
.
গেল কয়েক বছর ধরেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব ফিলোসফি (পিএইচডি) প্রোগ্রাম চালুর কথা জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক পর্যায়েই কাক্সিক্ষত মান অর্জনে সেভাবে সফলতা দেখাতে পারেনি। যার ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু নিয়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বরাবরই। এ অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তদারকি প্রতিষ্ঠান বারবার উদ্যোগ নিয়েও পিছিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দুই বছরেও এ সংক্রান্ত নীতিমালাই তৈরি করতে পারেনি।
ঠিক এ সময়ই ইউজিসিকে বাইপাস করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হলো পিএইচডি প্রোগ্রাম। যা নিয়ে দেশের প্রথম সারির হাফ ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার বিষয়টিও সমালোচিত হচ্ছে।
শুধুমাত্র একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে পিএইচডির সুযোগ পাওয়ার বিষয়ে ইউজিসি সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়ে আমি খুব বেশি জানি না। এ বিষয়ে মন্তব্য করার সক্ষমতা আমার নেই। তবে খুব দ্রুতই নীতিমালা প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানান।
জানা যায়, লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ডক্টর অব ফিলোসফি (পিএইচডি) প্রোগ্রাম চালু করেছে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি’। গত সোমবার (১৬ জুন) সন্ধ্যায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাসে ঘটা করে এই ঘোষণা দেয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ইউজিসি ও দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকরা উপস্থিত ছিলেন।
ইউজিসির কর্মকর্তারা বলছেন, নীতিমালা ছাড়াই অনুমোদন কিভাবে দেওয়া যায়! এই প্রোগ্রাম কোন নিয়ম মেনে চলবে বা দায়িত্ব-কর্তব্য কী? এ ছাড়া দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্বের ঝুঁকি, আইনি জটিলতা, অসামঞ্জস্য ও দ্বৈত নীতিকে সমর্থন দেবে, দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমালোচনাও করেন অনেকে। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আগামীতে পিএইচডি চালুর বিষয়ে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও এমন সুযোগ নিতে পারে। এমন নিয়মের ব্যত্যয় অনেকের মধ্যেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
সূত্র বলছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়ে এই প্রোগ্রাম চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ। সেক্ষেত্রে তদারক সংস্থা তথা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে বাইপাস করা হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্যাম্পাসের কার্যক্রম শুরু করে। যা ২০২৩ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী উদ্বোধন করেন। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রার সময়ও ইউজিসিকে বাইপাস করেছিল। তৎকালীন সরকার প্রধানের দপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতির ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি চালুর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। যা নিয়ে সে সময় ইউজিসি তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল। এবারও এমনভাবেই হয়েছে কী না তা জানতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা এ বিষয়ে কোনো উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মন্তব্য জানাতে রাজি হয়নি। উল্টো ইউজিসির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে আদেশের ভিত্তিতে এই প্রোগ্রাম চালু হয়েছে তার একটি চিঠি জনকণ্ঠের হাতে রয়েছে। গত ১ জুন প্রকাশিত চিঠিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (এসওএএস), ইউনিভার্সিটি লন্ডনের সঙ্গে একটি যৌথ পিএইচডি প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদান করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. সুলতান আহমেদ। চিঠির শর্তে, বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালুর লক্ষ্যে প্রণীতব্য নীতিমালার সঙ্গে ভবিষ্যতে কোনো বিষয় সাংঘর্ষিক হলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা মেনে চলতে বাধ্য থাকবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নীতিমালা না থাকায় বিশ^বিদ্যালয়টি কি মেনে চলবে, কিভাবে এই প্রোগ্রাম পরিচালনা করবে সে বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়-১) রোখছানা বেগম ‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি অনুমোদনের বিষয়টি জানেন না বলে জানান। উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন বলেও জানান তিনি। সহকারী সচিব (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-১) মো. সুলতান আহমেদ বলেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর জন্য আবেদন করেছিল। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের উপদেষ্টা এ সংক্রান্ত অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের সিনিয়র সচিব এবং উপদেষ্টা ভালো বলতে পারবেন। আমাদের পর্যায় থেকে কোনো কিছুর অনুমোদন হয় না।
এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে নীতিমালা তৈরিতে কাজ করছে ইউজিসি। ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির জন্য একটি সাব-কমিটি তাদের কাজ শুরু করেছেন। সাব-কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম জানান, কমিটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করছে। কমিটির সুপারিশগুলো ইউজিসিকে দেব। এরপর তারা সেটি নীতিমালা আকারে প্রকাশ করবে। তিনি বলেন, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির অধীনে। ব্র্যাকও এর আওতাধীন। সুতরাং এই নিয়ম-নীতির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কীসের ভিত্তিতে এই অনুমোদন হলো বিষয়টি নিয়ে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রশ্ন করার কথা বলেন তিনি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় ইউজিসি সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন নিয়ম মেনেই ব্রাক পিইচডি শুরু করেছে। কিন্তু যেখানে নীতিমালা নেই, নিয়ম নেই, ইউজিসির অনুমোদন নেই সেই নিয়ম কী এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বেসরকারি ডিভিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের সদস্যই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য জানাতে পারেননি।
গত বছরের জুন মাসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর করতে কাজ শুরু করে ইউজিসি। সে সময় এ সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে কমিটি গঠন করা হলেও ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এ কমিটি ভেঙে যায়। পরে আবার নতুন করে নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করে ইউজিসি সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে এ কমিটির নীতিমালা প্রণয়ন কাজ চলমান রয়েছে। এতে ইউজিসি সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও দায়িত্বশীলরা রয়েছেন। বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পিএইচডি চালুর সুযোগ থাকলেও ১৯৯২ সাল থেকে চালু হওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা নেই। তবে অভিনবভাবে শুধুমাত্র ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ে এই প্রোগ্রাম প্রথমবারের মতো শুরু হলো।
প্যানেল