
.
আমাদের ছোটবেলায় পড়া কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/পার হয়ে যায় গোরু/পার হয় গাড়ি/দুই ধার উঁচু তার/ ঢালু তার পাড়ি।’ এই মিষ্টি বর্ণনাখানি পড়তে পড়তেই চোখের সামনে বৈশাখ মাসেই প্রকৃতির এক নিখুঁত বর্ণনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। বৈশাখ মাসে নদী-খাল-বিল শুকিয়ে যায় এবং প্রকৃতি এক নতুন সময়ের আহ্বান করে। এই খরতাপের পর বৃষ্টি আসে জন্যই কিন্তু বৃষ্টি এমন প্রিয়, কাব্যিক অনুভূতির সূচনা করে। এই অনুভূতিতে যেমন বর্ষার অবদান রয়েছে সেভাবে বৈশাখেরও। আবার ঝড় হলেও বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় বৈশাখেই। আমাদের দেশের ষড়ঋতু ও বারোমাস নিয়েই কমবেশি সাহিত্য রচিত হয়েছে। কবির কবিতায়, উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনায়, গল্পকারের গল্প বর্ণনায় প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান সাহিত্যের উপজীব্য করে টেনে আনা হয়েছে। এর মধ্যে বেশি এসেছে কবিতায়। কখনো বর্ষার বৃষ্টি বা চৈত্রের খরতাপ, আবার কখনো শরতের আকাশ বা বসন্তের বাতাস।
এসবের বারোমাসের মধ্যে অন্যতম রচনার অনুষঙ্গ হলো বৈশাখ মাস। বৈশাখের প্রকৃতির সূচনা, প্রকৃতির রোষ এবং প্রকৃতির দান এসবই যেন কাব্যের অনুষঙ্গ। বৈশাখ বাঙালির জীবনে নতুন দিনের গল্পের সূচনা করে। প্রাণের স্পন্দন জাগায়। নতুন খাতা খোলে এই বৈশাখেই। তাই বৈশাখ নিয়ে কবিতায় মাতামাতি একটু বেশি। পহেলা বৈশাখে পত্রিকাগুলো ভরে ওঠে কবিতায়। বর্ণিল আয়োজনে সেসব কবিতায় ঠাঁই পায় বৈশাখের প্রেম, নতুন দিনের গান, নতুন সুর, উদ্দামতা আর ধেয়ে আসা কালবৈশাখী। বৈশাখের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হলো কালবৈশাখী ঝড়। এই কালবৈশাখী মানে কেবল ধ্বংস নয়, কালবৈশাখী মানে জীর্ণতার অবসান, দাসত্বের শৃঙ্খলের অবসানের রুদ্র রূপ। ঝড় মানে কালো মেঘ, ঝড় মানে প্রলয়ংকরী রূপ, অশুভ বিনাশক। বৈশাখে নতুন খাতায় লেখা হয় নতুন কবিতা। বৈশাখ মাস কবি সাহিত্যিকদের কাছে একটু বেশিই আদুরে। আনুষ্ঠানিকভাবে ঋতুরাজ বসন্ত বিদায় নেয় প্রকৃতি থেকে। এই বসন্তের চৈত্রেই প্রকৃতির রুক্ষভাব শুরু হয়। যার চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে বৈশাখে।
রৌদ্রের খরতাপে মাটি যেমন চৈত্র মাসে পোড়ে তেমনি বৈশাখেও পোড়ে। বৈশাখী ঝড়ে সেই পুড়ে যাওয়ার অবসান হয়। নেমে আসে প্রশান্তির বৃষ্টি। মাঠে মাঠে ফসল পাকতে শুরু করে। কৃষকের কাটা ধান কৃষাণীরা রোদে শুকিয়ে নেয়। প্রকৃতির এমন বর্ণনায় কবির কলম কি আর থেমে থাকতে পারে? কালবৈশাখী যে কেবল প্রকৃতির রুদ্র রূপ এবং ভয়ংকরের গান এমন নয়। আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেরকমই জয়ধ্বনি করেছেন। কালবৈশাখীতে তিনি নতুনের জয়গান করেছেন। তিনি লিখেছেন, তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ওই নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর। আবার ‘কালবৈশাখী কবিতায় লিখেছেন, ‘বারেবারে যথা কালবৈশাখী ব্যর্থ হল রে পুব-হাওয়ায়/দধীচি-হাড়ের বজ্র-বহ্নি বারেবারে যথা নিভিয়া যায়/কে পাগল সেথা যাস হাঁকি/বৈশাখী কালবৈশাখী! বৈশাখ মানে বাংলায় বিভেদ ভুলে একত্রিত হওয়ার মাস। বৈশাখ মাস ধর্ম, বর্ণ মিলেমিশে এক হয়ে নতুন করে শুরু করার মাস। তাই তো বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তার ‘বৈশাখ আবাহন’ কবিতার মাধ্যমে, এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ তাপসনিশ্বস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক। সব বাঙালি এই সুরেই বৈশাখকে আমন্ত্রণ জানান। আবার বৈশাখের কালবৈশাখীর রুদ্র রূপ প্রত্যক্ষ করে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় বলেছেন, আমি ধুর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর/আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব বিধাত্রীর! তিনিই আবার বলছেন, নাচে ওই কালবোশেখী/কাটাবী কাল বসে কি/দেরে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি/। এভাবে অধিকাংশ কবির কবিতায়ই বিভিন্নভাবে কালবৈশাখী উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রকৃতির বর্ণনা করা হয়েছে। কবি ফররুখ আহমদ তাঁর ‘বৈশাখে কালো ঘোড়া কবিতায়’ লিখেছেন, বৈশাখের কালো ঘোড়া উঠে এলো/বন্দর, শহর পার হয়ে সেই ঘোড়া যাবে দূর কোকাফ মুলুকে/অথবা চলার তালে ছুটে যাবে কেবলি সম্মুখে/প্রচন্ড আঘাতে পায়ে পিষে যাবে অরণ্য, প্রান্তর/। বৈশাখ মানে এই বাংলার জন্মদিন আবার বাঙালিরও জন্মদিন। আর তাই উৎসবের রেশটা একটু বেশিই থাকে এ মাসে। আবার আধুনিক কবিতার সর্বাধিক সমাদৃত কবি জীবনানন্দ দাশ, তিনিও বৈশাখকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেননি। বৈশাখ নিয়ে তিনিও কবিতা লিখেছেন। তিনি তাঁর বৈশাখের চিত্রে লিখেছেন, বৈশাখের মাঠের ফাটলে/এখানে পৃথিবী অসমান/আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই/ কেবল খড়ের স্তূপ পড়ে আছে দুই-তিন মাইল/তবু তা সোনার মতো নয়/কেবল কাস্তের শব্দ পৃথিবীর কামানকে ভুলে করুণ, নিরীহ, নিরাশ্রয়।
বাস্তবিকপক্ষে বৈশাখকে পাশ কাটানো সহজ কথা নয়। কারণ বৈশাখ বাঙালির আনন্দের এক অফুরন্ত উৎস। প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় লীলাক্ষেত্র। এর একদিকে থাকে রণমূর্তি আর অন্যদিকে নতুনকে গড়ার কাজ। এই দুই পাশাপাশি থাকাতেই যেন পছন্দ করে। কবি আল মাহমুদ তাঁর বোশেখ কবিতায় একদিকে যেমন প্রকৃতির রুদ্র রূপের কথা বর্ণনা করেছেন অন্যদিকে বৈশাখী ঝড়ের কাছে রেখেছেন মহাসত্য কিছু প্রশ্ন। যা প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয় নাড়া দেয়। তিনি বলেছেন, তবে এমন নিঠুর কেন হলে বাতাস/উড়িয়ে নিলে গরিব চাষির ঘরের খুঁটি/কিন্তু যারা লোক ঠকিয়ে প্রাসাদ গড়ে/তাদের কোনো ইট খসাতে পারলে নাতো। এই কবিতায়ই তিনি লিখেছেন, ধ্বংস যদি করবে তবে, শোনো তুফান/ধ্বংস করো বিভেদকারী পরগাছাদের/পরের শ্রমে গড়েছে যারা মস্ত দালান/বাড়তি তাদের বাহাদুরি গুঁড়িয়ে ফেলো। বৈশাখের কাছে এমন সত্য আহ্বান সত্যিই মুগ্ধ করে দেয়। বৈশাখের সেই শক্তি আছে। কালবৈশাখীর সেই প্রলয়ংকরী ধ্বংসযজ্ঞে যেন সব অন্যায় ধ্বংস হয়ে যায় এমনই আহ্বান। ঋতুভিত্তিক সাহিত্য আয়োজন আমাদের অনেক পুরনো রীতি। সেই রীতিতে বৈশাখ একটু বেশিই সমাদৃত হয়েছে। বৈশাখ নিয়ে লিখেছেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। তিনি তাঁর বৈশাখের পঙক্তিমালা কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন, ‘বহুদিন থেকে আমি লিখছি কবিতা/হঠাৎ দেখতে পাই কালবৈশাখের ঝড় ফেটে পড়ে তীব্র আর্তনাদে/বাতাসের হাহাকারে, নৌকায় নৌকায় দোলে। সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ তাঁর বোশেখ কবিতায় লিখেছেন, সেই পবনের কাছে আমার এই মিনতি/তিষ্ঠ হাওয়া, তিষ্ঠ মহা প্রতাপশালী/গরীব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে কি লাভ?/কি সুখ বলো গুঁড়িয়ে দিয়ে চাষির ভিটে?।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো বৈশাখী ঝড়ের যে রুদ্ররূপ সেই রূপের কাছেই মিনতি করা হয়েছে যেন তার প্রতাপের কোপে অসহায়ের ক্ষতি না হয়। কালবৈশাখী ঝড়ের যে তীব্র ভয়ংকর রূপ আমরা দেখি যা ধনীর চেয়েও গরিবের ক্ষতি করে বেশি। কারণ গরিবের ঘরই ছাউনিতে তৈরি, গরিবের পালই হাওয়ায় ছিঁড়ে যায়। বৈশাখ নিয়ে আরও বহু কবিতা লেখা হয়েছে। এখনো হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। নতুন নতুন শব্দে বৈশাখের বন্দনা হবে। মোহিতলাল মজুমদারের ‘কালবৈশাখী’ কবিতা দিয়ে শেষ করছি। ‘মধ্যদিনের রক্ত নয়ন অন্ধ করিল কে!/ধরণীর পরে বিরাট ছায়ার ছত্র ধলি কে!/কানন-আনন পান্ডুর করি/জলস্থলের নিশ্বাস হরি/আলয়ে-কুলায়ে তন্দ্রা ভুলায়ে গগন ভরিল কে!’ আহা! বৈশাখের এমন রূপ সত্যিই অতুলনীয়।