ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সোচ্চার হবে বাংলাদেশ

কাওসার রহমান

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ৫ নভেম্বর ২০২২

সোচ্চার হবে বাংলাদেশ

এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন বিশ্বজুড়েই চলছে জলবায়ু পরিবর্তনের তাণ্ডব

এ বছর ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন বিশ্বজুড়েই চলছে জলবায়ু পরিবর্তনের তাণ্ডব। বৈরী প্রকৃতির কারণে এক অস্থির সময় পার করছে গোটা বিশ্ব। এশিয়া থেকে আমেরিকা, আফ্রিকা থেকে ইউরোপ পৃথিবীর কোন অঞ্চলই প্রকৃতির রুদ্র রোষানল থেকে বাদ যাচ্ছে না। ইউরোপে তাপমাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। বন্যা, খরা, দাবানল, তাপপ্রবাহ এ বছর আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

এমনই এক অস্থির সময়ে এ বছরের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের ২৭তম আসর আজ রবিবার থেকে বসছে আফ্রিকার দেশ মিসরের শার্ম আল শেখ শহরে। এ সম্মেলনে জলবায়ু অধিকার কর্মীদের বিক্ষোভে উত্তাপ ছড়াবে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো থেকেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ক্ষতিপূরণের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ সরকার এবং সুশীল সমাজও নিজস্ব দাবি নিয়ে আওয়াজ তুলবে এবারের সম্মেলনে।

বাংলাদেশের মূল দাবি হবে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর। অর্থায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রশমনের পরিবর্তে অভিযোজন তথা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য বেশি অর্থায়নের দাবি তুলবে। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠনের দাবি জানানো  হবে।

সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে এবারের সম্মেলনে তিনটি দাবি তোলা হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে শুধু প্রতিশ্রুতি দিলেই হবে না তা অর্জন করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রকৃতির এই ভয়াবহ দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠন করতে হবে। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্পোন্নত দেশগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তাই এই দেশগুলোর অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হবে। সেই অর্থ ঋণ হিসাবে নয়, অনুদান হিসাবে দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক সুশীল সমাজ বা জলবায়ু অধিকার সংগঠনগুলোও এবার একাট্টা থাকবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধ্বংসলীলা নিয়ে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জলবায়ু ন্যায্যতার জন্য সুস্পষ্টভাবে তিনটি দাবি তুলে ধরবে সম্মেলনে। দাবিগুলো হলো, কার্বন নির্গমন কমানোর টার্গেট বাড়াও এবং তা অর্জন কর, জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবিলায় লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠন কর এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে অতিরিক্ত সহায়তা প্রদান কর।  
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআরডি) প্রধান নির্বাহী মো. সামসুদ্দোহা বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উন্নত দেশগুলো এই উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু তারা তাদের সেই প্রতিশ্রুতি পালন করছে না। বিশ্বব্যাপী চলমান এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে কার্বন নির্গমন হ্রাসের প্রতিশ্রুতি বাড়াতে হবে। এবং সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে ১৯০টি দেশ কয়লার ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে উন্নত দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে কয়লা থেকে বেরিয়ে আসা এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই কয়লা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সামসুদ্দোহা বলেন, এবারের জলবায়ু সম্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে দাবিটি জোরে উচ্চারিত হবে তা হলো- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সহায়তার জন্য লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠন করতে হবে। এছাড়া কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে স্বল্পোন্নত দেশগুলো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তাই এই দেশগুলোর জলবায়ু অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য অতিরিক্ত সাহায্য দিতে হবে। এই সাহায্য ঋণ হিসাবে নয়, অনুদান হিসাবে দিতে হবে। ঋণ হিসাবে দিলে এই দেশগুলোর ঋণের দায় আরও বেড়ে যাবে।       
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণার জন্য বিভিন্ন দেশের গবেষকদের নিয়ে গড়া জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি)-ও বিশ্বব্যাপী চলমান প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনে জোড়াল ভূমিকা রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সংস্থার চেয়ার হোয়েসাং লী সম্মেলনে এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য রাখবেন। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অভিযোজন কর্মসূচীর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদাটি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে তুলে ধরবেন।  
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখ যায়, বর্তমানে বিশ্বের দেশগুলো যে জলবায়ু নীতি অনুসরণ করছে, তাতে এই শতাব্দী শেষে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন গড়ে ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে কোনো অগ্রগতি নেই।

ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বেঁধে দেয়া সীমা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এখন ভেস্তে যাওয়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। তাই মিসরের ‘শার্ম আল-শেখ’ এ জাতিসংঘের ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামিয়ে এনে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতিতে পৌঁছার চেষ্টা  চালাতে হবে।
জাতিসংঘের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গত বছর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনের পর থেকে বিশ্বের দেশগুলোর সরকারের কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনায় দুঃখজনকভাবে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়নি। এ পরিস্থিতিতে জরুরিভিত্তিতে সমাজে রূপান্তর ঘটানো গেলেই কেবল বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। গত জলবায়ু সম্মেলনে দেয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক নতুন করে কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে চেষ্টা শুরু হয়েছে তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমবে মাত্র ১ শতাংশেরও কম।

অথচ বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে হলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কমা দরকার। তাই বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সরকারের যে জলবায়ু পরিকল্পনা আছে তাতে আরও গতি সঞ্চার করা না গেলে এ শতাব্দীর শেষ নাগাদই তাপমাত্রা ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে, যা গত বছরের আনুমানিক হিসাবের চেয়ে ০ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উষ্ণায়ন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হয়ে গেলে গোটা বিশ্বজুড়ে মানুষের ওপর এর বিপজ্জনক প্রভাব পড়বে। কিন্তু বিশ্ব এ মুহূর্তে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখার মতো অবস্থায় নেই। গত বছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাগুলোর পর এ বাস্তবতা আরও প্রকট হয়েছে। বিশ্বের দেশগুলো আর্থিক সহায়তা পেলে এবং পরিকল্পনা মাফিক কাজ করলে তাপমাত্রা ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা যেতে পারে।
এর আগে ওয়ার্ল্ড মিটিয়োরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন বা ডব্লিউএমও-র নেতৃত্বে তৈরি এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, জলবায়ু বদলের কথা চিন্তা করলে একেবারেই ভুল দিকে এগোচ্ছে বিশ্ব। লাগাম টানা সম্ভব হয়নি গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্বেও। কোভিড লকডাউনের সময় নিঃসরণ কমলেও, ২০১৯ সালের প্রথমার্ধের তুলনায় চলতি বছরের প্রথমার্ধে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বেড়েছে ১.২ শতাংশ।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, কঠোরভাবে লাগাম না টানতে পারলে এই শতাব্দীর শেষে ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে বিশ্বের গড় উষ্ণতা। ২০৫০ সালে ১৬০ কোটি মানুষকে বছরে অন্তত তিন মাস ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরমে বসবাস করতে হবে। পাশাপাশি, এ হেন তাপমাত্রায় বদলে যেতে পারে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ুও। ফলে  দেখা দিতে পারে এমন সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যা কেউ কোন দিন চোখে দেখেননি।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেসও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। বলছেন, পরিস্থিতি এমন দিকে এগোচ্ছে যে আমরা অদৃষ্টপূর্ব ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হতে চলেছি। ইউরোপের তাপপ্রবাহ বা পাকিস্তানের বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো ক্রমেই ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলছেন, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অর্থায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ফাইন্যান্সের হিসাবমতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় ৮.৮ থেকে ৯.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের বিষয়টি শাম আল শেখ শহরে আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলনেই বিবেচনায় নিতে হবে।
তিনি বলেন, ধরিত্রীকে বাঁচাতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার ৪৫ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিশ্ব সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করতে হবে।

×