স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপির বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে দলটির জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপেও বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাসের বিষয়টি উঠে এসেছে। আর জরিপ প্রকাশের পর বিএনপি শিবিরে হতাশা নেমে এসেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয় এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ শতকরা ৩৮ ভাগ, বিএনপি শতকরা ৫ ভাগ ভোট পাবে। এদিকে শনিবার দুপুরে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দেশে এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ শতকরা ৩৮ ভাগ, বিএনপি শতকরা ৫ ভাগ ভোট পাবে বলে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের দেয়া জরিপ প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ জরিপ প্রত্যাখ্যানের কথা জানান।
প্রসঙ্গত : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে ক্ষমতায় এলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে। এমতাবস্থায় ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিন সহিংস আন্দোলন করে জনমনে বিএনপি একটি চরম ঘৃণিত রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। সে আন্দোলনে পেট্রোলবোমাসহ ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও করে ২ শতাধিক মানুষ হত্যাসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করায় দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও বিএনপি একটি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিতি পায়। এসব কারণে বর্তমানে সর্বস্তরে দলটির নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে।
উল্লেখ্য, একই সংস্থা ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জরিপ রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল আওয়ামী লীগ ৩৮ ভাগ এবং বিএনপি ৩৫ ভাগ ভোট পাবে। অবশ্য ওই জরিপের আগেই বিএনপি পরাজয়ের আশঙ্কায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। তাই এবারের জরিপে বিএনপির জনপ্রিয়তায় ধস নামার চিত্র ফুটে ওঠায় পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি অংশ নেবে কি না এ নিয়ে পর্যবেক্ষক মহলে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে।
বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশ, ধর্মান্ধতা ও উগ্রবাদ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা নিয়ে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল জরিপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইউএসএইড ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইউকেএইডের সহায়তায় ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গত ২৩ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই জরিপ পরিচালনা করে। ইন-হাউস কম্পিউটার এ্যাসিসট্যান্ড টেলিফোন সার্ভে সিস্টেমের মাধ্যমে ১ হাজার ৪৫৩ জনের ওপর এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেলিফোনের মাধ্যমে সাক্ষাতকার নিয়ে পরিচালিত ওই জরিপে নারী-পুরুষ, গ্রাম ও শহর এবং সাতটি বিভাগের মানুষের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ জরিপ রিপোর্ট অনুসারে দেশে উগ্রবাদী সন্ত্রাসবাড়লেও জঙ্গীবাদ দমনে সরকার সফল বলে মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ। তবে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সুযোগ কমেছে।
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপ অনুসারে ৩৫ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়ার জন্য কোন রাজনৈতিক দলের নাম বলতে চাননি, যেটি ২০১৪ সালের জরিপে ছিল ৫ শতাংশ। জরিপে বলা হয়, আজ যদি নির্বাচন হয় তাহলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পাবে ৩৮ শতাংশ ভোট। আর বিএনপি পাবে ৫ শতাংশ ভোট। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি ১ শতাংশ ও জামায়াত পাবে ২ শতাংশ ভোট। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পরিচালিত ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে আওয়ামী লীগ ৩৮ শতাংশ এবং বিএনপি ৩৫ শতাংশ ভোট পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এবার আওয়ামী লীগের ভোট একই থাকলেও বিএনপির ভোট ৫ শতাংশে নেমে গেছে বলে জরিপে বলা হয়।
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে বলা হয়, গত জুলাই মাসে গুলশানে ভয়াবহ জঙ্গী হামলার পরও দেশ সঠিক পথে চলছে বলে মনে করেন দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ। ৬ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে উড্রো উইলসন সেন্টারে এক প্যানেল আলোচনায় জরিপের ফলাফল নিয়েও পর্যালোচনা করা হয়। ওই আলোচনায় প্যানেল আলোচক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো লিসা কার্টিস বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃতিত্ব পাওয়ার দাবিদার। তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মতপ্রকাশের সুযোগ সীমিত হওয়ার বিষয়টি ব্যর্থতা হিসেবে দেখেন তিনি। তার মতে, ধর্মান্ধ শক্তিগুলো নতুন মেরুকরণ হওয়া রাজনৈতিক পরিবেশে বিকশিত হয়।
জরিপে দেখা যায়, জঙ্গীবাদকে এককভাবে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে করেন দেশের ২৪ শতাংশ মানুষ। জঙ্গী হামলা প্রতিরোধে সরকার চমৎকার কাজ করছে বলে মনে করেন ৭৭ শতাংশ মানুষ। জরিপে অংশ নেয়া ৩৮ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে নিজেদের স্বাধীন বলে মনে করেন না। ৫৪ শতাংশ মানুষ অবশ্য মনে করেন, তারা স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক মতপ্রকাশ করতে পারেন।
এদিকে দেশে এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ শতকরা ৩৮ ভাগ, বিএনপি শতকরা ৫ ভাগ ভোট পাবে বলে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের দেয়া জরিপ প্রত্যাখান করেছে বিএনপি। শনিবার সকালে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির পক্ষে দলের মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জরিপ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, বিএনপির ৫ ভাগ ভোট পাওয়ার জরিপ হাস্যকর ।
রিজভী বলেন, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশ, ধর্মান্ধতা. উগ্রবাদ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা নিয়ে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের যে জরিপ পরিচালিত হয়েছে তা কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। জরিপের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে রিজভী বলেন, এ জরিপটি শুধু হাস্যকরই নয়, সত্যের অপলাপ মাত্র।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, জরিপকারীরা কীভাবে ডাটা, স্ট্যাটিস্টিকস, স্যাম্পলিংসহ তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করেছেন তা তারাই জানেন। তবে এটা গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ। তাই বাস্তবের সঙ্গে এই জরিপের বিন্দুমাত্র মিল নেই। বিএনপি মনে করে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দখল ও কেড়ে নেয়া ভোটকেন্দ্রগুলো একতরফা সিল মারার যে তামাশা দেশবাসী দেখেছে, সেই নির্বাচনের সরকারী পরিসংখ্যানটি ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপের তথ্যের প্রধান উৎস।
রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই জানা-অজানা সন্ত্রাস সমাজদেহকে থেঁতলে দিয়েছে। অন্ধ ধর্মীয় জঙ্গীবাদের উত্থান এদের আমলেই হয়েছে। তিনি বলেন, ৯০-এর দশকের শেষ ৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশবাসী নতুনরূপে সহিংস সন্ত্রাসের আবির্ভাব দেখেছে। যশোরে উদীচীর বোমা হামলায় প্রকৃত সন্ত্রাসীদের আড়াল করে বিএনপি নেতাদের নামে মামলা দেয়া হয়েছিল। পরে হুজি বা হরকাতুল জেহাদ নামে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন এই নারকীয় ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার করে। এভাবে তখন থেকে এ পর্যন্ত এই অন্ধ জঙ্গী সংগঠনগুলো কর্তৃক সংঘটিত প্রাণবিনাশী ঘটনাগুলোর প্রকৃত তদন্ত করে আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করে পাকড়াও না করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দায় চাপানো হয়েছে।
বিএনপির মুখপাত্র রিজভী বলেন, দেশে মানবাধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির কারণে দেশজুড়ে খুনের উৎসব চলছে। নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণের পর হত্যা, বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, একের পর এক গুমের হিড়িক, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় আজ নিত্য দিনের ঘটনা।
রিজভী বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে বিরোধী দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মামলা দিয়ে বিচারের নামে হয়রানি করা হচ্ছে। আর ঘাটে-মাঠে-নদী-নালায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে থাকাসহ অসংখ্য বিভৎস অমানবিক ঘটনা ঘটে চলছে। এমন একটি সরকার জনসমর্থনে এগিয়ে থাকবে সেটা শুধু গণতন্ত্রহারা দেশের মানুষকে উপহাস করাই নয়, বরং এই জরিপটি যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ তা সহজেই অনুমেয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, সহ-দফতর সম্পাদক বেলাল আহমেদ, মনির হোসেন প্রমুখ।