
ঠাকুরগাঁও-৩ (পীরগঞ্জ ও রানীশংকৈল উপজেলার আংশিক) সংসদীয় আসন
ঠাকুরগাঁও-৩ (পীরগঞ্জ ও রানীশংকৈল উপজেলার আংশিক) সংসদীয় আসন। গত চারটি নির্বাচনে কখনো জোট-মহাজোট, কখনো মহাজোটের শরিক দলের মধ্যে, আবার কখনো মহাজোটের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর লড়াই হয়েছে। জোট-মহাজোটের হিসাব-নিকাশে পড়ে ২০০১ সাল থেকে সেখানে দলের কোনো প্রার্থী পাননি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সে কারণে জেলার অন্য দুটি আসনের তুলনায় উন্নয়নের দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে এই আসনটি। দলীয় নেতাকর্মীরা এবার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন। দলীয় প্রার্থী রাখার জন্য তারা বিভিন্ন মহলে জোর দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা বলছেন, বারবার এক আসন না ছেড়ে বদল করে আসন ছাড়া হলে দল এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
ঠাকুরগাঁও-এর এই আসনটি শুধু উদাহরণ মাত্র। এই আসনের মতো প্রায় ৪০টির মতো আসন রয়েছে, যেখানে জোট-মহাজোটকে বারবার আসনগুলো ছাড় দেওয়ায় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় নেতাকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, ততই এই ক্ষোভের মাত্রা বাড়ছে। নৌকা পেয়েও বারবার আসন ছেড়ে দেওয়ার বঞ্চনা আর নিতে চান না দলের প্রার্থীরা। বারবার একই আসনে শরিকদের ছাড় দেওয়ায় আসনগুলো যেমন কাক্সিক্ষত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি দলীয় প্রতিনিধি না থাকায় এসব আসনে সাংগঠনিকভাবে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
এবার এসব আসনে সোচ্চার দাবি উঠেছে, বারবার একই আসন আর ছাড় নয়। রাজনৈতিক কৌশল ও বিরোধী পক্ষকে নির্বাচনে পরাজিত করতে জোট-মহাজোটের প্রয়োজন রয়েছে। দেশ ও দলের স্বার্থে অনেক ডাকসাইটে নেতাকেও জোট সমঝোতার বলি হতে হয়, এটিও সবার জানা। কিন্তু প্রতিবার জোট শরিকদের একই আসনগুলো ছাড় না দিয়ে আগামীতে দলের স্বার্থে আসন পরিবর্তনের দাবি উঠেছে সর্বত্র। একই আসনে বারবার ছাড় না দিয়ে একেক নির্বাচনে একেকটি আসনে ছাড় দিলে এলাকার যেমন উন্নয়ন হবে, তেমনি দলীয় প্রতিনিধি পেলে সাংগঠনিকভাবেও আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হবে। এ প্রসঙ্গে তারা এবার জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে ঢাকা-৮ আসনের পরিবর্তে নিজ জন্মস্থান বরিশালের একটি আসন দেওয়ার উদাহরণ তুলে ধরেন।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাক্সিক্ষত নৌকা প্রতীক পেয়েও তা হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত আওয়ামী লীগের বহু প্রার্থী, বাঘা বাঘা নেতারাও। নির্বাচনী জোটের মিত্র ও শরিক দলগুলোর আসনগুলোতে নৌকার মাঝিদের আসনে সমঝোতা হলেই দলীয় প্রতীক হারানোর ভয়ে দিন কাটছে তাদের। শরিকদের আসনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা সবাই এখন তাকিয়ে আছেন দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের দিকে। সমঝোতার ভোটের রাজনীতির এসব ধোঁয়াশা কেটে যাবে ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগেই।
১৪ দল ছাড়াও বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং কিছু মিত্রদলের আসনে মনোনয়ন পাওয়া আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের এ ধরনের শঙ্কা খুবই বেশি। এসব আসনের প্রার্থীরা নিশ্চিন্ত হয়ে না পারছেন ভোটের মাঠে কোমর বেঁধে নামতে, না পারছেন ঘরে বসে থাকতে। প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ আসনে ঝুঁকিতে থাকা নৌকার প্রার্থীদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটছে, তা দেখতে ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
শঙ্কায় থাকা অনেক বাঘা বাঘা আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক কৌশল ও ভোটের হিসাবের অঙ্কে সমঝোতার বিপক্ষে আমরা কেউ নই। সাংগঠনিক ও সমর্থনের দিক থেকে তেমন ভিত না থাকলেও একই আসন বারবার শরিকদের ছাড় দেওয়ায় আমাদের অস্তিত্বই এখন হুমকির সম্মুখীন। আওয়ামী লীগের ভোটে শরিকরা বিজয়ী হলেও পরে আমাদেরই কোণঠাসা করে রাখেন এবং উন্নয়ন কর্মকা- থেকে আমাদের দূরে রাখেন এসব জোটের এমপি। আমাদের দল ক্ষমতায় থাকলেও অনেক আসনেই জোটের এমপিদের হাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থকরা নিগৃহীত, হামলা-মামলার শিকারও হতে হয়েছে।
তারা আরও বলেন, গত ১৫ বছর ধরে এমপি হতে না পেরেও মাটি কামড়ে থেকে এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি, নৌকার পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন আদায় করতে পেরেছি। ১৫ বছর পর এবার নৌকা পাওয়ায় আমাদের নেতাকর্মী, সমর্থক ও ভোটাররা এবার উচ্ছ্বসিত, উজ্জীবিত। এতদিন পর নৌকা পেয়েও সমঝোতার কারণে যদি তা হারাতে হয়, তবে সমর্থকদের ধরে রাখাই কঠিন হয়ে যাবে। তাই আমাদের দাবি, প্রতিবার এক আসন নয়, ঘুরে ঘুরে জোটের শরিকদের আসন পরিবর্তন করে ছাড় দেওয়া হোক।
নইলে বারবার ছাড় দেওয়া হলে এসব আসনে আগামীতে আওয়ামী লীগের জয় আনাই কঠিন হয়ে পড়বে। অনেক আসন রয়েছে যেখানে বর্তমান সংসদ সদস্যরা অনেক অপকর্ম করেছেন। তাদের জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে। এমন একশ’ আসনে মনোনয়ন বদল হলেও এমন আরও অর্ধশতাধিক আসন রয়েছে। জোটের কাছে এই আসনগুলোও ছাড়ার চিন্তা করা যায়।
জোট-মহাজোটকে ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে বিগত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব প্রতিটি আসনেই আওয়ামী লীগের বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী আছে। মনোনয়ন নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব-বিভেদ থাকলেও অন্যান্য আসনের চেয়ে এগুলোতে দলীয় ঐক্য অনেক দৃঢ়। বারবার আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় তারা এবার ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছে। জোট শরিকদের আসনে নৌকার প্রার্থী ঘোষণা করায় এসব আসনে সবাই একাট্টা হয়ে দলকে বিজয়ী করতে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বহু আকাক্সিক্ষত দলীয় মনোনয়ন ও নৌকা প্রতীক পাওয়ার পরও প্রায় অর্ধ-শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা আবারও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটাচ্ছেন প্রতীক হারানোর ভয়ে। স্বাধীনতার পর থেকে দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে কাজ করা ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে এবার কেউ কেউ দলীয় মনোনয়ন পেলেও তারাও শেষ পর্যন্ত জোটের কারণে মনোনয়নবঞ্চিত হন কি না তা নিয়ে আতঙ্কিত।
গত তিনটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া আসনের আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি একনিষ্ঠ সমর্থকরা প্রকাশ্য আক্ষেপ করেই বলছেন, পনেরো বছর হয়ে গেছে, আমরা নৌকা প্রতীকে দলীয় কোনো নেতাকে ভোট দিতে পারিনি। আমরা ভোট দিয়ে যাদের এমপি বানিয়েছি, তারা আর আমাদের দিকে ফিরেও তাকাননি। নৌকার ভোটে এরা বিজয়ী হলেও দলের নেতাকর্মীদের উন্নয়ন কর্মকা- থেকে শুধু বঞ্চিতই করে রাখেনি, বরং অনেক স্থানে জোটের এমপিদের হাতে লাঞ্ছনা-গঞ্জনাও সইতে হয়েছে।
নানা উদাহরণ টেনে তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের এমপি থাকা আসনগুলোতে গত ১৫ বছরে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, জোটের শরিকদের ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে সেই তুলনায় তেমন উল্লেখ করার মতো উন্নয়ন হয়নি। এতে দলের স্থানীয় কর্মীরাও ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আর এর সুযোগ নিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। এসব আসনের আওয়ামী লীগপ্রেমী মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত। এর পেছনের প্রধান কারণই হচ্ছে, দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকে সংসদ সদস্য হিসেবে এলাকাবাসী পায়নি। এতে হতাশা ক্রমেই বেড়েছে। অনেক আসনের নেতারাই এবার বলছেন, আর ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমঝোতার প্রতিটি বৈঠকে ১৪ দলের শরিক নেতারা ছাড়াও জাতীয় পার্টি ও মিত্ররা সবাই একবাক্যে আওয়ামী লীগের কাছে দাবি করেছেন, তাদের অনুকূলে ছাড় দেওয়া আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের রাখা যাবে না। এমনকি তারা সম্ভাব্য ছাড় পাওয়া আসনগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও না রাখার দাবি জানালেও এ ব্যাপারে রাজি হয়নি আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। শরিকদের সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিদ্রোহী কোনো প্রার্থীকে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে যেতে বলবে না আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনে অধিক ভোটার আনা নিশ্চিত এবং নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের রাখা হবে। তবে শরিকদের আসনে নৌকার প্রার্থী থাকছে কি থাকছে না, সেটি স্পষ্ট করা না হলেও গুঞ্জন রয়েছে, ছাড় দেওয়া আসনগুলোতে এবারও নৌকার প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিতে বলা হতে পারে। ফলে অর্ধশতাধিক আসনে আবারও নৌকা পেয়েও হারাবেন আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় স্থান পাওয়া প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কিছুটা নির্ভার থাকলেও আবারও হতাশা অপেক্ষা করছে নৌকার মাঝিদের জন্য।