
.
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে পাঁচ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী। এছাড়া অনেকেই অপেক্ষায় ছিলেন দেশ ছাড়ার। এরমধ্যে অনেকেই আটক হয়েছেন বিমান বন্দরে আবার কেউ আটক হন সীমান্ত এলাকায়। গত বুধবার স্বৈরশাসক হাসিনা সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়ে দেশ ছাড়ার পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো। ৫ আগস্টের পর বেশকিছু ইস্যুতে জুলাইয়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো আলাদা হলেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ইস্যুতে এক মঞ্চে এসেছে জুলাইয়ের সব শক্তি। ৯ মাস আগের আন্দোলনের সূত্র ধরে নতুন করে গতি পেয়েছে এই প্রতিবাদ। এতে তারা দাবি করেন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। জুলাই বিপ্লবের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। জুলাই ও শাপলাসহ সকল গণহত্যার বিচার করতে হবে। এদিকে বিষয়টি বিএনপির নয় বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান। তবে জামায়াত আন্দোলনকারীদের অবস্থান কর্মসূচিতে এসে সংহতি জানিয়েছে।
আব্দুল হামিদ দেশ ছাড়ার সংবাদ প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় প্রতিবাদ। সন্ধ্যায় খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় প্রতিবাদ জানায় ছাত্র-জনতা। রাত ১০টায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ অবস্থান নেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার গেটে। রাত সোয়া দশটার দিকে ঢাবির ভিসি চত্বর থেকে ‘জুলাই ঐক্যের’ সংগঠকেরা মিছিল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে যান। যেখানে উপস্থিত ছিলেন গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠন এবি যুবায়ের, মুসাদ্দেক আলী ইবনে মুহাম্মাদসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
যমুনার সামনে রাত ১১টা থেকে জড়ো হতে শুরু করে সাধারণ মানুষ। রাত সাড়ে ১১টার দিকে মিছিল নিয়ে যমুনার সামনে আসেন আপ বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা। যেখানে উপস্থিত ছিলেন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ) নামের নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ, সদস্য সচিব আরেফিন মোহাম্মদ হিজবুল্লাহ ও প্রধান সমন্বয়কারীরা সালমান রিফাতসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী।
রাত ১২টার দিকে দফায় মিছিল নিয়ে যমুনার সামনে আসেন ছাত্র-শিবিরের কয়েকশ’ নেতাকর্মী। যেখানে উপস্থিত ছিলেন ছাত্র শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি বর্তমান কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লা, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদসহ অনেকেই। এরপরই যমুনামুখী আসতে শুরু করে জনস্র্রোত।
রাত ১টার দিকে মিছিল নিয়ে যমুনার সামনে অবস্থান নেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আকতার হোসেনসহ কয়েকশ’ নেতাকর্মী। এ সময় অবস্থান নিতে দেখা যায় হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের।
শুক্রবার সকালে যমুনার সামনে মিছিল নিয়ে আসেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শুক্রবার বাদ জুমা যমুনার সামনে সমাবেশের ঘোষণা দেন অবস্থানকারীরা। একই দিন শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে জুলাই ঐক্যের সংগঠক মুসাদ্দেক।
জুমার নামাজের পর যমুনার সামনে সমাবেশে উপস্থিত হতে শুরু করেন জাতীয় নাগরিক পার্টি ও ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও সংগঠনের নেতারা। অপরদিকে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে জুলাই ঐক্যের সংগঠকও কর্মীরা।
জুলাই ঐক্যের সংগঠক মুসাদ্দেক জনকণ্ঠকে বলেন, তিনটি দাবিতে আমরা শাহবাগে অবস্থান নিয়েছি। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অবস্থান কর্মসূচি চলবে। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে স্থায়ী নিষিদ্ধকরণ, জুলাই বিপ্লবের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং জুলাই গণহত্যা, শাপলা গণহত্যাসহ লীগের সকল অপকর্মের বিচার।
জুমার নামাজ শেষে যমুনার সামনে দুপুর ২টার দিকে শুরু হয় সমাবেশে। যেখানে উপস্থিত হয়ে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সর্বদলীয় সভা ডেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে বিগত বছরগুলোতে যারা গুম-খুন ও অর্থ-পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন দলের নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ কোনোভাবে রাজনৈতিক দল নয়। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ বাকশাল তৈরি করে এ দেশে গণতন্ত্রের পরিবর্তে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছিল। আওয়ামী লীগের লুটপাটের কারণে দুর্ভিক্ষের কারণে ১৫ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের হাতে এ দেশের মানুষের রক্ত লেগে আছে। আওয়ামী লীগ ভারতের সহায়তায় দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের হত্যা করেছিল।
হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতি সেদিন থেকে শুরু হবে, যেদিন বাংলাদেশ টাইটেল পাবে ‘বাংলাদেশ উইদা উট আওয়ামী লীগ’। আমরা সেটাই টেল দেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ আগে মানুষের সমাগম করার জন্য এ জায়গা বেছে নিয়েছিলাম। এ জায়গা থেকে আমরা এখন রাস্তা ব্লকেড করব। ইন্টারিমের কানে আমাদের কথা পৌঁছায় নাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কানে আমাদের আওয়াজ পৌঁছায় নাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আহতদের আওয়াজ পৌঁছায় না, আহতদের আর্তনাদ পৌঁছায় না, আমরা এখান থেকে গিয়ে শাহবাগে অবরোধ করব। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত আমরা জায়গা ছাড়ব না।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গণসমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, জুলাই ঐক্যের সংগঠক এবি জুবায়ের, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফও সমান হাদিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
যমুনায় যখন সমাবেশ শেষের দিকে তখন শাহবাগে রাস্তা দখল করে যান চলাচল বন্ধ করে দেন জুলাই ঐক্যের নেতারা। বিকেল পাঁচটার দিকে হাসনাত আব্দুল্লাহর ঘোষণার পর যমুনা থেকে ছাত্র-জনতা উপস্থিত জড়ো হতে শুরু করে শাহবাগে। বন্ধ হয়ে যায় সম্পূর্ণ যান চলাচল। সাড়ে ৫টার দিকে শাহবাগে আসেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। শহীদ মিনার থেকে সন্ধ্যায় আত্মপ্রকাশ শেষে মিছিল শাহবাগে আসেন আপ বাংলাদেশের নেতা-কর্মীরা।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ইস্যুতে কয়েকটি রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে আসলে দলগতভাবে এই বিষয়ে ভিন্নমত দিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। এটা বিএনপির বিষয় নয়।
অপরদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, অবিলম্বে সব রাজনৈতিক দলকে ডেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান আন্দোলনকারীদের সালাম জানিয়েছেন এবং আশা প্রকাশ করেছেন যে সরকার ছাত্র-জনতার দাবি পূরণ করবে।
এদিকে আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে- এমন তথ্য জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। শুক্রবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানান তিনি।
বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও জনগণের পক্ষ থেকে স্বৈরশাসন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এ বিষয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এরইমধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন সরকার বিবেচনায় রাখছে। সে পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধারণ করার আহ্বান জানাচ্ছে সরকার। এরইমধ্যে সরকার জন দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রচলিত আইনের অধীনে সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে।
প্যানেল