ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

আবুল হাসানের রচনা গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মিলিত অভিজ্ঞতা

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ০১:২২, ৪ আগস্ট ২০২৩

আবুল হাসানের রচনা গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মিলিত অভিজ্ঞতা

আবুল হাসানের মাত্র তিনটি কবিতাবই প্রকাশ হতে পেরেছিল তাঁর জীবদ্দশায়

আবুল হাসানের মাত্র তিনটি কবিতাবই প্রকাশ হতে পেরেছিল তাঁর জীবদ্দশায়। ‘রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭২)’, ‘যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪)’ এবং ‘পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)।’ আর ছিল একটি গল্প সংকলন এবং একটি কাব্য নাটক। পরবর্তীতে বন্ধু মুহম্মদ নূরুল হুদা সহ কয়েকজন মিলে সম্পাদনা করে ‘আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা’ প্রকাশ করেন ১৯৮৫ সালে। রয়েছে তাঁর রচনা সমগ্র 

কবি আবুল হাসানের ‘দূরযাত্রা’ কবিতায় সভ্যতা, অধঃপতন, রাজনীতি ও শিল্পকলা নিয়ে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস প্রকাশিত হয়েছে কবিমনের নিদারুণ বেদনারবোধ থেকে। তিনি লিখেছেন-
‘আমি কার কাছে যাবো? কোনদিকে যাবো?
অধঃপতনের ধুম সবদিকে, সভ্যতার সেয়ানা গু-ার মতো 
মতবাদ; রাজনীতি, শিল্পকলা শ্বাস ফেলছে এদিকে ওদিকে, 
শহরের সবদিকে সাজানো রয়েছে শুধু শাণিত দুর্দিন, বন্যা অবরোধ আহত বাতাস!
আমি কার কাছে যাবো? কোনদিকে যাবো?
.......
জ্বলছে এই যে স্বপ্ন, স্মৃতি, শব্দ, অলঙ্কার 
অভাবের মরীচিকা, এ শহর কার?’
‘আবুল হাসান রচনা সমগ্র’ বইয়ের ভূমিকায় শামসুর রাহমান লিখেছেন...’ আবুল হাসান তার একটি কবিতার বলেছেন, শিল্প তো নিরাশ্রয় করে না। কাউকে দুঃখ দেয় না। সেই একই কবিতায় তিনি লেখেন...
শিল্প তো স্বাতীর বুকে মানবিক হৃৎপি-, তাই
আমি তার হৃৎপি-ে যাই চিরকাল রক্তে আমি
শান্তি আর শিল্পের মানুষ। 
হ্যাঁ, তিনি শান্তি আর শিল্পের মানুষ, সর্বোপরি মানবপ্রেমী প্রকৃত কবি। এজন্যই তাঁর রচনা সমগ্র আমাদের অবশ্যপাঠ্য। একজন কবির মূল্যায়নের জন্য তার প্রধান এবং গৌণ সকল রচনাই পড়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের কবিগোষ্ঠী যাঁদের কবিতা আমৃত্যু বার বার পড়বো আবুল হাসান নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম।’ শামসুর রাহমান আরো বলেন...
‘গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মিলিত অভিজ্ঞতা তার কবিতাকে বর্ণাঢ্য ও সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর কবিতা সহজেই পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে।’ 
পৃথিবীর যন্ত্রণা থেকে উত্তরণ চেয়েছিলেন এক প্রেমিক, কবি সুরাইয়া খানম যারে অভিহিত করেছিলেন, বাংলা কবিতার ‘আহত ও ক্ষুধার্ত সিংহ’ হিসেবে। ষাটের দশক থেকে যিনি জেগে উঠছিলেন অশিল্পের অন্ধকার থেকে শিল্পের ঊষার দিকে। মাত্র ২৯ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে চলে গিয়েছিলেন কবি আবুল হাসান। আবুল হাসান বাংলা কবিতাকে কতটা সমৃদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন সে উত্তর আমরা খুঁজতে চাইব তাঁর কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে।
অশিল্পের অন্ধকার থেকে আমি জাগলাম শিল্পের ঊষায়/একটি কবিতার খোঁজে, কুমারীর পায়ের পাতার মতো নরোম/ কবিতার খোঁজে/এই আমার জাগরণ! (অগ্রন্থিত কবিতা/রৌদ্রের রঙঃ ১৯৭৯ তে প্রকাশিত)।

কবিতার খোঁজে তাঁর এই জাগরণ স্পর্শ করতে চাইবো। কুমারীর পায়ের পাতার মতো নরম সে সব কবিতা যে তাঁর পূর্বসূরিদের হাত ধরে এসে বাঁধতে চেয়েছে নিজস্ব ঘর মাত্র এক দশকেই, তা আমরা টের পাব তাঁর কাব্যের প্রতিটি পরতে পরতে। তাঁর প্রথম কবিতাবই ‘রাজা যায় রাজা আসে’র কবিতাগুলোয় স্পষ্টতই টের পাওয়া যায় তা। যদিও জেনেছি বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন অনেকটাই উড়নচ-ী, আড্ডাবাজ আর ভবঘুরে। ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ফাইনাল শেষ না-করেই ছেড়ে গিয়েছিলেন। সাংবাদিকতা করেছেন বেশ ক’টি পত্রিকায়। জনশ্রুতি রয়েছে, বন্ধু নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই গড়ে উঠেছিল গভীর বন্ধুত্ব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় শেষ দিকে আবুল হাসানের প্রেম গড়ে উঠেছিল ইংরেজি বিভাগের লেকচারার সুরাইয়া খানমের সঙ্গে। সেই প্রেমকে বলা যায় এক অপার মুগ্ধতা। প্রেমিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ক্যামব্রিজ পড়ুয়া সুরাইয়া খানম। সুরাইয়া খানম চেয়েছিলেন আবুল হাসানকে খানিকটা বশে আনতে। উড়নচ-ী জীবনযাপনে খানিকটা লাগাম টানতে। আর তাই সুরাইয়া খানম সহ্য করতে পারতেন না নির্মলেন্দু গুণকেও। তখন আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণের বন্ধুত্বে কিছুটা চিড় ধরেছিল। আর তাই বন্ধুকে অভিমানের ছলে লিখেছিলেন —-‘তুমি কি ভুলেই গেলে সেই সব দিনের কথা, যখন শীতের কুয়াশার মধ্যরাত্রির বাতাসকে আমরা সাক্ষী রেখে ঢাকা শহরের অলিগলি চষে বেড়িয়েছি। আমরা তখন কি সুখী ছিলাম না?

সেই সুখের কারণেই কি তুমি আবার ফিরে আসতে পারো না? যতই ভালোবাসার পেছনে ধাবমান আমাদের ছায়া এর-ওর সঙ্গে ঘুরুক, তুমি জানো আর আমিও জানিÑ একসময় আমরাই আমাদের প্রেমিক ছিলাম।’ এমন কি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ডাক্তাররা আশা ছাড়লেও সুরাইয়া খানম নাকি আশা ছাড়তে পারেননি। সুরাইয়া খানমও বেঁচে নেই। ২০০৬ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কবির মৃত্যুর পর দেশে আর মন বসাতে পারছিলেন না। পরে আমেরিকার অ্যারিজোনায় চলে যান পড়াতে। সেখানেই বিয়ে করে বসবাস করেছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আবুল হাসানকে উৎসর্গ করে তাঁরও একটি কবিতাবই প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৭৬ সালে, ‘নাচের শব্দ’। 
আবুল হাসানের মাত্র তিনটি কবিতাবই প্রকাশ হতে পেরেছিল তাঁর জীবদ্দশায়। ‘রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭২)’, ‘যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪)’ এবং ‘পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)।’ আর ছিল একটি গল্প সংকলন এবং একটি কাব্য নাটক। পরবর্তীতে বন্ধু মুহম্মদ নূরুল হুদা সহ কয়েকজন মিলে সম্পাদনা করে ‘আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা’ প্রকাশ করেন ১৯৮৫ সালে। রয়েছে তাঁর রচনা সমগ্র। একসাথে এক বইয়েই যেন সব। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে মজিবর রহমান খোকা বইটি প্রকাশ করেন ১৯৯৪ সালে। যার ভূমিকা লিখে দিয়েছেন কবি শামসুর রাহমান। বলেছেন, ‘একজন সত্যিকারের কবিই তো যীশু খ্রিষ্টের মতো সকল মানুষের হয়ে দুঃখ পান। তিনি যৌবনের বিষণœতা, নিঃসঙ্গ আর দীর্ঘশ্বাসের কবি।

তাঁর শিল্প-সৌন্দর্যের বোধ যেমন তীক্ষè তেমনি তীব্র মানুষের প্রতি তাঁর মমতা, জীবনের প্রতি ভালোবাসা।’ তাঁর প্রথম কবিতা বইয়ের ২য় কবিতা ‘বনভূমির ছায়া’ পড়তে পড়তে শেষ দিকে এসে আমরা এক আত্ম-আবিস্কারের বিস্ময়ে উপনীত হই। বুঝতে পারি, পিকনিকে যেতে থাকা এক দল মানুষের বহমান জলের দিকে তাকিয়ে আচমকা নিজেদের প্রকৃত চেহারা দেখতে পেয়ে যাওয়াই কবিতাটির মূল ঘটনা। সত্য এই যে, মানুষ ভয়াবহ নিঃসঙ্গ, একা আর অসহায়।
‘হঠাৎ জলের নীচে পরস্পর আমরা দেখলুম
আমাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষ।
আমরা হঠাৎ কী রকম অসহায় আর একা হয়ে গেলাম।
আমাদের আর পিকনিকে যাওয়া হলো না,
লোকালয়ের কয়েকটি মানুষ আমরা
কেউই আর আমাদের এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, অসহায়বোধ আর মৃত্যুবোধ নিয়ে বনভূমির দিকে যেতে সাহস পেলাম না!’
(বনভূমির ছায়া/রাজা যায় রাজা আসে)।
 তাঁর ‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’ কবিতাটি তো কিংবদন্তির মতোই হয়ে আছে বাংলা কবিতার ইতিহাসে। সেই অমোঘ উচ্চারণÑ অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!
“অবশেষে জেনেছি মানুষ একা! 
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা! 
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সঙ্গে কোনদিন।
(পাখি হয়ে যায় প্রাণ/ রাজা যায় রাজা আসে) 
আস্তে আস্তে তাঁর কবিতা, তীব্র আবেগসহ নীতিগতভাবে প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক ঘোষণাপত্রই হয়ে উঠেছিল তখন, ’৭৫ থেকে প্রায় ’৯০ পর্যন্ত সময়টায়। দারুণভাবে লিরিকাল এই কবিতাগুলো আবৃত্তির জন্য যথাযথ মনে হতে থাকে। বলা যেতে পারে নান্দনিকভাবেই এক ধরনের স্পষ্টভাষীতা রয়েছে তাঁর। হ্যাঁ, এটা অনস্বীকার্য যে তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে পূর্বসূরি যে কবির নাম উঠে আসে বারবার, তিনি জীবনানন্দ দাশ। প্রথম দুই কাবিতাবইয়ে প্রখরভাবেই তাঁকে উপস্থিত দেখতে পাই আমরা। দেখতে পাই, ‘অনেক হাত থাকে যারা অন্ধকার থেকেই পরম আলো কুড়ায়, আলোও কেমন মিশে যায় বুকের পাশে সহজে / আবার কারো বা হাতের ভাঁজে অন্ধকার ছিন্ন পাখার মতো বাজে ঠিক যেমন স্রোতের তোড়ে জলে ফেনা গরজে!’ কিংবা, ‘একে একে সব গেছে, কিছু নেই, কিচ্ছুটি নেই, / তবু কিছু কষ্টে সৃষ্টে ধরে আছে এখনো মানুষ! /এখনো পেঁচার ডাকে কেউ কেউ লক্ষ্মীর আগমন টের পায়!’ বিষণœতা আর নিঃসঙ্গতার ভেতর দিয়েই আমরা আশার আলো দেখতে চাই, শৈশব থেকে বড় হতে হতে যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি, সেই ভালোবাসা, পাখি, প্রকৃতি, প্রেম, অন্ধকার, আলো ও মানুষ। আমরা তাঁর ঠিকানা জানতে চাই। ফিরে যেতে চাই বন্ধুত্বের কাছে। জীবনের কাছে। বড় হতে হতে পৃথিবীতে যে বেদনার বিষবাষ্প ছড়িয়ে গেছে আজ, তা আমাদের দম বন্ধ করে দিচ্ছে, আমাদের ফুসফুসে সেই বিষের প্রতিক্রিয়ায় নির্মল শ্বাস নিতে পারছি না। 
মাতৃভাষা কবিতায় তাঁর অসম্ভব শক্তিশালী বোধের পরিচয় মেলে। 
‘কিন্তু আমি রক্তের কী মাতৃভাষা এখনও জানি না!
বেদনার কী মাতৃভাষা এখনও জানি না!
শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ,
আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা!’
(মাতৃভাষা/রাজা যায় রাজা আসে)
রাজনীতি নিয়ে অসভ্য দর্শন কবিতায় তিনি বলেন—-
‘বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে খাঁ, খাঁ, খল, তীব্র এক বেদেনীর সাপ খেলা দেখছি আমি; রাজনীতির তাও কি রাজনীতি?’
(অসভ্য দর্শন/রাজা যায় রাজা আসে)
কবি আবুল হাসান ছিলেন শান্তিকামী ও যুদ্ধবিরোধী এক মানবতাবাদী কবি। তাইতো তিনি তার ‘জন্ম মৃত্যু জীবন যাপন’ কবিতায় বলতে পেরেছেন ... ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না,
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে 
আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই, 
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন কী লাভ যুদ্ধ কোরে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন? আধিপত্যে এত লোভ? পত্রিকা তো কেবলি
আপনাদের
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর...
মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম 
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলো না!

×