ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

এলডিসি থেকে উত্তরণে সমস্যা-সম্ভাবনা

মর্যাদা না বাণিজ্য- কোন পথে যাবে বাংলাদেশ?

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:০৩, ১১ জুন ২০২৫

মর্যাদা না বাণিজ্য- কোন পথে যাবে বাংলাদেশ?

এলডিসি থেকে উত্তরণে সমস্যা-সম্ভাবনা

একদিকে মর্যাদা, অন্যদিকে সাহায্যপ্রাপ্তির সুযোগ। একদিকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার হাতছানি, অন্যদিকে কম সুদে অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা। একদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা, অন্যদিকে রপ্তানিকারকদের জন্য শর্তের শিথিলতা। একদিকে সরকারের ক্রেডিট নেওয়ার সুযোগ, অন্যদিকে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের তীব্র আপত্তি। কোন পথে যাবে বাংলাদেশ? ভুটান-মালদ্বীপের মতো বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে? না-কি সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অনুকরণে আবেদন করে সময় বাড়াবে?

প্রসঙ্গ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় থাকা না-থাকা। গত ৫০ বছর ধরেই জাতিসংঘের বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান এলডিসিতে। সম্প্রতি এ তালিকা থেকে না কাটানোর একটা সুযোগ পেয়েছে দেশ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি তালিকা থেকে মুছে দেওয়া হবে বাংলাদেশের নাম। এ যাত্রায় তীব্র আপত্তি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের। তাদের আশঙ্কা, এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারিয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ।
জানা যায়, অর্থনৈতিক বিবেচনায় সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে জাতিসংঘ। উন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যেগুলো একটু বেশি দুর্বল সেগুলোর একটি পৃথক তালিকা করা হয় ১৯৭১ সালে। নাম দেওয়া হয় স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি)। গত ৫০ বছর ধরেই বাংলাদেশ একাধারে উন্নয়নশীল দেশ এবং স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি)। বাংলাদেশ এলডিসিতে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) নিয়মানুযায়ী, এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। গত ৫৪ বছরে অভাবনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির নেপথ্য কারণ এই এলডিসি। গত ২০ বছর ধরেই এলডিসির তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। অর্থাৎ আমরা দবিদ্রদের মধ্যে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছি।
বিশ্লেষকরা জানান, এলডিসি থেকে বের হলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি পাসপোর্টের মর্যাদা বাড়বে। গরিব বা স্বল্পোন্নত বলে আমাদের তাচ্ছিল্য করার সুযোগ থাকবে না। অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বড় অংকের ঋণ পাবে। যদিও এ ঋণের সুদহারও হবে উচ্চ। এলডিসি থেকে বের হওয়ার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে অধিক আস্থাশীল হবে। কূটনৈতিক পরিম-লে বাংলাদেশ পাবে অপেক্ষাকৃত মর্যাদার আসন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) নিয়ম কোনো দেশের নাম এলডিসির তালিকায় থাকলে উন্নত দেশগুলো ওই দেশকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সেই নিয়মে বাংলাদেশ বর্তমানে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা পায়। ২০২৬ সালের পর আমাদের ব্যবসায়ীদেরকে শূল্ক পরিশোধে করেই রফতানি করতে হবে। পড়তে হবে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে। বিশেষ করে আমাদের ওষুধ শিল্পের ওপর নেমে আসবে মেধাস্বত্বের কঠিন চাপ। বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো তখন আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে দিতে বাধ্য হবে।

২০৩৩ সালের আগে কোনো দেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে ওষুধশিল্পের এই সুবিধা থাকবে না। কমে যাবে আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমাদের শিক্ষার্থীদের বৃত্তির সংখ্যা কমে যাবে। বেড়ে যাবে বৈদেশিক ঋণের সুদহার। কড়াকড়ি হবে পরিবেশ, জলবায়ু, শ্রম পরিবেশ, মজুরি কাঠামোসহ নানা ইস্যুতে। ব্যাবসায়ী শিল্পপতিতে আশঙ্কা, এখনই এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে দেশের বহু কারখানা। ক্ষতিগ্রস্ত হবে রফতানি বাণিজ্য।
জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোনো দেশ এলডিসি তালিকায় থাকবে কি থাকবে না বিষয়টি সেদেশের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভব করে না। কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) নামক জাতিসংঘের একটি বিশেষ কমিটি এ বিষয়ে সুপারিশ করে থাকে। কমিটি প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর প্রাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা বিষয়ে ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করে। পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে এসব বিষয়ে নির্ধারিত মান অর্জন করলেই কোনো দেশকে এলডিসি থেকে বের হওয়ার সুপারিশ করে সিডিপিএরপর দেশটিকে প্রস্তুতির জন্য তিন বছর সময় দেওয়া হয়। তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ওঠে অনুমোদনের জন্য। এরপর চূড়ান্তভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটে ওই দেশের। এর কোনো পর্যায়েই সংশ্লিষ্ট দেশটি ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো গুরুত্ব বা প্রভাব থাকে না। 
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদন্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশ। ২০২১ সালেই সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে পারে বাংলাদেশ। কিন্তু করোনার কারণে এ সময় আরো দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। সে অনুযায়ী আগামী বছরের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকার সে পথেই এগোচ্ছে। ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তাকে আমলে নিয়ে এ তারিখ পেছাতে চাইলে কেবল একটি পথই খোলা আছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূসকে এর কারণ ব্যাখ্যা করে উত্তরণ পেছানোর জন্য জাতিসংঘে আবেদন করতে হবে। চাওয়াটা সন্তোষজন বিবেচিত হলে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অনুকরণে কয়েক বছর সময় পাওয়া যেতে পারে। যদিও এমনটি হলে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের যুক্তি, এলডিসি থেকে বেরিয়ে ভুটান-মালদ্বীপ-লাওস-নেপাল টিকে থাকতে পারলে আমরা কেন পারবো না?
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এলডিসি থেকে উত্তরণে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণে পূর্ণ উদ্যমে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ সংক্রান্ত এক সভা শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রধান উপদেষ্টার বরাত দিয়ে সাংবাদিকদে বলেন, এলডিসি উত্তরণের বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। এখন পূর্ণ উদ্যমে কাজ এগিয়ে নিতে হবে। সে অনুযায়ী যত ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার তা নিতে হবে। এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে একটি ডেডিকেটেড টিম গঠন করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।

যদিও গত মার্চ মাসে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিযুক্ত হওয়ার পর আনিসুজ্জামান চৌধুরী অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকার জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) কাছে এ ব্যাপারে আবেদন করবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের কোনো সক্ষমতা আমাদের নেই দাবি করে বাংলাদেশ ন্যিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নবনির্বাচিত সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের রফতানি খাতের পরিস্থিতি কোনোভাবেই উপযুক্ত নয়। আমাদেরকে যেকোনো মূল্যে এখান থেকে ফিরে আসতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকই তো স্বীকার করলো, রফতানির যে ফিগার দেখানো হয়েছে তা সঠিক নয়। তারা রফতানি ফিগার কারেকশনও করেছে। ৪৭ বিলিয়ন রফতানি দেখানো হলো।

আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এই রফতানি আমরা করিনি, আমাদের সাথে এই হিসাবের মিল নেই। সরকার যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, সেক্ষেত্রে আমাদের রফতানি খাতগুলোর জন্য কী ব্যবস্থা নেবে, সে বিষয়ে সরকারের সাথে আমাদের আলোচনা হওয়া দরকার। রোডম্যাপ ছাড়া সবাই বসে থাকলে এবং নির্দিষ্ট সময়ে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলে তখন আমাদের গভীর সমুদ্রে হাতড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞের অভিমত, বাংলাদেশের উচিৎ হবে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়া। এলডিসিতে থাকা না থাকা সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) এর সাথে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা সেন্টার ফর পলিসি ডালালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফ্যালো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, এটি যেকোনো দেশের জন্য মর্যাদার ব্যাপার। এলডিসি থেকে বেরিয়ে ভুটান-মালদ্বীপ-লাওস-নেপাল টিকে থাকতে পারলে আমরা কেন পারব না? তবে আমাদের রপ্তানি খাতের সুরক্ষায় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেলাচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দেন তিনি।

×