
মোরসালিন মিজান ॥ তেঁতুল গাছ, শুনে যে কেউ চোখ কপালে তুলবেন, ৩শ’ বছর পর্যন্ত বাঁচে! উপকারী অনেক বৃক্ষ এত লম্বা সময় টেকে না। কী আশ্চর্য, তেঁতুল গাছ টেকে। এ গাছের চারা সচেতনভাবে রোপণ করা হয় না। শখের বাগানে গাছটি একরকম অবাঞ্ছিত। স্থান হয় না বললেই চলে।
তেঁতুল গাছ অনেকটা বন্য প্রজাতির। একবার টিকে গেলে এর বৃদ্ধি ঠেকানো কঠিন হয়ে যায়। ওপরের দিকে বাড়তে বাড়তে, ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে এক সময় জঙ্গলে পরিণত হয়। এ জঙ্গলের জন্য উদার আকাশটা ঠিকমতো দেখা যায় না। শুধু কি তাই? শেওড়া এবং তেঁতুল গাছে নাকি ভূতও থাকে। সুযোগ পেলেই সে মানুষের ঘাড় মটকে দেয়। গাছ হয়েও তাই এটি গাছের মূল্য পায় না। তেঁতুলের ফলকেও ঠিক ফলের মূল্য দেয়া হয় না। আম জাম কাঁঠালের মতো সুস্বাধু নয় এটি। দেখতে অনেকটা বিষ্ঠার মতো। আর খেতে ভীষণ টক। সতর্ক করে বলা হয়ে থাকে, খেলে গায়ের রক্ত পানি হয়ে যাবে।
তবে যতই সতর্ক করা হোক না কেন, তেঁতুল দেখলেই কারও কারও জিবে জল চলে আসে। লালা ঝরে। পাকা তেঁতুল বিক্রি হয় রাস্তার ধারে। খোলা অবস্থায় বিক্রি করায় তাতে ময়লাও জমে প্রচুর। ঘাপটি মেরে থাকে জীবাণু। স্কুলের অবুঝ মেয়েরা অতো বুঝতে চায় না। সুযোগ পেলেই কিনে খায়। যে কারণেই হোক, বড়রাও খান তেঁতুল। যারা সরাসরি আঙ্গুলে নিয়ে চেটেপুটে খেতে পারেন না তারা জুস বানিয়ে খান। তেঁতুলে, হ্যাঁ, জুস হয়। দোকানে পাওয়া যায়। টক ফলের বাজার তাই বেশ ভাল। এ কারণে হয়তো কবিকেও লিখতে হয়, ‘তেঁতুল পাতা তেঁতুল পাতা, তেঁতুল বড়ো টকরে/তোমার সাথে প্রেম করিতে আমার বড়ো শখরে...।’ ফলটির প্রতি নারীদের দুর্বলতা সহজাত। নারীরা যেমন তেঁতুল খান, তেমনই তেঁতুল কখনও কখনও গিলে খেতে উদ্যত হয় নারীকে!
গাছের কথায় ফিরে যাই, তেঁতুল গাছ বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে বেশি দেখা যায়। শহরে যে নেই তা নয়। এমনকি রাজধানী শহরেও কম বেশি আছে। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ভবনের সামনে আছে একাধিক তেঁতুল গাছ। ফল এখনও দৃশ্যমান হয়নি। তবে তার পূর্বের অবস্থাটি এখন চলছে।
গাছের তেঁতুলে কিছু উপকারও হয়। ব্যবহার জানলে উপকার পেতে পারেন আপনিও। সে কথা জানিয়ে পুষ্টিবিদরা বলছেন, তেঁতুলে আছে ভেষজ ও পুষ্টিগুণ। হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে খুব উপকারী। দেহে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। রক্তে কোলস্টেরল কমায়। শরীরের মেদ কমাতেও কাজ করে তেঁতুল। এতে টারটারিক এসিড থাকায় খাবার হজমে সহায়তা করে। তেঁতুলের জুস পেটের বায়ু, হাত-পা জ্বালায় কার্যকর পথ্য। তাই তিন-চার দানা পুরনো তেঁতুলের এক কাপ রসের সঙ্গে চিনি বা লবণ মিশিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ভেষজ চিকিৎসকরা। তেঁতুল গাছের বাকলেও উপকার আছে। শুকনো বাকলের প্রলেপ ক্ষতস্থানে লাগালে ক্ষত সারে। ছাল চূর্ণ করে তৈরি রস হাঁপানি ও দাঁত ব্যথায় কাজ দেয়। তেঁতুল পাতারও আলাদা গুণ। এর রস কৃমিনাশক ও চোখ ওঠা রোগে কাজে আসে। মুখে ঘা বা ক্ষত হলে পাকা তেঁতুল জলে কুলকুচি করলে উপকার পাওয়া যায়। বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরানো ও রক্তের প্রকোপে তেঁতুল উপকারী। কাঁচা তেঁতুল গরম করে আঘাত পাওয়া স্থানে প্রলেপ দিলে ব্যথা সারে। পুরনো তেঁতুল খেলে আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেট গরমে উপকার পাওয়া যায়। পাকা তেঁতুলে খনিজ পদার্থ সব ফলের চেয়ে অনেক বেশি বলে জানা যায়।
গবেষণা বলছে, তেঁতুলে খাদ্য শক্তির পরিমাণ নারিকেল ও খেজুর ছাড়া সব ফলের চেয়ে বেশি। ক্যালসিয়ামের পরিমাণ সব ফলের চেয়ে ৫ থেকে ১৭ গুণ বেশি। আয়রনের পরিমাণ নারিকেল ছাড়া সব ফলের চেয়ে ৫ থেকে ২০ গুণ বেশি। অন্যান্য পুষ্টি উপাদান স্বাভাবিক পরিমাণে আছে। সব মিলিয়ে তেঁতুলকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা মুশকিল। ফলটি, হ্যাঁ, খান। তবে তার আগে এটি জীবাণুমুক্ত কিনা, নিরাপদ কিনা, নিশ্চিত হয়ে নিন। তা না হলে তেঁতুল উল্টো আপনাকেই গিলে খাবে!