ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানসিক চাপ

বিষাদ-পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সংক্রমিত হচ্ছে বড় ধরনের রোগ-ব্যাধি

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৫ মার্চ ২০১৮

বিষাদ-পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সংক্রমিত হচ্ছে বড় ধরনের রোগ-ব্যাধি

সমুদ্র হক ॥ মেন্টাল স্ট্রেস (মানসিক চাপ) বেড়েছে। বাড়ছে বিষাদগ্রস্ততা (ডিপ্রেসন)। মানবদেহের ভিতরে এ অবস্থা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে বড় ধরনের জটিল রোগ ব্যাধিতে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে ভয়াবহ পরিণতির দিকে। সর্বশেষ পরিণতি মৃত্যু। বলা হয়, দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। অবশ্য মানসিক চাপে এই আয়ু কতটা কমছে তার কোন হিসেব নেই। বিশ্বজুড়ে মানুষের মানসিক চাপ ও বিষাদ বেড়েছে। বাংলাদেশে এই অবস্থা বেশি। এক তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে প্রতি এক শ’ জনে ছয় জনেরও বেশি মানসিক চাপ ও বিষাদগ্রস্ত রোগে আক্রান্ত। তবে এই সংখ্যা যে আরও বেশি তার প্রমাণ মেলে বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপচারিতায়। যেমন- আপনি কাউকে জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছেন? তিনি দ্রুত ‘ভালো’ শব্দটি উচ্চারণ না করে কিছুটা সময় নিয়ে বলবেন ‘ভা-লো’। ভালই তো আছি। এই ‘কিছুটা সময়’ নিজের মধ্যে ধরে রাখা প্রমাণ করে কত কষ্টে সে ভাল কথাটি বলছে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই ‘পজ’ (বিরতি) দিয়ে পজিটিভ উত্তর দেয়াটিই মেন্টাল স্ট্রেস ডে’র সঙ্কেত দেয়। যা তাকে ধুঁকে ধুঁকে কুড়ে খায়। কাঠের ভিতরে উঁইপোকা ঢুকে যেমন ঘুন ধরিয়ে দেয় এই মেন্টাল স্ট্রেস মানব দেহের বড় ঘুনপোকা। যা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষায়িত কোন ব্যবস্থা নেই। মানসিক চাপ ও বিষাদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক রোগী মনে করা হয়। একজন চিকিৎসক বললেন-এ ধরনের ব্যক্তিকে স্বজন ও কাছের বন্ধুদের মধ্যে সামাজিক পরিম-লে রেখে কাউন্সিলিং করা দরকার। যে রোগের উৎপত্তি মনের গভীর থেকে সেখানে ওষুধ তেমন কাজ করে না। ‘স্ট্রেস’ মুক্ত হলে এই রোগের কিছুটা উপশম হয়। তারও আগে দরকার মানসিক চাপের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা। এই কারণের সমাধান হলে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেকটাই সুস্থ হয়ে মানসিক চাপ মুক্ত হতে পারেন। ব্যক্তি জীবনে, সামাজিক জীবনে, চাকরি জীবনে, কর্মজীবনে নানাভাবে এই চাপ আসতে পারে। বিষাদগ্রস্ত ও মানসিক চাপের ব্যক্তিদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে দীর্ঘ সময় বসে সময় কাটায়। তারা অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। একটা সময় এই ফেসবুকও তাদের চাপ ও বিষাদ কমাতে পারে না। তারা ইনসমোনিয়ায় (অনিদ্রা) আক্রান্ত হয়। তখন কোন ট্রায়ংকুলাইজার (ঘুমের ওষুধ) কাজ করে না। মানসিক চাপ বিষাদগ্রস্ততা ও অনিদ্রা থেকে হৃদয় কম্পন (পালস) বেড়ে গিয়ে নানা রোগের সৃষ্টি হয়। অল্প দূরত্বে হাঁটলে, সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার সময় হাসফাঁস করা, উচ্চ রক্তচাপ, এ্যাসিডিটি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। একটা পর্যায়ে কোন কাজেই মন বসে না। সকল খাবারেই অরুচি ধরে। স্মৃতি শক্তি কমতে থাকে। এগিয়ে যায় জীবনের শেষ স্টেশনের দিকে। বিষাদগ্রস্ততার অনেক কারণ থাকতে পারে এমনটি উল্লেখ করে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সকল কারণের সঙ্গেই থাকে মানসিক চাপ ও তা থেকে মানসিক ধাক্কা। এই চাপ ও ধাক্কা যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে তখন চারপাশে নানা রোগব্যাধি জড়ো হতে থাকে। যার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) ডিপ্রেশন এ্যান্ড আদার কমন মেন্টাল ডিসঅর্ডারস গ্লোবাল হেলথ স্টিমেট শিরোণামে প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বজুড়ে বিষাদগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের ২শ’ কোটিরও বেশি মানুষ এই রোগে ভুগছে। যা উদ্বেগজনক পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ মানসিক চাপ, বিষাদগ্রস্ততা উদ্বেগজনক অস্থিরতায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ভারতে বিষাদগ্রস্ততার হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ভুটানে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বিষাদগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে কম পূর্ব তিমুরে মাত্র ৩ শতাংশ। ১৯৯০ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউিট অব হেল্্থ মেট্রিক্স এ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে গবেষণা করছে। তাদের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথ্য উপাত্ত সমন্বয় করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিষাদগ্রস্ত মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন এমন একজন চিকিৎসক বলেন, আর্থ সামজিক কারণে অনেকে মানসিক চাপে আক্রান্ত হন। অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা, অবহেলার শিকার, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, বঞ্চিত হওয়া, বঞ্চনা, সন্দেহসহ পারিবারিক ও সামাজিক নানা অবস্থানগত কারণে মানসিক চাপ বিষাদগ্রস্ততায় আক্রান্ত হচ্ছে নারী মানুষ। যে কোন মানুষই এই রোগের আওতায় পড়তে পারে। অনেক সময় বিষাদগ্রস্ততার জন্য জিন বা বংশগত দায়ী। মানসিক চাপে থাকা মানুষের কোন কিছুতেই আনন্দ থাকে না। তারা কাজে উদ্দীপনা পায় না। দিনে দিনে অন্তর্মুখী বা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়। বাইরের কোন কিছুতেই এরা মন বসাতে পারে না। ফেসবুক এদের সাময়িক স্বস্তি দেয় ঠিকই, তবে তাতে থাকে অস্থিরতা। এক সময় তাও মিলিয়ে যায়। এই বিষয়ে একজন চিকিৎসক বলেন, রাত জাগাটা তাদের জন্য বিপদের ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। অনেক সময় বিষাদগ্রস্ত মানুষের শরীরে জ্বালাপোড়া দেখা দেয়। বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে যে বিনিয়োগ তাতে এই রোগের চিকিৎসা সেবা দেয়া কঠিন।
×