স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার রূপনগরে বেলুন ফোলানোর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহাদ নামের আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ৭ শিশুর মৃত্যু হলো। চিকিৎসাধীন সাতজনের মধ্যে মিজান নামের এক শিশুকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তার অবস্থা রীতিমতো সঙ্কটাপন্ন। বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সরকারী বা বেসরকারী তরফ থেকে কোন সহায়তা পাননি বলে হতাহতদের পরিবারের দাবি। এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব রয়েছে।
৩০ অক্টোবর বুধবার বিকেল পৌঁনে চারটার দিকে ঢাকার রূপনগর শিয়ালবাড়ি বস্তির তিন রাস্তার মোড়ে বেলুন ভরার গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই পাঁচজনের মৃত্যু হয়। তারা হচ্ছে, ফারজানা (৭), নুপুর (১১), রুবেল (১০), রমজান (৮) ও শাহিন (৯)। ওইদিনই রাতে জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সাবেক পঙ্গু হাসাপাতাল) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরেক শিশু রিয়া (১০)। বিস্ফোরণে অন্তত ২৫ জন আহত হয়। আহতদের অধিকাংশই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন মোট সাতজন।
ঘটনার দিনই দিবাগত রাত একটার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরেক শিশু নিহাদ (৯)। তার পিতার নাম শরু মিয়া। বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ থানায়। সে পরিবারের সঙ্গে রূপনগরের শিয়ালবাড়ির ১২ নম্বর সড়কে পরিবারের সঙ্গে থাকত। বিস্ফোরণে নিহাদের দুই চোখ গলে গিয়েছিল। নিহাদ স্থানীয় একটি ব্র্যাক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিল। চার ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল সে।
নিহত ফারজানার বড় বোন আয়শা জনকণ্ঠকে জানান, তাদের পিতার নাম আবু তাহের। বাড়ি ভোলার সরদার বাড়ি গ্রামে। তারা পাঁচ বোন। ফারজানা ছিল সবার ছোট। তারা মাকে নিয়ে শিয়ালবাড়ি বস্তিতে থাকে।
নিহত নুপুরের বড় বোন সুমাইয়া জনকণ্ঠকে জানান, তাদের পিতার নাম নুর আলম। বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনে। নুপুর ছিল মেজো। তার ছোট একটি ভাই আছে। সে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে।
নিহত রুবেলের দাদি খাদিজা বলছিলেন, রুবেলের পিতার নাম নুর ইসলাম। মায়ের নাম পারভিন। বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনের নুরাবাদের দোলারহাট গ্রামে। রুবেলরা চার ভাই। রুবেলের ছোট ভাই বছর দু’য়েক আগে পানিতে পড়ে মারা গেছে।
রূপনগর থানার উপ-পরিদর্শক সুমন বণিক জনকণ্ঠকে জানান, নিহত রিয়ার পিতার নাম মিলন মিয়া। বাড়ি নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার বাউশ গ্রামে। নিহত রমজানের পিতার নাম বদরুল মিয়া। নিহত শাহীনের পিতার নাম শাহজাহান মিয়া।
এদিকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আহতদের মধ্যে মিজানের (৬) অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ঢামেক হাসপাতালের আবাসিক সার্জন মোহাম্মদ আলাউদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, দগ্ধ ও আহত মোট সাতজন তাদের কাছে চিকিৎসাধীন। তার মধ্যে মিজানকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তার অবস্থা মারাত্মক সঙ্কটাপন্ন। মিজানের পেটের নারী ভুড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল। মাথায় মারাত্মক আঘাত পেয়েছে।
এছাড়া গ্যাস বেলুন বিক্রেতা আবু সাঈদ (২৯), মোস্তাকিম (৯), স্থানীয় বাসিন্দা জুয়েল (২৫), জান্নাত (২৫), জনি (১০) ও সিয়াম (১১) চিকিৎসাধীন। তারা আপাতত আশঙ্কামুক্ত। তবে ভবিষ্যতে কোনদিকে যায় সেটি বলা মুশকিল। কারণ গ্যাস বেলুন ফুলানোর জন্য যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে সেটি ক্ষতস্থানের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
পুলিশ জানায়, ইতোমধ্যেই ঢামেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগে পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বেলুন বিক্রেতা আবু সাঈদকে। বিস্ফোরণে সাতজনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় সাঈদকে আসামি করা হয়েছে। ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। সাঈদের ডান হাতের আঙুল থেতলে গেছে। পেট ঝলসে গেছে এবং পায়ে আঘাত পেয়েছে।
আহত অন্যদের মধ্যে জুয়েলের হাত ভেঙ্গে গেছে। সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন জান্নাতের ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এছাড়া তার দেহের বিভিন্ন স্থানে আঘাত লেগেছে। জনির মুখমন্ডল পুড়ে গেছে। দাঁত পড়ে গেছে।
এদিকে আহত শিশু সিয়ামের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা দেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মুখ পুড়ে গেছে। সে ঢামেকের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। সিয়ামের পিতা সবজি বিক্রেতা তোফাজ্জল। বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার জয়পুর গ্রামে। চার সন্তানের মধ্যে সিয়াম তৃতীয়। পরিবারের সঙ্গে রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে থাকত। সে স্থানীয় এ্যাডাম স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। আগামী ১৭ নবেম্বর তার পিইসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা। সিয়াম বস্তির সামনে দিয়ে হেঁটে রূপনগরের একটি কোচিং সেন্টারে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে।
বার্ন ইউনিটের সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের জানান, সিয়ামের মুখমন্ডল ঝলসে গেছে। তার শরীরের পাঁচ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাকে আপাতত হাসপাতালেই থাকতে হবে। তবে সিয়াম শঙ্কামুক্ত।
ঘটনার দিনই দিবাগত রাত তিনটার দিকে পুলিশ বাদী হয়ে গ্যাস বেলুন বিক্রেতা সাঈদকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। রূপনগর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, বেলুন বিক্রেতা আবু সাঈদের বিরুদ্ধে অপরাধজনিত নরহত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। মামলা নম্বর-৩০। এদিকে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আহতদের সহায়তার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। তিনি সাংবাদিকদের জানান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের সুযোগ আছে। আবার অনেক এনজিও আছে, তাদেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। সবাই যেন আহতদের সহায়তায় এগিয়ে আসে এজন্য চেষ্টা করছে কমিশন। এটি নিছক একটি দুর্ঘটনা। এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে পরিবারের সদস্যদের সর্বাধিক সচেতন থাকা প্রয়োজন।