সমুদ্র হক ॥ মায়ের ভাষা বাংলা। এর সঙ্গে যুক্ত আছে আঞ্চলিক ভাষা। বিভিন্ন এলাকার কথোপকথনের এই ভাষা জীববৈচিত্র্যের মতো ভাষাবৈচিত্র্য এনে দিয়েছে। রাজধানী ঢাকায় বাস করেন দেশের ৬৪ জেলার মানুষ। এ ছাড়াও ৬৪টি জেলায় চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য লেখাপড়াসহ নানা কারণে বাস করতে হয় বিভিন্ন এলাকার মানুষকে। তাদের ঘরের কথাবার্তা সাধারণত আঞ্চলিক ভাষা। ঘরের বাইরের কথাবার্তা শুদ্ধ প্রমিত ভাষা। আবার নিজের এলাকার মানুষের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত আলাপ পরিচয়ের পরই হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা চলে আসে শুধু আঞ্চলিকতা তথা এলাকার ভাষার কারণে। বাঙালীর আঞ্চলিক ভাষার মহিমান্বিত রূপ চেতনায় হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যায়। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মা নিজের এলাকার ভাষা দিয়েই চুমু দেয় সন্তানকে। আঞ্চলিক ভাষাটিও মায়ের ভাষা!
বিভিন্ন এলাকার জনগোষ্ঠীর প্রবীণ ব্যক্তিগণ যেমন দাদা-দাদি, নানা-নানি বয়স্ক ব্যক্তি আঞ্চলিক ভাষায কথা বলেন। শিশুদের মা বাবা এই ভাষা বোঝে। ঘরে এই ভাষা ব্যবহার হয়। শিশু কিশোররা ব্যবহার করে। বাংলা উইকিপিডিয়ায় ১৮ ভাষার একটি তালিকা আছে। সেগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক ভাষার তালিকা নেই। দেশে মাতৃভাষায় কথা বললেও আর্থ সামাজিক পেশাগত সুবিধার জন্য শিক্ষাদান, লেখালেখি জ্ঞান চর্চায় শুদ্ধ ও প্রমিত বাংলা ও ইংরেজী ভাষা গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব কারণে বিপন্ন হয়ে পড়ছে আঞ্চলিক ভাষা। অভিমত হলো : দেশে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নির্দিষ্ট এলাকা কেন্দ্রিক। পাশর্^বর্তী দেশ ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো উন্নত দেশেও একই অবস্থা। বাংলাদেশে আঞ্চলিক ভাষার গবেষণা নেই।
ভাষাবিদ ড. ত্বাইফ আল মামুন বলেন, আঞ্চলিক ভাষা বাঁচিয়ে রাখতে হলে ভাষার প্রামাণ্যকরণ খুবই প্রয়োজন। একটি ভাষাকে ডিজিটাল ডকুমন্টেশন করা গেলে ওই ভাষা টিকে থাকবে। আঞ্চলিক ভাষার বিন্যাসে আন্তর্জাতিক পরিম-লে সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। ডিজিটাল সফটওয়্যার মডেল, নাটক, সিনেমা, গান মঞ্চের অনুষ্ঠান তৈরি করা যেতে পারে।
দেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও আঞ্চলিক ভাষা জরিপ হয়নি। এক সূত্র জানায়, বাংলা একাডেমি ১৯৬২ সালে আঞ্চলিক ভাষার জরিপের উদ্যোগ নেয়। ওই সময়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র উদ্যোগ ছিল ব্যাপক। তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন আঞ্চলিক ভাষা তার নিজস্ব পরিম-লে বড় অবদান নিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাক। বাংলা একাডেমির উদ্যোগ কার্যক্রম শুরুর পরই তিনি জরিপের প্রশ্নমালা তৈরি করে দেন। বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে এই কার্যক্রম জানিয়ে কর্মযজ্ঞে স্থানীয়দের অন্তর্ভুক্তির জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. মুহম্মদ আব্দুল কাইউম প্রশ্নমালার ভিত্তিতে তিনটি থানা (বর্তমানে উপজেলা) জরিপ করেন। ওই সময়ে ড. কাইউম বাংলা একাডেমির সঙ্কলন বিভাগের সহকারী অধ্যক্ষ ছিলেন। প্রায় পাঁচ যুগ আগের সেই কার্যক্রম কিছুকাল পরই মুখ থুবরে পড়ে। সফলতার মুখ আর দেখেনি।
বর্তমানে বাংলা একাডেমির পাশপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভাষার বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করছে। আঞ্চলিক ভাষা রক্ষায় তাদের কোন কার্যক্রম নেই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার কোন অভিধান কোষ নেই। এই কাজেও কেউ এগিয়ে আসছেন না। তবে বর্তমানের বিভিন্ন টিভি চানেলে এবং ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্মে (ইউটিউব) বৃহত্তর পাবনা রাজশাহী নোয়াখালী বরিশাল ময়মনসিংহ কুমিল্লা পুরান ঢাকা ও কয়েকটি অঞ্চলের ভাষায় নাটক ও ধারাবহিক নাটক প্রচারিত হচ্ছে। এইসব নাটকের সংলাপ ভাষা বৈচিত্র্যে বড় ভূমিকা রাখছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে অনেক সময় বক্তব্যের প্রয়োজনে ব্যক্তির কথ্য ভাষা (আঞ্চলিক ভাষা) তুলে ধরা হয়। আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্যে স্বল্প পরিসরে এগিয়ে যাচ্ছে গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-। যাদের গবেষণা করে প্রায়োগিক কৌশল নিয়ে অভিধান তৈরির কথা বিশেষ করে বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তারা কেউ এগিয়ে আসছে না।