
মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠা অথৈ জলরাশি বেষ্টিত দেশের দক্ষিণের জনপদ নোয়াখালী। অতি প্রাচীন এই জনপদটির জন্ম। বিশ্লেষকদের মতে, নোয়াখালী জেলার বিচ্ছিন্ন হাতিয়া দ্বীপটি জেগে উঠার পর থেকে এখানে ব্যাপক কৃষি চাষাবাদ এবং মহিষ পালন অধিক লাভজনক হওয়ায় স্থানীয়রা বাড়ির গোয়ালঘরে পালন শুরু করে আসছে।
পলিকণা দিয়ে গঠিত এই বিশাল জনপদটির মাটি খুব বেশি উর্বর হওয়ার কারণে শুরু থেকেই এই দ্বীপটিতে ধান, সুপারি, নারিকেলসহ শাক—সবজি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হত। এছাড়া নদীবেষ্টিত হওয়ায় এখানে পাওয়া যেত বিপুল পরিমাণ ইলিশসহ নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছও। প্রাকৃতিক এসব প্রাচুর্যের কারণেই যুগে যুগে বিভিন্ন জলদস্যুদের আনাগোনা ছিল এই বিচ্ছিন্ন হাতিয়া দ্বীপে।
এখানকার অধিকাংশ মানুষই জীবিকা নির্বাহ করে আসছে পশু পালন, চাষাবাদ, নারিকেল—সুপারি আর সামুদ্রিক ও ইলিশ মাছের ওপর নির্ভর করে। যুগ যুগ ধরে এই প্রবাদবাক্যের মাধ্যমেই পরিচিত হয়ে আসছে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়া উপজেলা । এছাড়া নদী আর সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় এখানকার মানুষের রয়েছে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। খাবারে রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা।
তবে মাছ ধরা বা চাষাবাদ করার পাশাপাশি এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়ার অধিকাংশ মানুষের মহিষ পালন একটি ঐতিহ্যগত পেশা। এখানকার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল সমূহের মানুষ বংশ পরম্পরায় মহিষ পালন করে জীবন—জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উপকূলীয় ১৯টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই হাতিয়া উপজেলাটি। এলাকার পরিমাণ ২,১০০ বর্গ কিলোমিটার। বাথানে অর্ধ লক্ষাধিক মহিষ পালন করা হচ্ছে । প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টন। প্রতিটি মহিষের বাথানে দশ থেকে শতের উপরে পর্যন্ত মহিষ পালন হয়ে থাকে। যা ঘরোয়া পরিবেশে একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু বর্তমানে এ মহিষ পালন অধিক লাভজনক হওয়ায় স্থানীয়রা বসত বাড়ির গোয়ালঘরে পালন শুরু করেছেন। মহিষ পালনের ব্যাপকতা ও এর দুধের চাহিদার কারণে এলাকার দরিদ্র কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। একদিকে মহিষ বিক্রি অন্যদিকে মহিষের দুধের তৈরি টক দই বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন চরাঞ্চলের অনেক অধিবাসী।
মহিষের দুধের তৈরি এই দইকে স্থানীয় ভাষায় ‘মইষা দই’ বলে থাকে। এই দই দীর্ঘ যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে সমাদৃত হয়েছে আসছে এখানকার মানুষের কাছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে, জেলার হাতিয়া—সূবর্ণচর এই দুই উপজেলার মহিষের বাথানগুলো থেকে প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হয় প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ টন। মহিষের দই তৈরির জন্য ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগ দুধ সংগ্রহ করেন এসব চর থেকেই। তাছাড়া বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র চৌমুহনী শহরের অর্ধশতাধিক মিষ্টির দোকানসহ জেলার বিভিন্ন বড় বড় বাজারের মিষ্টির দোকান সমূহে তারা দুধ সরবরাহ করে থাকে।
নদী ও সাগর দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এই বিচ্ছিন্ন হাতিয়া দ্বীপটির বুকে গড়ে উঠেছে ছোটবড় প্রায় ৩৫টি চর। এই চরগুলোতে প্রাচীনকাল থেকেই এখানকার স্থানীয়রা মহিষ পালন করে আসছেন। আর মহিষের কাঁচা দুধ থেকে তৈরি হয় জনপ্রিয় টক দই। যার চাহিদা ও জনপ্রিয়তা গণ্ডি ছাড়িয়েছে দেশব্যাপী।
বাথানিরা ও গোয়ালরা প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মণে মণে মহিষের দুধ নিয়ে আসেন জেলার বিভিন্ন বাজারে। বাজার থেকে দই ব্যবসায়ীরা তাদের প্রয়োজন মতো দুধ কেনেন। এরপর বিভিন্ন মাপের মাটির টালিতে দুধ বসিয়ে দই তৈরি করে বিক্রি করেন তারা।
এখানকার প্রায় সামাজিক, পারিবারিক ও ঘরোয়া ভোজে মইষা দই না থাকলে সে আয়োজন অনেকটা পূর্ণতা পায় না। দই ভাত, মুড়ি, চিড়ার সঙ্গে মিশিয়ে গুড় ও চিনি দিয়েও খাওয়া যায়। এছাড়াও খাবার হজমে সহায়তা করায় দেশজুড়ে নোয়াখালীর মৈষা দইয়ের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।
টক দই তৈরি করা খুবই সহজ কাজ। এই দই সাধারণত মাটির পাত্রে বসানো হয়। উপরে শুধু নিউজ পেপার দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। বেশ কয়েক ধরনের পাত্র থাকে। কোয়াটার, এক লিটার, দেড় লিটার, দুই লিটার এবং পাঁচ লিটার। প্রথমে মাটির পাত্র গুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। এরপর কাঁচা দুধ আগুনে গরম না করে ভালোভাবে ছেকে মাটির পাত্রে স্থির জায়গায় রেখে দিতে হয়। সাধারণত গরমের দিনে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা এবং শীতের দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে দই তৈরি হতে।
পারিবারিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক যেকোনো অনুষ্ঠানে দই থাকবেই। দই না থাকলে অনুষ্ঠান অপূর্ণ। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছেই সমান প্রিয় এই দই। স্থানীয়রা খাবারের শেষে ভাতের সঙ্গে এই দই খায়। টক দই এর সঙ্গে গুড়, মিষ্টি অথবা চিনি মিশিয়ে খেতে হয়। অনেকে গরমের দিনে দইয়ের সঙ্গে হালকা পানি ও চিনি মিশিয়ে মাঠা তৈরি করে খায়। এ মাঠা গরমের দিনে মানুষের শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে। এই দইয়ে রয়েছে প্রচুর ঔষধি গুণ। এটি হজমে সহায়তা করে। স্বাস্থ্যবিদদের মতে, দইয়ে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিনসহ অন্যান্য উপদান থাকে, যা আমাদের দেহের জন্য খুবই উপকারি।
দইয়ের কোয়ালিটির উপর দাম নির্ভর করে। আর দইয়ের কোয়ালিটি নির্ভর করে মহিষের দুধের ওপর। এই দই লিটার হিসাবে বিক্রি করা হয়। এতো সম্ভবনার পরও মহিষ পালন ও টক দই উৎপাদনে রয়েছে নানা রকম সংকট। কেননা, এই বিপুল সংখ্যক মহিষের বিচরণের জন্য যেমন দরকার হয় বিশাল বিচরণক্ষেত্র, তেমনই এসব মহিষের খাদ্যের জন্য প্রয়োজন হয় সেই অনুযায়ী ঘাসেরও। যার কোনোটিই এখন আর সেভাবে পাওয়া যায় না এই হাতিয়া—সূবর্ণচরের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে।
জেলার বিভিন্ন চরগুলোতে সরকারি খাস জমি স্থানীয় রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মহিষ মালিকদের কাছে ইজারা দেন। এইভাবে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের চর নিলক্ষ্মী, হরণী, চানন্দী, সুখচর, নলচিরা, চর ঈশ্বর, চর কিং এবং তমরদ্দি এর মতো এমন ৩৫টি মৌজার হাজার একর সরকারি জমি লিজ দিয়ে একটি পক্ষ কোটি টাকারও অধিক হাতিয়ে নেন। এতে সরকার পায় না কোন রাজস্ব। মহিষ মালিকরা এই সব জমি তাদের নামে সরকারি লিজ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন অনেকদিন থেকে।
শুধু মহিষ পালনের বিচরণ জমি আর ঘাসের সংকটই নয়, চরগুলোতে নেই প্রয়োজন সংখ্যক মহিষ রাখার জায়গা, নেই যথাযথ চিকিৎসাসেবাও। যার ফলে, দিন দিন বাড়ছে মহিষের খাদ্য সংকট। এই সব সংকট দূর করা গেলে জেলার মহিষের দুধ ও দইসহ দুগ্ধজাতপণ্য হতে পারে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সেরাপণ্য।
নতুন করে জেগে ওঠা প্রতিটি চর সরকারি খাস জমি হিসেবে স্বীকৃত। অথচ মহিষের জন্য কোনো জমি সরকারিভাবে দেওয়া হয়নি। মহিষের আবাস হিসেবে কোনো আবাসন গড়ে ওঠেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মহিষ খামারি জানান, হাতিয়া ও সূবর্ণচরের চরগুলো সবসময় একদল দস্যু বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। তারা প্রতি বছরের জন্য নির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ করে খামারিদের কাছে চরের ঘাস বিক্রি করেন। এতে চরে মহিষ অবাধে বিচরণ করে কাঁচা ঘাস খেতে পারে না এবং প্রায়ই চরে মহিষের খাবার সংকট দেখা দেয়। ফলে দুধের পরিমাণ কমে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে মহিষ নিখোঁজ হয়। মহিষের নিরাপত্তায় চরে নিরাপত্তাকেন্দ্র নেই। এতে দুর্যোগের সময় মহিষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জেলার সচেতন মহল বলছে, এই বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মইষা দইয়ের মান ধরে রাখতে হলে প্রশাসনকে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ে কার্যকর উদ্যোগসহ চরে মহিষের অবাধ বিচরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
জেলা অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, নদীতে নতুন জেগে ওঠা চর যেখানে ঘাস জন্মাতে পারে। ওই ধরনের চর মহিষের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হলে মহিষ পালন বাড়বে। একই সঙ্গে দুধের উৎপাদন বাড়বে। মহিষের দুধ দিয়ে দইসহ বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন সম্ভব।
নোভা