ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বইয়ের ঘ্রাণে স্বপ্ন গড়ছে মেহেরুননেসা মিম

আবু রায়হান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী

প্রকাশিত: ১২:১২, ২৮ মে ২০২৫

বইয়ের ঘ্রাণে স্বপ্ন গড়ছে মেহেরুননেসা মিম

ছবি- দৈনিক জনকণ্ঠ

"তোকেই বুঝি বই বেচে খেতে হবে?" একটা মেয়ের স্বপ্ন যখন সমাজের রূঢ় প্রশ্নে ধাক্কা খায়, তখন অনেকেই পিছিয়ে যায়। কিন্তু মেহেরুননেসা মিম থামেননি। দৃপ্ত কণ্ঠে উত্তর দিয়েছেন, “হ্যাঁ, আমি বই বেচেই খেতে চাই। আমি জ্ঞান বিতরণ করতে চাই।” এই কথার মধ্যেই যেন তার সাহস, স্বপ্ন আর সংগ্রামের গল্প লুকিয়ে আছে।

নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার বৃ-চাপিলা গ্রামের মেয়ে মিম বেড়ে উঠেছেন এক এমন পরিবেশে, যেখানে বিদ্যুতের আলো আসেনি বহু বছর। সেই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে হাঁটা শুরু তার ছোটবেলা থেকেই। বই ছিল তার সেই আলোর উৎস। গোপাল ভাঁড়ের গল্প দিয়ে শুরু, এরপর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই তার হাতে পড়ে আরও গভীর ভালোবাসায় রূপ নেয়। সপ্তাহে একটি বইয়ের সদস্যপদ হলেও, বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে এক সপ্তাহে তিন-চারটা বই পড়ে ফেলা ছিল তার অভ্যাস। বইয়ের প্রতি সেই আগ্রহই আজ তাকে নিয়ে এসেছে ভিন্ন এক উচ্চতায়।

বর্তমানে তিনি বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী। রাজশাহীর প্যারিস রোডে বসান নিজ হাতে গড়ে তোলা একটি ভ্রাম্যমাণ বইয়ের দোকান। শুরুটা ২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর, ঢাকার প্রকাশকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাজশাহীতে নিয়ে আসেন বিভিন্ন বই। প্রথম দিনেই বিক্রি হয় ৩৭টি বই। এই সাফল্য তাকে দিয়েছে সাহস, দেখিয়েছে স্বপ্নের পথ।

প্রতিবছর শরৎ উৎসবে একটি বই প্রদর্শনীর ইচ্ছা ছিল মিমের, কিন্তু নানা জটিলতায় সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। তবে সেই ব্যর্থতা নয়, নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। এখন প্রতি শুক্র ও শনিবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত তিনি প্যারিস রোডে বসেন বই নিয়ে। কখনো কখনো সিঅ্যান্ডবি মোড়েও যান, সেখান থেকেও মেলে দারুণ সাড়া।

তার দোকানে আছে অনুবাদ সাহিত্য, ইংরেজি বই, উপন্যাস, থ্রিলার, কিশোর উপন্যাসসহ নানা স্বাদের প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ বই। বই বিক্রিকে তিনি দেখেন না শুধু ব্যবসা হিসেবে, এটা তার কাছে ভালোবাসা আর আনন্দের জায়গা। তিনি বলেন, “মানুষ যখন বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টায়, বইয়ের ঘ্রাণ নেয়, বই ছুঁয়ে দেখে, দাঁড়িয়ে বইগুলোর দিকে তাকায়, এই জিনিসগুলো আমার খুব ভালো লাগে, আমি উপভোগ করি।”

তবে এই পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। সহপাঠীদের কটাক্ষ, ‘এটা দিয়ে কী হবে?’ এসব শুনতে হয়েছে অনেক। তবু হার মানেননি। বলেন, “যদি সাহস না থাকত, যদি কটুকথা গায়ে মাখতাম, তাহলে একজন মেয়ে হয়ে এখানে টিকে থাকতে পারতাম না।”

মায়ের একান্ত সাহচর্য পেয়েছেন, বাবা নিরব দর্শক। হয়তো অন্তরে তিনি মিমের পথকে স্বীকৃতি দেন, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেন না। পরিবারের এমন দ্বৈত প্রতিক্রিয়ার মাঝেও নিজের স্বপ্ন ধরে রেখেছেন মিম। পড়ালেখার চাপে দোকান বন্ধ রাখলেও সেই স্বপ্নে ছেদ পড়ে না। বরং একাডেমিক ও ব্যবসার ভারসাম্য রেখে এগিয়ে চলেছেন নিজের পথ ধরে।

ভবিষ্যতে স্থায়ীভাবে বড় পরিসরে একটি বইয়ের দোকান খোলার পরিকল্পনা তার। শুধু পণ্য নয়, বইকে তিনি ভাবেন মানুষের জীবনে আলো জ্বালানোর হাতিয়ার হিসেবে। মিম বলেন, “বইয়ের মাধ্যমে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে, আরও অনেককে বইয়ের ঘ্রাণে মাতিয়ে তুলতে চাই।”

বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টানো মানুষের হাতে যদি একটুখানি আলো পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটাই মিমের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। ভবিষ্যতে তার স্বপ্ন একটি স্থায়ী বইয়ের ঘর, যেখানে পাঠক আসবেন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে, ভাবনার খোরাক পেতে। মেহেরুননেসা মিম আজ কেবল একজন বই বিক্রেতা নন, তিনি হয়ে উঠেছেন এক অনন্য অনুপ্রেরণা। বইকে জীবনসঙ্গী করে, মানুষের মুখে হাসি ফোটানোকে ব্রত করে মিম এগিয়ে চলেছেন নিজের স্বপ্নপথে। 

মিম প্রমাণ করেছেন তিনি নিজেই এখন এক চলমান প্রেরণার নাম, যিনি বইয়ের পাতায় পাতায় বুনছেন সাহস, সংগ্রাম আর সম্ভাবনার এক অসাধারণ গল্প।

নোভা

×