
ছবি: সংগৃহীত
একজন মা প্রথমবার তার নবজাতককে বুকে তোলার মুহূর্তে কাঁদে। মৃত সঙ্গীর মুখের দিকে তাকিয়ে একজন আহত সৈনিকের চোখ নিঃশব্দে ভিজে যায়। কিংবা নববধূ যখন বিয়ের সাজে মায়ের কোলে মাথা রেখে ফুপিয়ে ওঠে—সেই কান্না কি শুধুই চোখের জল?
বিমানের জানালা দিয়ে ছোট হয়ে যাওয়া মাতৃভূমির শেষ ছবিটা দেখে কোন এক প্রবাসী যখন আর চোখের পানি চেপে রাখতে পারে না, সেটা কি কেবলই আবেগতাড়িত মস্তিষ্কের ক্রিয়া?
মায়ের মুখ শেষবারের মতো দেখে যে সন্তান নীরবে কাঁদে, অথবা বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর যে বেকার যুবক চাকরি পেয়ে আনন্দে চোখ ভাসায়—তাদের অশ্রুর রাসায়নিক গঠন হয়তো একই, কিন্তু সেই কান্নার অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কান্না কি তাহলে শুধুই লবণ ও জলের মিশ্রণ? নাকি সেই ফোটার মধ্যে জমে আছে হাজার হাজার বছরের মানবিক যন্ত্রণার ইতিহাস?
কান্না শুধু একটি শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নয়—এটি এক গহীন দার্শনিক ইশারা। যা বলে দেয় আমরা কতটা নশ্বর, আমরা কতটা অসাধারণ।
আপনি রোজ নানা খবরের ট্রেনে বিচরণ করেন। বেশিরভাগ খবরই আপনার মন ভার করে দেয়। কিছু খবরে আপনার হয়তো চোখ ভিজে আসে, বুকের ভেতর কান্নার দমক দলা পাকিয়ে যায়। আপনি হয়তো অনুভব না করেই কাঁদেন।
আমাদের প্রতিবেদনে আপনার সেই কান্নার মুহূর্তকে অনুভব করাবে। তাতে হয়তো নরম মোমের মত চুয়ে পড়বে আপনার কান্নার রং।
আমরা কেন কাঁদি?
জাপানের রুইকাচ্ছু বা কান্নার থেরাপি জনপ্রিয়। সেখানে মানুষ একসঙ্গে বসে ইচ্ছাকৃতভাবে কাঁদে, মানসিক চাপ মুক্তির উপায় হিসেবে। রুইকাচ্ছু শব্দটির অর্থ 'টিয়ার অ্যাক্টিভিটি'। এটি জাপানের কর্মব্যস্ত, আবেগ-দমনকারী সমাজে এক বৈপ্লবিক মানসিক স্বাস্থ্যচর্চা।
জাপানের পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেও এখন গণকান্নার আয়োজন জনপ্রিয়। লস অ্যাঞ্জেলেসে চালু হয়েছে ক্রাইং ক্লাব, ভারতের মুম্বাইয়ে রয়েছে ইমোশনাল রিলিজ ওয়ার্কশপ।
আমরাও মাঝে মাঝে একসাথে কাঁদি, মাতম করি—যদিও তা বেশিরভাগ সময়েই অপরিকল্পিত।
যে মানুষ গভীরভাবে কাঁদতে জানে, সেই প্রাণ খুলে হাসতেও পারে। কারণ কান্না আমাদের ভঙ্গুরতাকে স্বীকার করে নেয়। তবে জ্যাক ল্যাশনারের মতে, অশ্রু হলো স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ—যখন আমরা কাঁদি, তখন আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করি।
এটা কি দুর্বলতা, নাকি মুক্তির এক অদ্ভুত রূপ?
ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল, যিনি নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন, বলতেন—যে কান্না কোন অর্থ খোঁজে, তা কখনো বৃথা যায় না। তিনি দেখেছিলেন, যারা কাঁদতে পারতো, তারাই মানসিকভাবে টিকে থাকতে পেরেছিল।
ধরা যাক, আপনি লেখালেখি করেন, কিন্তু পাঠকের কাছে পৌঁছায় না। শ্রম-জমানো শব্দগুলো পড়ে থাকে অপ্রকাশিত। সেই অতৃপ্তি ভাবতেই আপনার কান্না পায়। আপনি কাঁদুন—নির্দ্বিধায়।
বিজ্ঞানও কিন্তু আপনার কান্নার দর্শনকে সমর্থন করে।
গবেষণা বলছে, ইমোশনাল টিয়ারসে 'লিউ এনকেফালিন' নামে এক প্রাকৃতিক ব্যথানাশক থাকে, যা আমাদের শান্ত করে। ড. উইলিয়াম ফ্রের মতে, কান্না স্ট্রেস হরমোন কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয়—নারী ও পুরুষের অশ্রু আলাদা। টেস্টোস্টেরনের কারণে পুরুষের চোখে পানি আসতে বেশি সময় লাগে।
তবুও, কান্না সবার জন্যই উপকারী। সেনেকা বলতেন, অশ্রু হলো মনের বৃষ্টি—যা হৃদয়ের ধুলো ধুয়ে দেয়। আলবেয়ার কামু ভিন্ন কথা বলেন—তার মতে কান্না কোন সমাধান দেয় না, তবে মনে করিয়ে দেয়—আমরা এখনো জীবিত।
মানুষই কি একমাত্র প্রাণী যে আবেগে কাঁদে? মার্ক টোয়েন ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কাঁদে, অথবা যার কান্না দরকার হয়।”
কিন্তু আজ আমরা জানি—হাতিরা মৃত সঙ্গীর জন্য শোক করে। গরিলা বা কুকুররাও হারানো সন্তান বা সঙ্গীর জন্য কাঁদে। তবে তাদের কান্না কি মানুষের মতো জটিল আবেগ প্রকাশ করে?—এখনো গবেষণার বিষয়।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ কাঁদে। গুহাচিত্র ও প্রাচীন সাহিত্যে কান্নার উল্লেখ আছে। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, মৃত্যুর পর দেবতা ওসাইরিসের বিচারে মানুষের অশ্রু ওজন করা হয়—যার কান্না ভারী, তার হৃদয় পবিত্র।
তাই তারা মৃতের সাথে ‘অশ্রুপাত্র’ দিতো, যেন প্রমাণ রাখা যায়—সে পৃথিবীতে কেঁদেছে।
গ্রিক ট্র্যাজেডিতে হেক্টর বা অন্টিগনের কান্না কেবল ব্যক্তিগত নয়—তা মানবজাতির যন্ত্রণার প্রতীক।
আপনার কান্না কেমন? শুধুই ব্যক্তিগত? নাকি তাতে লুকিয়ে আছে এক জাতিগত বেদনার প্রতিধ্বনি?
প্রতিটা কান্নার ফোঁটা কি উইপোকার মতো ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে মনুষ্য অস্তিত্বের কাঠামো?
আপনি কাঁদুন নিজের জন্য। কারণ আপনার কান্না—মানবজাতিরই কান্না।
মার্সেল প্রুস্তের In Search of Lost Time-এ ম্যাডলিন কেক খাওয়ার পর হঠাৎ জেগে ওঠা শৈশবের স্মৃতি কিংবা আন্না ক্যারেনিনার ট্রেনের নিচে নামার আগের সেই চূড়ান্ত কান্না—এই সবই তো কান্নার মধ্য দিয়ে জীবনের এক গভীর বোঝাপড়া।
কাঁদলে কি সত্যিই মন হালকা হয়?
ড. জুডিথ অরলফ বলেন, “কান্না হলো আবেগের ঘাম।” যেমন ঘাম শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়, তেমন কান্না মন থেকে বিষণ্নতা দূর করে।
তবে শর্ত—কান্নাকে দমন করা যাবে না। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সামাজিকভাবে কাঁদতে পারে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
ড. ফ্রের মতে, প্রায় ৯০% মানুষ কাঁদার পর হালকা বোধ করে—কারণ অশ্রুর সঙ্গে কর্টিসল ও ম্যাঙ্গানিজ বেরিয়ে যায়। তবে যারা একা কাঁদে, তারা বেশি হতাশায় ভোগে। অর্থাৎ, কান্না শেয়ার করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের সমাজে এখনো প্রচলিত—“ছেলে মানুষ কাঁদে না।” ছোটবেলা থেকে ছেলেদের এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেন আবেগ প্রকাশ করা নিষিদ্ধ।
এ সময় এসেছে লাল রঙে ক্রস টানার। আমাদের শিশুদের শেখানো হোক—কান্না খুব স্বাভাবিক মানবিক বৈশিষ্ট্য।
শিশু জন্মের পর প্রথম কাজ—কান্না। আর মানুষ মৃত্যুর আগে শেষ আবেগ—তাও কান্না। এই দুই কান্নার মাঝেই জড়িয়ে আছে পুরো জীবনের গল্প।
রিলকে বলেছিলেন, “আমাদের গভীরতম দিনগুলো হলো সেদিন যেদিন আমরা নিঃশব্দে কাঁদি।”
তাই কান্নাকে ভয় পেও না। এটি দুর্বলতার নয়, বরং মানবিক দৃঢ়তার চিহ্ন। কারণ, যে কাঁদতে জানে, সেই সত্যিকার অর্থে বাঁচতে জানে।
আপনার কান্না ভেজা বিস্তর আকাশের মতন। প্রিয়জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে না, আপনি তাকাতে পারেন না, তখন কান্না হাহাকারে রূপ নেয়। বাসের কন্ডাক্টর গুলশান থেকে আসে না—আসে গুলিস্তান থেকে। তীব্র জ্যাম, ধুলাবালি আর মাথাব্যথা নিয়ে ঘরে ফিরলে আপনি টের পান—মনের আকাশের তারা অন্য পাড়ায় আলো জ্বালাতে গেছে।
এই শহরের নিঃসহায় মূহূর্তে, আপনার চোখের জল গাল বেয়ে পড়ে—জল পড়ে নির্ঝরের মত, জল পড়ে গহীন ক্ষতের মত। পড়ুক। পড়তে দিন।
আপনার আশেপাশে যা ঘটছে—তাতে পৃথিবীটা কি অসহ্য মনে হয়?
যদি অনেক দিনের জমে থাকা যন্ত্রণা শিশুর মতো চোখে গড়িয়ে পড়তে চায়, তাহলে কাঁদুন। এই যান্ত্রিক শহর যদি আপনার মাতমের কণ্ঠ চেপে ধরে, তবু চিৎকার করে কাঁদুন।
এই মিথ্যে কথার পৃথিবীতে আকাশ ভেঙে পড়লেও, বুক বেয়ে বজ্রনিনাদ নামলেও—কাঁদুন। এবং আরও বলিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ান।
যদি মনে হয় জীবনে কেউ সত্যিকারের বন্ধু হয়ে আসেনি, কাঁদুন। আর তুষারের ঘ্রাণ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। একসময় অভিলাষ ও আত্মউন্নয়নের যাত্রা মসৃণ হবে।
তখন আপনাকে আর ভুল দরজায় কড়া নাড়তে হবে না। কান্নার ধারা শেষে দেখা যাবে—আপনার মনে কাটার হার নেই, হৃদয়ে ফুটছে বসন্তের বাগান বিলাস।
এসএফ