
মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনা
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত সব হত্যার দায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, জুলাই-আগস্টে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা। এই গণঅভ্যুত্থানে সব হত্যাকা-ের দায় তার। সোমবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান চিফ প্রসিকিউটর।
জুলাই গণহত্যার ঘটনায় সকল হত্যাকা-ের সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি শেখ হাসিনার। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী পাঁচ অভিযোগ রয়েছে। সেসব অভিযোগের মধ্যে দুটি প্রকাশ করা হয়েছে। বাকিগুলো আপাতত সবার জন্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, রাজপথের চাপ মাথায় নিয়ে বিচার করা যাবে না। আন্তর্জাতিক মানসম্মত বিচার করতে গেলে যতটুকু সময় নেওয়া দরকার ততটুকু নেয়া হবে।
এ নিয়ে জুলাই গণহত্যার দুই মামলার তদন্ত শেষ হলো। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হবে। আশা করছি ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই যাচাই-বাছাই করে ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে বলে প্রত্যাশা করছি। ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করার পরই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে যত লোক মারা গেছে, যত লোক আহত হয়েছে প্রত্যেকটার ব্যাপারে তার (সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) বিরুদ্ধে চার্জ রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের বিষয়ে উসকানি ও সরাসরি নির্দেশ। এ বিষয়ে তার বন্ড কল রেকর্ড, অডিও-ভিডিও পাওয়া গেছে। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট তিনটি ঘটনার বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, প্রতিবেদনে এসেছে প্রায় দেড় হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে, ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত করা হয়েছে, নারীদের ওপর বিশেষভাবে সহিংসতা চালানো হয়েছিল, লাশ একত্রিত করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, আহতদের হাসপাতালে নিতে বাধা দেওয়া হয়েছিল, পোস্টমর্টেম করতে বাধা দেওয়া হয়েছিল, ডাক্তারদের চিকিৎসা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছিল।
শেখ হাসিনার বিষয়ে তিনি বলেন, হাসপাতালে শেখ হাসিনা নিজে গিয়ে বলেছিলেন এসব ভর্তি রোগীকে যাতে চিকিৎসা দেওয়া না হয়। রোগীরা যখন যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হাসপাতাল থেকে চলে যেতে চেয়েছিল তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। যাতে পচে গেলে কেটে ফেলতে হয় সেরকম নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, আন্দোলকারীদের ওপর দায় চাপানোর জন্য বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় নিজেদের লোকদের দিয়ে অগ্নিসংযোগের নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
সোমবার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয় জুলাই গণহত্যা মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদিন সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করেন তদন্ত সংস্থার কো-অর্ডিনেটরসহ সংশ্লিষ্ট তিনজন কর্মকর্তা।
তদন্তে উঠে এসেছে ২০২৫ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণহত্যায় শেখ হাসিনা সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে, এটি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যায় জড়িত থাকার বিষয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক তদন্ত প্রতিবেদন। একই সঙ্গে জুলাই গণহত্যায় তার জড়িত থাকারও প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন এটি।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, আগামী দুই-তিন সপ্তাহ প্রসিকিউশন তদন্ত সংস্থার দেওয়া প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করবে। এরপর সেটা আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র (ফরমাল চার্জ) হিসেবে ট্রাইবুনালে দাখিল করবে। গত বছরের ১৪ আগস্ট একটি অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হয়। দীর্ঘ ৬ মাস ২৮ দিন তদন্ত করে তদন্ত সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগের সত্যতা পায়।
এর আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জুলাই-আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত ২০ এপ্রিলের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ওইদিন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন।
চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, জুলাই গণহত্যার ঘটনায় সকল হত্যাকা-ের সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি শেখ হাসিনার। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী পাঁচ অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগগুলোর মধ্যে দুটি অভিযোগ প্রকাশ করা হয়েছে। বাকিগুলো আপাতত সবার জন্য প্রকাশ করা হচ্ছে না।
প্রথম অভিযোগটি হচ্ছে- শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানি ও প্ররোচনা দিয়েছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে রাজাকারের নাতিপুতি বলে উল্লেখ করেছিলেন। এটা বলার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপর তারা মানবতাবিরোধী এসব অপরাধ করে। এই উসকানির দায়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্ররোচনার অভিযোগ উঠে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় যে অভিযোগের কথা বলা হয়েছে সেটা হচ্ছে সরাসরি নির্দেশ। তদন্ত সংস্থা শেখ হাসিনার অনেক টেলিফোন কনভারসেশন জব্দ করেছে। সেখানে তিনি বারবার সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত করেছেন, রাষ্ট্রীয় সকল বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন, হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র-নিরীহ আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। সরাসরি সেই নির্দেশের প্রমাণপত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা হাতে পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে এই দ্বিতীয় অভিযোগটি দাখিল করেছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাইব এ বিচারের কোনো ধরনের অনিয়ম না হোক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন না হোক। পাশাপাশি এ বিচারে যেন কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি না হয় এবং বিচারকার্য যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কল রেকর্ড, ভিডিও ফুটেজ, উদ্ধারকৃত বুলেট, হেলিকপ্টারের ফ্লাইট সিডিউলসহ বিভিন্ন আলামত জমা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, যারা শহীদ হয়েছেন তাদের যেসব ডাক্তার চিকিৎসা দিয়েছেন বা অ্যাটেন্ড করেছেন তারা সাক্ষী হিসেবে আসবেন।
যারা সরাসরি আহত হয়েছেন তারাও সাক্ষী হিসেবে আসবেন। পাশাপাশি শহীদ পরিবারের যারা তাদের নিজেদের স্বজনদের লাশ রিসিভ করেছেন, দাফন করেছেন তারাও সাক্ষী হিসেবে আসবেন। পাশাপাশি আলামত হিসেবে বিভিন্ন কল রেকর্ড, অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ এবং বুলেট যেগুলো নিহত বা আহতদের শরীর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো। যে সমস্ত হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোর ফ্লাইট সিডিউল, সেখানে কারা যাত্রী ছিলেন ও কী ধরনের অস্ত্র সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো তদন্ত সংস্থা দাখিল করেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ভারত পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে সারা দেশের আন্দোলন দমনে মাঠে নামানো হয় পুলিশ, র্যাব, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের। তিন সপ্তাহে নির্বিচারে হত্যা করা হয় ১৪শ’র বেশি ছাত্র-জনতাকে। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার বলেও জানানো হয়।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর জুলাই-আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা দুই মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত দুই মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি, হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বিচারে হত্যা চালায়। প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারান এ আন্দোলনে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়।
সংবাদ সম্মেলনে চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে কি না সে বিষয়ে ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের যে সংশোধন হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন যদি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় সেক্ষেত্রে তাদের বিচারের আওতায় আনা যাবে এবং বিচারে কি কি শাস্তি দেওয়া যাবে তা বলা হয়েছে। গত শনিবার রাতে মাত্র আইনটি করা হয়েছে।
এখন আমরা ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নেব যে, ‘কোনো রাজনৈতিক দলের বিষয়ে তদন্ত করা হবে কি না। বিচারের মুখোমুখি করা হবে কি না।’ এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, ‘আমাদের তদন্ত সংস্থার কাছে যদি মনে হয় যে, এই দলটি মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা দরকার তাহলে আইন অনুযায়ী তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হবে।’