
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে করোনাকাল যে বেহালদশা তৈরি করে তাতে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অবরুদ্ধতার কঠিন বেষ্টনী আসে। তেমন সঙ্কটকালে পার হওয়া সত্যিই দুঃসহ যন্ত্রণা। এরই মধ্যে কাক্সিক্ষত বইমেলা দেরিতে হলেও তার অবস্থান ইতোমধ্যেই জানান দিচ্ছে। অপেক্ষমাণ লেখক এবং পাঠক তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বইমেলার নিজেদের কর্মদ্যোতনাও উপস্থাপন করে যাচ্ছেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বইমেলা যা শুরু হয় মার্চের মাঝামাঝি সেখানে দেশের খ্যাতিমান ও বিজ্ঞ লেখকদের গ্রন্থও পাঠক সমাজের কাছে চলে আসে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গণী লেখেন ‘প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক ভূগোল’। আগামী প্রকাশনী বইটি বের করে এবং প্রচ্ছদ আঁকেন ধ্রুব এষ। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া এই সাহসী লেখক সঙ্গত কারণে দেশ ও ইতিহাস ঐতিহ্যের এক নিবেদিত সহযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। স্বদেশের পলিমাটির উৎস সন্ধানে সমুদ্র জলরাশির অবিরাম সিক্ততায় বঙ্গজননীর যে ঐতিহাসিক অভ্যুদয় তারই একটি নান্দনিক বর্ণনায় লেখক নিজের প্রজ্ঞা আর জ্ঞান চর্চাকে পরিশীলিত করেছেন। মানব ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় শুধু সমুদ্র উপকূলবর্তী নয় নদী তীরে অবস্থানরত সোঁদা পলিমাটিই সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে যুগান্তকারী অবদান রেখেছিল। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলধারা ছাড়াও নদীবিধৌত বাংলার অপার সম্ভাবনায় গড়ে উঠেছিল গাঙ্গেয় উপত্যকার সভ্যতা সূর্যের উদয়। মধ্যগগনে তেজোদীপ্ত কিরণের আলোকোদয়ের বিকাশমান ধারায় বঙ্গীয় সংস্কৃতির যে অভাবনীয় স্ফুরণ তাও যেন বিশ্বের এই সর্ববৃহৎ বদ্বীপটির এক অনন্য বৈভব। লেখক সুচিন্তিত অভিমতেই শুধু নয় তার চেয়ে বেশি জ্ঞান সাধনার সাবলীল ধারায় বঙ্গীয় চিরায়ত প্রকৃতির অনবচ্ছেদ সম্ভার ভৌগোলিক প্রতিরোধেরও এক অসাধারণ রূপরেখা দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। সেই বর্ণনায় আদ্যপান্ত বিশ্ব প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে সন্নিবেশিত করা লেখকের উদার ও প্রগাড় বুদ্ধিবৃত্তিকে পাঠকের সামনে হাজির করে। মহাবিশ্ব সৌরজগত, প্রকৃতির সঙ্গে পৃথিবীর নিরবচ্ছিন্ন যোগসাজশে মনুষ্য জগতের অভ্যুদয় তাও যেন বৃহৎ জগতের এক সম্প্রসারিত অভিগমন। সুগভীর তত্ত্বজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অনন্য যাত্রাপথে প্রকৃতিকে জয় করে বিশ্বব্রহ্মা-ের অনন্য দিগন্ত সৃষ্টি তাও যেন বিশ্ব নিয়ন্তার এক অবধারিত অভিযান। তারই আলোকে প্রাচীন ও ঐতিহাসিক বঙ্গভূমির চারপাশের বিশ্ব ও সৌরজগতের কেন্দ্রীকরণ লেখককে যে মাত্রায় নিবিষ্ট করে সেখানে বাংলার পলিমাটির খচিত উর্বর ভূমি অঞ্চলটির সমৃদ্ধিতে যুগান্তকারী অবদানও রাখে। পাশাপাশি তার সাংস্কৃতিক বৈভব, রাজনৈতিক বলয়, বিচিত্র ধর্মীয় দর্শন ছাড়াও রাজা-বাদশাদের উত্থান-পতনের ঘটনা পরম্পরা পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। সত্যিই অসাধারণ এই সুখপাঠ্য গ্রন্থটি তার অনবদ্য আবেদন নিয়ে পাঠকপ্রিয়তা পাবে তেমন প্রত্যাশা করাই যায়। লেখককে ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন এই ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যিক বইটি পাঠক সমাজকে উপহার দেয়ার জন্য।