান্দার ঘরে কন্যা সন্তান দেই। প্রিয় পাঠক! এ তিনটি পাওনাকে সব সময় আমাদের জন্য আল্লাহর রহমত মনে করতে হবে। 
আসুন জাতির এই চরম দুর্দিনে এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য হাহাকারের সময় নবীজির (সা.) ভাষায় পরওয়ার দিগারের কাছে প্রতিনিয়ত আকুতি জানাই : আল্লাহুম্মা আসকিনা গাইছান মুগিসান মারিয়ান নাফেআন, গায়রা দোর, আজিলান, গায়রা আজালিন- হে রহমানুর রহিম! তুমি আমাদেরকে অবারিত বৃষ্টিধারায় সিক্ত করো, যা নিতান্তই উপকারী হয়, অপকারী যেন না হয়; যা দ্রুতই যেন দাও... (আবু দাউদ ১১৬৯)। 

লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×