ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে বাংলার কথাসাহিত্য

প্রদীপ দত্ত

প্রকাশিত: ২১:২৭, ২০ জুলাই ২০২৩

দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে বাংলার কথাসাহিত্য

মহাদুর্ভিক্ষের পটভূমিতে বিভূতিভূষণের উপন্যাস- অশনিসংকেত

মহাদুর্ভিক্ষের পটভূমিতে বিভূতিভূষণের উপন্যাস- অশনিসংকেত, ছোটগল্প- ভিড়, পার্থক্য, বারোবাগদিনা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্বন্তর, গোপাল হালদারের ত্রয়ী উপন্যাস পঞ্চাশের পথ, ঊনপঞ্চাশী ও তেরো’শ পঞ্চাশ। সরোজ কুমার রায় চৌধুরীর কালো ঘোড়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তামণি, সুবোধ ঘোষের তিলাঞ্জলী, অমলেন্দু চক্রবর্ত্তীর আকালের সন্ধানে, প্রবোধ কুমার সান্যালের অঙ্গার প্রভৃতি। বিভূতিভূষণের অশনিসংকেত উপন্যাসের শুরুর দিকে এক আসন্ন দুর্যোগ তথা আকালের মুখোমুখি গঙ্গাচরণের আর অনঙ্গ বউ। অনাহার অর্ধাহারের মধ্যে দিয়ে কাটতে থাকে তাদের দিন। এরপর সত্যি-সত্যিই আকাল নেমে আসে। প্রতিবেশী ভূষণ ঘোষের বউ জলা থেকে শামুক-গুগলি তুলে আনে

অনেক দুর্ভিক্ষের ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বাঙালিকে তার কাল অতিক্রম করতে হয়েছে। যুগ যুগ ধরে ভিনদেশী আগ্রাসন তাদের অপশাসন আর সীমাহীন লুণ্ঠনে পর্যুদস্ত হয়েছে বঙ্গভূমি। শস্যপূর্ণা এই দেশ রিক্ত আর নিঃস্ব হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী, অন্নরিক্তা তুমি ভীষণা’। শুধু একমুঠো খাবারের সন্ধানে মানুষ দেশান্তরী হয়েছে। নিজ ভিটেমাটি হারিয়ে পরিণত হয়েছে ছিন্নমূল মানুষে। ঠাঁই হয়েছে লঙ্গরখানায়, তারপর ক্ষুধা আর রোগ-শোকে মৃত্যু, এ মৃত্যু সংখ্যাহীন। অবিভক্ত বাংলায় ১১৭৬ ও ১৩৫০ বঙ্গাব্দে স্মরণকালের দুটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়ে গেছে। ইতিহাসে যা ছিয়াত্তর ও পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে খ্যাত। এ দুটো বিভীষিকাময় দুর্ভিক্ষ আর দুর্ভিক্ষ পরবর্তী মহামারির  প্রেক্ষাপটে রচিত আমাদের সাহিত্যের নানা দিক যেমন 
ছোটগল্প,উপন্যাস, নাটক, কবিতা, গান, সিনেমা, চিত্রকলা এর সবকিছুই আজ প্রামাণ্য ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। পলাশীর যুদ্ধ পরবর্তী মাত্র তেরো বছরের মাথায় ১৭৭০ সালে ইতিহাসখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলায় এক কোটি লোক প্রাণ হারিয়েছিল। বিগত কয়েক বছরের খরায় ফসলহানি, অনাবৃষ্টি  এই মন্বন্তরের কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হলেও তা একমাত্র কারণ ছিল না। ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন রচয়িতা গোলাম হোসেন তবাতবায়ী লিখেছিলেন ‘১৭৭০ সালের মহররম মাসে দুর্ভিক্ষ ও গুটিবসন্ত রোগ একসংগে দেখা দিল। তারা ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে পুরো তিন মাস ধরে তা-ব চালালো। এরপর হঠাৎ করে (সম্ভবত বৃষ্টি শুরু হওয়ায়) এরা আবার পৃথিবী থেকে মিলিয়ে গেল’। এই দুর্ভিক্ষের প্রায় একশ বছর পর উইলিয়াম উইলসন হান্টারের ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত ‘দি এনালস অব রুরাল বেঙ্গল’ থেকে জানা যায় যে ১৭৭০ সালের মে মাসের পূর্বেই বাংলার তিন কোটি জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ লোক দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে প্রাণ হারায়।

ফলে মোট আবাদি জমির এক তৃতীয়াংশ অনাবাদি পড়ে থাকে যা ক্রমে ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়। একাধারে ক্ষয়িষ্ণু নবাবী শাসন ও কোম্পানি শাসন এই দ্বৈত ব্যবস্থায় খাজনা ট্যাক্সের পীড়ন ছিল ভয়াবহ। মন্বন্তরের কুফল হিসাবে কর্মহীন উদ্বাস্তু মানুষেরা ক্রমেই দস্যুবৃত্তি বেছে নেয়। বাংলার উত্তরাঞ্চলে বহিরাগত নাগা সন্ন্যাসী ও মারাঠী বর্গীদের লুটতরাজ, পথঘাটে দস্যুবৃত্তি; জমিদারদের কর্মহীন লেঠেল, নবাবের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া সৈনিক, সবাই হামলে পরে গ্রামগুলোর উপর। নিজ পেশা হারিয়ে অনেকে দাসবৃত্তি করতে থাকে। ক্রমাগত অভাবের তাড়নায় অনেকে নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাও বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

তার প্রায় শতবর্ষ পরে এই দুর্ভিক্ষ আর ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে  সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’। দুর্ভিক্ষের বর্ণনায় তিনি লিখেছিলেন ‘খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল, ইতর ও বন্যেরা কুকুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল, অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।’
সেই ভয়াবহ মন্বন্তরের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস সম্ভবত একটিই। তবে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ তথা বাংলা ১৩৫০-এ সংঘটিত সর্বনাশা পঞ্চাশের আকাল বা মন্বন্তর নিয়ে রচিত বিপুল সাহিত্যকর্মের সন্ধান আমরা পাই। সমগ্র ভারতবর্ষজুড়ে তখন চলছে ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। অগ্নিগর্ভ বাংলা এই সংগ্রামে সবচেয়ে এগিয়ে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে, জাপান বার্মা দখল করে নিয়েছে। ফলে বার্মা থেকে ভারতে চাল আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ব্রীটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ঘোষণা করেছিলেন ‘পোড়ামাটি নীতি’ অর্থাৎ ব্রিটিশ উপনিবেশের যে সমস্ত অঞ্চল তারা ছেড়ে যাবে তা নির্মমভাবে পর্যুদস্ত হলেও তাদের আক্ষেপ থাকবে না। জাপানিরা সমুদ্রপথে আসতে পারে ভেবে তারা উপকূলের সব নৌকা ধ্বংস করে দেয়, এমনকি জেলে নৌকা গরুরগাড়ি কিছুই বাদ রাখেনি। যুদ্ধে সৈনিকদের রসদের জন্য চাল কিনতে থাকে সরকার।

তখন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে খাদ্য পরিবহন নিষিদ্ধ হলো। দ্রুত কমে যেতে লাগলু খাদ্যশস্যের সরবরাহ । এই সুযোগে রাজকর্মচারী, জমিদারের নায়েব-গোমস্তা, মহাজনেরা চাল মজুদ করতে শুরু করল। শীতকালীন ফসল উপকূলীয় ঝড়ে নষ্ট হয়ে গেল। তখনই শুরু হলো মহাদুর্ভিক্ষ। আবার পঞ্চাশ লাখ মানুষ প্রাণ দিল সেই আকলে। সেই মহাদুর্ভিক্ষের পটভূমিতে বিভূতিভূষণের উপন্যাস- অশনিসংকেত, ছোটগল্প- ভিড়, পার্থক্য, বারোবাগদিনা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্বন্তর, গোপাল হালদারের ত্রয়ী উপন্যাস পঞ্চাশের পথ, ঊনপঞ্চাশী ও তেরো’শ পঞ্চাশ। সরোজ কুমার রায় চৌধুরীর কালো ঘোড়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তামণি, সুবোধ ঘোষের তিলাঞ্জলী, অমলেন্দু চক্রবর্ত্তীর আকালের সন্ধানে, প্রবোধ কুমার সান্যালের অঙ্গার প্রভৃতি।

বিভূতিভূষণের অশনিসংকেত উপন্যাসের শুরুর দিকে এক আসন্ন দুর্যোগ তথা আকালের মুখোমুখি গঙ্গাচরণের আর অনঙ্গ বউ। অনাহার অর্ধাহারের মধ্যে দিয়ে কাটতে থাকে তাদের দিন। এরপর সত্যি-সত্যিই আকাল নেমে আসে। প্রতিবেশী ভূষণ ঘোষের বউ জলা থেকে শামুক-গুগলি তুলে আনে। মতি মুচিনি, কাপালি বউ, অনঙ্গ বউ সবাই জঙ্গলে গিয়ে মেটে আলু সুষনি শাক কচু এসব তুলে খেয়ে জীবন ধারণের চেষ্টা করে। মতি মুচিনি অনঙ্গ বউকে বলছে ‘দিদি ঠাকরূণ সাতদিন ভাত খাইনি, শুধু চুনো মাছ ধরতাম আর গেড়ি গুগলি তাও ইদানীং মেলে না’। অনাহারে মতির মৃত্যু হয়, গ্রাম উজাড় করে শহরের লঙ্গরখানায় ছোটে মানুষ। এই হৃদয়স্পর্শী কাহিনী নিয়ে সত্যজিত রায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। যা বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বিয়ার  পুরস্কার লাভ করেছিল।

তারাশঙ্করের মন্বন্তর গল্পে  বিজয় নীলাকে বলছে ‘মানুষ মরছে, দলে দলে দেশত্যাগ করছে; স্ত্রী কন্যাকে ফেলে পালাচ্ছে, সন্তান বিক্রি করছে, বিশেষ করে কন্যাসন্তান’। গোপাল হালদারের তিনটি উপন্যাসেই অজন্মা, চোরাকারবারিদের কারসাজি আর মন্বন্তরের ভয়ঙ্গর পরিণতিতে সমাজজীবনে সৃষ্ট দুষ্টক্ষত সবকিছুই তিনি নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। ‘কালোঘোড়া’ উপন্যাসে সরোজ কুমার রায় চৌধুরী দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের দুর্দশার কাহিনী লিখতে গিয়ে বলছেন ‘এ যুদ্ধ একদিন থামবে ব্লাকমার্কেটও একদিন বন্ধ হবে। কিন্তু এই দুর্নীতির যক্ষ্মা এ সহজে ছাড়ছে না’।
প্রবোধকুমার সান্যালের ‘অঙ্গার’ ছোটগল্পে আছে ‘আগে ঝুলি নিয়ে ভিক্ষে যদি দুটো চাল পাওয়া যায়, তারপর হল ভাঙা কলাইয়ের থালা যদি চারটে ভাত কোথাও মেলে, তারপর হাতে নিল হাঁড়ি যদি একটু ফ্যান কেউ দেয়, আর এখন কেবল কান্না কোথাও কিছু পায় না’।  
অমলেন্দু চক্রবর্ত্তীর ‘আকালের সন্ধানে’ উপন্যাসে জমিদার গোমস্তা পুলিশের সহায়তায় কৃষকের ফসল লুঠে নিয়ে যায়। অর্জুন বলেই আকালে মাথাত ফাটল আর বছরে প্রতিশোধ, ‘ধান লুটতে আসবে কত মাথা ফাটাই দিবে হারামি গোমস্তা বুড়র’ প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন এই কাহিনী থেকে ছবি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সলিল চৌধুরীর ‘হেই সামালো ধান হো-গানটিকে সূচনা সংগীত হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। ছবিটি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছিল।
সত্যেন সেনের উপন্যাস ‘সেয়ানা’, সেখানে একদল লোক কাজের খোঁজে ট্রেনে চেপে আসাম যাচ্ছে ।তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে ‘গভর্নমেন্ট তো দেশের সমস্ত চাল যুদ্ধের জন্য বিদেশে পাচার করছে তার জন্যই এত আকাল’।

ইংরেজিতে লেখা এলা সেনের ছোটগল্প সংকলন ‘দি ডার্কেনিং ডেইজ’ যাতে মোট নয়টি গল্প। সেখানে আছে অনেকগুলো উপবাসী মানুষের আকালের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার কাহিনী। তিনি লিখছেন ‘লক্ষ্মী, যুথিকা, বীথির দুঃখ যন্ত্রণাকে বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না’। ড. বিনায়ক সেন জানাচ্ছেন এই বইটির একটি বিশেষত্ব হচ্ছে শিল্পী জয়নুল আবেদীনের হলদে কাগজ আর চাইনিজ কালিতে আঁকা বিখ্যাত সেই তেরোটি ছবি যা প্রথম সেই বইতেই প্রকাশিত হয়েছিল। কৃষণ চন্দর এর অন্নদাতা ও বিজন ভট্টাচার্যের নবান্নর কাহিনী নিয়ে খাজা আহমেদ আব্বাস নির্মাণ করে ছিলেন ছবি ‘ধরতি কি লাল’ ।
গণনাট্যের প্রাণপুরুষ বিজন ভট্টাচার্য লিখেছিলেন নাটক ‘নবান্ন’।বলা হয়ে থাকে দুর্ভিক্ষ পীড়িত গ্রাম্য মানুষের দুরবস্থা নিয়ে নবান্নর মত আর একটিও নাটক লেখা  হয়নি। এখানে আকালে বিপন্ন একটি গ্রাম, অনাহারী মানুষ,শহরের ফুটপাতে প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল, লঙ্গরখানা, ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট  নিয়ে মানুষ আর কুকুরের কাড়াকাড়ি, সংবাদপত্রের ফটোগ্রাফারদের ভিড়, অসংখ্য মৃত্যু কিন্তু তারপর যারা বেঁচে থাকে ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক নিয়মে তারা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। শচীন সেনগুপ্তর নাটক ‘রাজধানীর রাস্তায়’ তুলসি লাহিড়ীর ‘ছেঁড়াতার’ ,এই নাটকের বিখ্যাত একটি গান ‘ভুলো না রেখ মনে বাঁচবে যতকাল/সোনার দেশে ক্যান এলো পঞ্চাশের আকাল’।

সত্যেন সেনের গান ‘ও তুই বাঁধবি রে ঘর কেমন করে/তোর ভাঙলো বাসা কি দুর্দশা তেতাল্লিশের আকালের ঝড়ে’। হেমাঙ্গ বিশ^াসের ‘হায় হায় ঘোর কলিকাল/আইলো আকাল’ সলিল চৌধুরীর গানে আছে ‘হায়রে কখন এলো সমন/অনাহারের বেশে/সেই কাহিনী শোনাই শোন। কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গান ‘অনাহারে মৃত চোখগুলো সব পল্লীর যত হতাশায় নেভা চোখ/জেলেরা বুনবে নতুন জাল’ এই গানের অন্যতম গায়ক ছিলেন কলিম শরাফি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ফ্যান’ কবিতা ‘রাজপথে কচি কচি এসব শিশুর কঙ্কাল/মাতৃস্তন্যহীন/দধীচির হাড় ছিল এর চেয়ে আরও কি কঠিন’। কবি সুকান্ত লিখলেন ‘আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে/জমে ভিড় ভ্রষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে/দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল। ফররুখ আহমেদ কবিতা লাশ। কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায় এর সাহসী উচ্চারণ ‘রুটি দাও, রুটি দাও,রুটি দাও- আকণ্ঠ চিৎকারে, তবে ফিরে চলো মন দুর্ভিক্ষের মিছিলে।’
রাজনৈতিক সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ বঙ্গবন্ধুর আত্মজৈবনিক দিনলিপি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখছেন ‘ইংরেজের কথা হল বাংলার মানুষ যদি মরে মরুক যুদ্ধের সাহায্য আগে।যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রথম স্থান পাবে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে,তারপর যদি জায়গা থাকে তবে রিলিফের খাবার যাবে। যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি। যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না।’ প-িত নেহেরু তাঁর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে দুর্ভিক্ষের সময়েও কোলকাতার বিত্তবান মানুষের বিলাসী জীবন যাপন, ঘৌড়দৌড়ের মাঠে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঠিক তেমনই ভিড়, খাদ্যশস্য মজুত করে রাতারাতি কিছু মানুষের ধনী হয়ে ওঠা, বিয়েবাড়িতে আলোর রোশনাই এসব লিখে শেষে বলছেন ‘এই দুর্ভিক্ষ বাঙলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে এবং দুর্ভিক্ষে উত্তীর্ণ গোটা বাঙালি জাতিকে রেখে গেল দুর্বল ও ক্ষণজীবী’।

বস্তুত উনিশ শতকজুড়েই এক নীরব দুর্ভিক্ষ বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিরাজ করতে থাকে। ফলে নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ায় একটা নি¤œতর শ্রেণির উদ্ভব হয়। এরাই প্রান্তিক চাষি দিনমজুর কারখানার শ্রমিক প্রভৃতি। এক নীরব ক্ষুধা অনাহারের বেদনা ছিল বাঙালির নিত্যসঙ্গী। তবে সময় এখানেই থেমে থাকেনি। ইতিহাসের অনেক বাঁক পেরিয়ে দ্বান্দ্বিক বাস্তবতায় বাঙালি তার নিজের শক্তিতে ভর করে  রুখে দাঁড়িয়েছে একাত্তরে।

ঔপনিবেশিক যুগের বিলাসী মানুষদের সেই ঘোড়দৌড়ের মাঠেই বঙ্গবন্ধুর নির্ভীক তর্জনীর ইশারায় শেষবারের মতো সর্বস্ব বাজি রেখে লড়েছে, প্রতিষ্ঠা করেছে এই ভূখ-ে তার পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ। এরপরও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি, ১৯৭৪ এ দেশব্যাপী বন্যায় ফসলহানি আর সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য কারসাজিতে বাংলায় আবার নেমে এসেছিল খাদ্যাভাব। চিলমারীর অপ্রকৃতিস্থা নারী বাসন্তী আর তার বোন দুর্গতিকে জাল পরিয়ে ছবি তুলে সেই ছবি পত্রিকায় ছেপে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল তাদেরই অন্নে প্রতিপালিত প্রেস ফটোগ্রাফার ও পত্রিকা। আজ তারা সবাই হেরে গেছে, জিতেছে বাঙালি। সুকান্তের ভাষায় ‘রুখবে কে আর এ অগ্রগতি সাধ্য কার। সময় এখন বাংলাদেশের, আমরা উজান বেয়ে চলেছি।

×