ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

শতবর্ষ আগের কাব্যভাষা

কবর

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত

প্রকাশিত: ১৭:৫০, ১৯ জুন ২০২৫

কবর

আধুনিক বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারে ‘কবর’ শিরোনামে দুটো সাহিত্য-কীর্তি অবিস্মরণীয়। একটি কবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) বিরচিত বাংলাদেশের লোকজীবন ও লোকভাষায় সমৃদ্ধ ‘কবর’ (প্র.প্র. ১৯২৫) কবিতা; অন্যটি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১) রচিত কবর (প্র.প্র. ১৯৫৩) নাটক। ‘কবর’ কবিতার প্রথম পঙক্তি : ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে’। জসীমউদ্দীনের কবিখ্যাতি এনে দেওয়া কবিতার এই প্রথম পঙক্তিটি কবিজীবনের সঙ্গে কতোটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং অবিকল জীবনচিত্র তার অন্যতম অকাট্য প্রমাণ-‘জসীমউদ্দীনের অন্তিম ইচ্ছানুসারে ফরিদপুরের আম্বিকাপুর গ্রামে তাঁর দাদির কবরের পাশে তিনি সমাহিত’ (খান ও অন্যান্য, ২০১১ : ২৩৬)। আবার ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে (তাঁর জন্মভূমি ও মাতুলালয়) কবি যে ঘরে থাকতেন তার সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির দু’দিকে লেবু গাছ, মাঝখানে ডালিম গাছ। এই জায়গাটিই তাঁর কবিতার সৃষ্টির উৎসভূমি। কিশোরবেলায় জসীমউদ্দীন অনুপ্রাণিত হন দানু মোল্লা নামে এক অন্ধ দাদার কাছে কেচ্ছা শুনে। কবির ভাষায় : ‘আমার কবি জীবনের প্রথম উন্মেষ হইয়াছিল এই দাদার গল্প, গান ও কাহিনীর ভিতর দিয়ে’ (জসীমউদ্দীন, ১৯৭৬ : ৪৪)। সেই দাদার আত্মবিলাপ-স্বগতোক্তি দিয়েই রচিত ‘কবর’ কবিতাখানি। কবিতায় নিহিত এমন নিখাঁদ বা খাঁটি কাহিনী, ভাব ও ভাষা দেখে রবীন্দ্রনাথ ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন: ‘জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না (উদ্ধৃত, আনিসুজ্জামান, ২০১৫: ১৯০)। তাই ‘কবর’ কবিতার কাব্যভাষা বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে কবি জসীমউদ্দীনের কাব্যরস আস্বাদন এবং কবি-হৃদয়ের স্বরূপ উন্মোচিত হয়। 
বিশ্বসাহিত্যে কাব্যভাষার দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায়, ইউরোপীয় রেনেসাঁসের যথার্থ সূচনা দান্তে (১২৬৫-১৩২১) থেকে। দান্তে দি ইলাসট্রিয়াস ভার্নাকুলার নামক ল্যাটিন ভাষায় লিখিত বইয়ে লাতিন ভাষার বিরোধিতা করে সাহিত্যক্ষেত্রে সর্বপ্রথম মার্জিত প্রাদেশিক ভাষার জয় ঘোষণা করেন। রেনেসাঁসের বড় বৈশিষ্ট্য লাতিনের দাসত্ব থেকে লোকভাষাকে মুক্তিদান। সেই মুক্তিমন্ত্রের প্রথম পূজারী দান্তে। তাঁর মতে কবির মাতৃভাষাই কাব্যভাষা হওয়া দরকার; লাতিনের মতো কৃত্রিম ভাষার সে-গৌরব প্রাপ্য নয়। এজন্য ইতালির বিভিন্ন উপভাষা নিয়ে বিচার করে তিনি এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, ইতালিতে প্রচলিত যে-সমস্ত উপভাষা আছে তার মধ্যে যেটি প্রকাশক্ষমতায় শ্রেষ্ঠ, সেটি হবে সাহিত্যের ভাষা। এরই ধারাবাহিকতায় আবির্ভূত হন ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়র (১৮২১-১৮৬৭), ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫) প্রমুখ। তিরিশের দশকে আবির্ভূত প্রধান বাঙালি কবিগণ প্রধানত বোদলেয়র ও টি এস এলিয়টের কাব্যভাষা এবং রূপকল্প ব্যবহারের চমৎকারিত্বে আকৃষ্ট হয়ে একটি অ-রাবীন্দ্রিক কাব্যভুবন নির্মাণে ব্রতী হন এবং সম্মিলিত প্রয়াসে সৃষ্টি করেন তিরিশোত্তর বাঙলা কবিতার পটভূমি (আনোয়ার, ১৯৯৭: ৪৭)। জসীমউদ্দীন উচ্চশিক্ষিত, নগরজীবন সম্পর্কে অবহিত এবং সমকালীন কাব্যান্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হয়েও নাগরিক জীবনের জটিলতাকে সন্তর্পণে এড়িয়ে গ্রামীণ মানুষের সহজ জীবনবৃত্ত ও তাদের আবেগ-অনুভূতিকে কাব্যরূপ দান করে বাংলা সাহিত্যে ‘পল্লীকবি’ হিসেবে অসামান্য প্রতিষ্ঠা অর্জনে সমর্থ হন (মুখোপাধ্যায়, ২০০২: ৬২)। তাঁর ‘কবর’ কবিতা থেকে শুরু করে অধিকাংশ কবিতার কাব্যভাষায় প্রতিফলিত-একেবারে সোজাসুজি মর্মস্পর্শ করবার আকুলতা। কোনো ‘ইজম’-এর ছাঁচে ঢালাই করা নয় বলে তাঁর কবিতা হয়তো জনতোষিণী নয়, কিন্তু মনোতোষিণী (সেনগুপ্ত, ১৯৮৮: ১০৪)। তিনি মূলত বাংলার শ্যামল গাঁয়ের জলমাটিহাওয়া ও তার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে আধুনিক সময়ের জাঁতাকলে উন্মেচিত করতে চেয়েছেন (মুস্তাফা, ২০২০)। তাঁর কাব্যভাষাও তাই গাঁয়ের জলমাটিহাওয়ার মতো সাধুভাষারীতির সঙ্গে প্রমিতভাষা আর লোকভাষার মিশেল এক সুরেলা মিষ্টি-মধুর বাংলা ভাষা।
আক্ষেপের বিষয় পাশ্চাত্য আধুনিকতার তত্ত্বে-বয়ানে বিভ্রান্তিতে ডুবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ কাব্যালোচক জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষা বিশ্লেষণে বা তাঁর নন্দনতত্ত্ব নিরূপণে ব্যর্থতায় ডুবে গিয়ে পান্ডিত্য প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন। যেমন: কারও মতে, জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাষা প্রমিত বাংলাই, তার সঙ্গে মিশেল আছে আঞ্চলিক শব্দের-কিছু, কিন্তু প্রচুর নয় (আনিসুজ্জামান, ২০১৫ : ১৮৭)। কেউ আবার আরেকটু ঘুরিয়ে ‘কবর’ কবিতার আলোচনায়-একই কথা বলেছেন এভাবে: ‘আঞ্চলিক শব্দের সঙ্গে প্রচলিত ছন্দ ও প্রমিত ভাষার সমন্বয়ে এক নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণে কবি জসীমউদ্্দীন সক্ষম হন’ (মুস্তাফা, ২০২০)। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএসসি শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘কবর’ কবিতার আলোচনায় আছে: ‘আথালে- গোহালে (আথালে আঞ্চলিক শব্দ, পল্লী কবিদের রচনায় পাওয়া যায়)। ... মাথাল-খড় বাঁশের পাতা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি ছাতা বিশেষ। গ্রামের কৃষকেরা হাতে তৈরি ছোট এ ছাতা মাথায় টুপির মতো করে পরে। রোদ বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচায়। এটি আঞ্চলিক শব্দ। মজীদ- মসজিদ (আঞ্চলিক শব্দ) (ঘোষ, ২০১৬: ১৫৫)। আরও বিস্ময়ের বিষয়: উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ বইয়ে ‘গেনু’ শব্দকে আঞ্চলিক বলে শেখানোর প্রয়াস। অথচ কে না জানে ‘গেনু’ পদটি ‘গেলাম’ ক্রিয়াপদের কাব্যিক রূপ। বাংলাদেশ এনসিটিবি প্রকাশিত উচ্চমাধ্যমিক বাংলা সংকলন (২০০১) বইটতে: ‘আথালে’, ‘মাথাল’ বা ‘মজীদ’ শব্দ তিনটির কোনোটিকেই ‘আঞ্চলিক শব্দ’ বলা হয়নি। তবে এখানে আছে নতুন তথ্য: ভেস্ত-নসিব হয়- ভাগ্যে যেন বেহেশতের সুখ লাভ ঘটে। ‘বেহেশত’ শব্দের বিকৃত রূপ-ভেস্ত।... বা-জান- ‘বাপজান’ শব্দের সংক্ষিপ্ত আঞ্চলিক রূপ। পিতা (হক, ১৯৯৮: ৪১৭)।
বাংলাদেশে কাব্যালোচনা-পাঠ্যবই সবটাতেই জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষা নিয়ে এমন উদ্ভট বিভ্রান্তিকর বয়ান-বক্তব্যের কারণ অনুসন্ধানে আমরা হাজির হই ‘সদানন্দ’ খ্যাত পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সমীপে। তাঁর সম্পাদিত বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান-এর ভুক্তিতে ‘কবর’ কবিতায় ব্যবহৃত ৮৯৫ শব্দের কোনোটি আমাদের চোখে পড়েনি। অবশ্য , ঐ অভিধানে আছে-‘আথালে’ খুলনা-যশোর অঞ্চলে মাচা পাতিবার উপকরণ অর্থে বিশেষ্য পদ রূপে প্রচলিত (শহীদুল্লাহ, ১৯৬৫: ৭০)। সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান-এ আছে: ‘আথাল বি. গোশালা; গোয়াল ঘর’ (শরীফ, ১৯৯৬: ৪৬)। সুতরাং শব্দটি কোনো মতেই আঞ্চলিক নয়; বড়জোর লোকশব্দ ছিল। তবে বর্তমানে তা প্রমিত বাংলা শব্দ হিসেবেই প্রমিত ভাষার অভিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। ‘কবর’ কবিতায় ব্যবহৃত ‘মাথাল’ শব্দটিও আঞ্চলিক নয়। আঞ্চলিক অভিধানে ‘মাথাল’ ভুক্তিটি আছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রচলিত শব্দ রূপে। এর অর্থ মাথার দিকে। যেমন: গেরামের উত্তর মাথালে আমার বাড়ি (শহীদুল্লাহ, ১৯৬৫: ৮৪৯)। সুতরাং কৃষকের মাথার ছাতা অর্থে ব্যবহৃত ‘মাথাল’ আঞ্চলিক শব্দ নয়। এটিও লোকসংগীতে ব্যবহৃত লোকশব্দ। আর ‘মসজিদ’ অর্থে ‘মজীদ’ এবং ‘বেহেস্ত’ অর্থে ‘ভেস্ত’ শব্দের প্রয়োগ যে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রয়োজনে তা বলা বাহুল্য। অবশ্য এই পরিবর্তন কবির শৈলীর পরিচয়ও বটে। আরেকভাবে বলা যায়, কবিরা সমাজ-সংসার-সংগ্রামের কথা লিখবেন। এ সব কথা লিখতে গিয়ে শব্দ চাতুরির আশ্রয় নিলে, বিশেষ কোনো কথন-ভঙ্গির আশ্রয় নিলে দোষ নেই (সৈকত, ২০১১)। সুতরাং কবির ব্যবহৃত শব্দকে বিকৃত শব্দ বলা যায় না, অন্তত ঐ কবির কাব্যোলোচনায় তো নয়ই। এভাবে ‘কবর’ কবিতার প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণ করে দেখানো যায় এখানে কবি জসীমউদ্দীন কোনো আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেননি। অবশ্য পল্লীর একটি আবহ তৈরির স্বার্থে সাধু-চলিত ভাষার সঙ্গে লোকভাষার শব্দভাণ্ডারে মিশ্রণ ঘটিয়ে নির্মাণ করতে হয়েছে তাঁর কাব্যভাষা। 
জসীমউদ্দীনের কাব্য-সমালোচকদের মধ্যে ব্যতিক্রমী বক্তব্য পেশ করেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান। তিনি যথার্থই মনে করেন, জসীমউদ্দীনের হাতে লৌকিকজীবন ও লোক-উপকরণ আধুনিক আঙ্গিকে ও রুচিতে সজ্জিত হয়ে পরিবেশিত হওয়া মাত্রই স্বীকার ও গৃহীত হতে এতটুকুও দেরি হল না (রহমান, ১৯৯৪: ৫১৪)। জসীমউদ্দীন লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান কাব্যে ব্যবহার করে লোকায়ত জীবনেরে স্পর্শ করেছেন (হায়দার, ২০১২: ৪৮)। কবিতায় লোকভাষা ব্যবহার করে নতুন কাব্যভাষা সৃষ্টির পাশাপাশি  বাঙালি লোকজীবনের গভীরে তাঁর পাঠককে প্রবেশ করাতে পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রেখেছেন।  
বাংলাদেশের সাধারণ জন-মানসের জীবন-উপকরণকে তাঁদের মুখের ভাষায় উপস্থাপন করতে গিয়ে জসীমউদ্দীন চলিত ভাষারীতির ক্রিয়াপদের সঙ্গে একই পঙ্ক্তিতে বসিয়েছেন সাধু ভাষারীতির ক্রিয়াপদ। বাংলাদেশের ভাষারূপ সম্পর্কে অধ্যাপক সলিম্মুল্লাহ খান যথার্থই বলেন, ‘আমরা যখন কথা বলি তখন তো চলিত রীতির ক্রিয়া ব্যবহার করি না। একটু লম্বা ক্রিয়া ব্যবহার করি। আমার ক্রিয়াটা আরেকটু লম্বামাত্র (আজম, ২০১৮)। জসীমউদ্দীনও তাঁর ‘কবর’ কবিতায়-সাধু, চলিত ও কাব্যিক এই তিন ধরনের-লম্বা-মাঝারি-বেঁটে ক্রিয়াপদগুলোকে একত্রে বসিয়ে কাব্যভাষায় একটা সুরেলা-সরলতা সৃষ্টি করেছেন। যেমন: 
এখানে ওখানে ঘুরিয়া (সাধু) ফিরিতে (সাধু) ভেবে (চলিত) হইতাম (সাধু) সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া (সাধু) দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি (কাব্যিক)
লাঙল লইয়া (সাধু) খেতে ছুটিতাম (সাধু) গাঁয়ের ও-পথ ধরি (কাব্যিক)।
এখানে লক্ষণীয় রবীন্দ্র-কাব্যে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদের কাব্যিক রূপ ভরি, ধরি, গেনু ইত্যাদি ইত্যাদি বর্জনের তাগিদ ত্রিশের দশকের আধুনিক কবিগণ অনুভব করেন। তবে জসীমউদ্দীন এগুলো বর্জনের আগ্রহ দেখাননি (মাহমুদ, ২০০৯ : ১৭৪)। তাঁর কাব্যভাষায় তিনি ‘ভিজিয়ে রেখেছি’ বলেননি, ‘ভিজাইয়া রাখিয়াছি’ ও না; তিনি লেখেন, ‘ভিজায়ে রেখেছি’ এবং এভাবে কবি তৈরি করেন স্বকীয় স্বতন্ত্র ভাষাশৈলী। এই ভাষাশৈলীর গুণেই কবিতায় মৃত্যুর মুহুর্মুহু উপস্থাপনা সত্ত্বেও সংযম সহাবস্থান করে। আবার সরলতার পাশাপাশি আবেগী তীব্রতার কারণে অনায়াসে গালিবাচক শব্দও কাব্যভাষায় প্রবেশ করে ভাষাকে কলুষিত না করে, বরং করে তোলে শিল্প-সুষমায় মণ্ডিত। যেমন: ‘শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে’। এখানে শ্বশুরের হিংস্রতাকে মাংস ব্যবসায়ী ও চামড়া ব্যবসায়ীর সঙ্গে তুলনা করতে গালিবাচক শব্দের ব্যবহার কবির আবেগের তীব্রতাকে গতি দিয়েছে; নাতনির করুণ পরিণতিকে আরও গাঢ় আবেগে ভরিয়ে দিয়েছে, নারীনির্যাতনের ক্ষোভকে করেছে বাস্তবানুগ। ‘কবর’ কবিতায় পুত্রহারা দাদুর কণ্ঠে যখন ধ্বনিত হয়: 
তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!
তখন পাঠকমাত্রেই ভাবতে বাধ্য এমন করুণ-বাস্তব বর্ণনার জন্যে জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষার বিকল্প নেই। আর এ কারণেই শতবছর পরেও দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত দুই বাংলায় জসীমউদ্দীন রচিত ‘কবর’ বহুল পঠিত ও নন্দিত কবিতা।
জসীমউদ্দীন বিশ শতকের তিরিশের দশকের কাব্যান্দোলনে শরিক হলেও তিনি আধুনিকতার নামে রবীন্দ্র-বর্জনে যেমন বিশ্বাসী ছিলেন না, তেমনি পাশ্চাত্যমুখীও ছিলেন না। তাঁর কাব্যের বিষয়ে যেমন আবহমান বাংলার লোকজীবন ও সংস্কৃতি সমুজ্জ্বল, তেমনি বঙ্গজনপদের সাধারণের লোকভাষাও ঠাঁই পেয়েছে তাঁর কাব্যভাষায়। আমাদের নন্দনতাত্ত্বিকগণ বিশ্বসাহিত্যের আধুনিকতার বয়ানে বিভ্রান্ত অথবা তাঁরা লোকভাষা এবং আঞ্চলিক ভাষা- এই দুই উপভাষার ব্যবধান সম্পর্কে সম্যক অবগত নয় বলে পল্লীকবির ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা বলে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। অথচ একটু সতর্কতার সঙ্গে অবলোকন করলে অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না যে, জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার কাব্যভাষায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকেই অবলম্বন করেছেন। এখানে সাধু-চলিত ভাষারীতির ক্রিয়াপদ যেমন আছে তেমনি লোকভাষার অনেক শব্দ রয়েছে, রয়েছে কাব্যিক ক্রিয়াপদও। সবকিছু মিলে এই কাব্যভাষা আমাদের প্রাত্যহিক পল্লীজীবনের মৌখিক ভাষার এক পরিমার্জিত কাব্যিক রূপ বলা যায়। শতবছর পরে আজও তাই আনন্দে অবগাহন করি জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষায়।

প্যানেল

×